প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
দেবজ্যোতি দেবু | ২৪ আগস্ট, ২০১৯
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যখন টালমাটাল অবস্থা, প্রতিদিন ন্যুনতম একটা ধর্ষণের খবর আসছে পত্রিকায়, গুম-খুন-ছিনতাই যখন নিত্যদিনের ঘটনা, তখন অবাক হয়ে লক্ষ করলাম আমাদের পুলিশ ভাইয়েরা তরুণ সমাজের চুল কাটা নিয়ে ব্যস্ত! ফেইসবুকে একটি ছবিতে দেখলাম একজন পুলিশ সদস্য নিজের হাতে কাঁচি দিয়ে এক যুবকের চুল কেটে দিচ্ছেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে! অনেকক্ষণ ভেবেও এভাবে একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিককে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে হেনস্তা করার কোন আইনি বৈধতা খুঁজে পেলাম না! তাহলে এই অধিকার ঐ পুলিশ সদস্যকে কে দিলো? তাকে কেউ চ্যালেঞ্জই বা করলো না কেন?
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি সিলেটের কানাইঘাট, রাজশাহীর বাঘা এবং সর্বশেষ মাগুরা জেলার সেলুন ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করেছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন। তাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছে ‘বখাটে স্টাইলে’ কারো চুল কাটা যাবে না। কাটলে ঐ সেলুন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। এলাকায় মাইকিং করেও এরকম ‘বখাটে স্টাইলে’ চুল না কাটার জন্য আহবান জানিয়েছে পুলিশ!
সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগলো, একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত জীবনাচার যদি রাষ্ট্রীয় আইনের বিরুদ্ধে না যায় তাহলে সেখানে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আদৌ রাষ্ট্রের আছে কী? আমার চুল কাটবো কি কাটবো না, চুলে রঙ করবো কি করবো না, আমার পোশাক কী হবে, এসব নির্ধারণ করে দেয়ার অধিকার কি একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা রাখে? এটা কি নাগরিকের মানবিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন নয়?
তাছাড়া এই 'বখাটে স্টাইল' বলতে পুলিশ প্রশাসন কী বোঝানোর চেষ্টা করছে? এর সংজ্ঞাটাই বা কী?
মাগুরা জেলা পুলিশ অবশেষে এই বখাটে স্টাইলের একটি সংজ্ঞা দিয়েছে। তারা বলছে, “একশ্রেণির যুবক চুল এমনভাবে কাটেন যে তাদের দুই কানের ওপরের অংশে চুল থাকেই না। কিন্তু মাথার ওপরের অংশে ঘন চুল থাকে। এই চুল বেশ দীর্ঘ হয়। হাঁটার সময় কিংবা মোটরসাইকেল চালানোর সময় এই চুল বাতাসে দুলতে থাকে। এভাবে চুল কাটানোই ‘বখাটে কাটিং’।”
নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত কিছু স্বাধীনতা আছে। কিছু মৌলিক অধিকারও আছে। সেই স্বাধীনতা এবং অধিকার খর্ব করার কোন অধিকার কি রাষ্ট্র ব্যবস্থার আছে? সবচেয়ে বড় কথা, হুটহাট 'নির্দেশনা' জারি করে দেয়ার এখতিয়ারই বা স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাকে কে দিলো?
সংবিধান বলছে,
“জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা লাভের অধিকার: আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না।”
“চলাফেরার স্বাধীনতা: জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, দেশের যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশে ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে।”
অথচ বাস্তবে দেখছি পার্কে পার্কে ঘুরে সাধারণ মানুষদের হয়রানি করার দায়িত্ব পালনে নেমেছেন সাংসদ থেকে শুরু করে পুলিশ কর্মকর্তা পর্যন্ত। শুধু প্রকাশ্যে হয়রানি করেই তারা ক্ষান্ত থাকছেন না, ধরে থানায় নিয়ে যাচ্ছেন ছেলে মেয়েদের! আরও অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এসব নিয়ে কেউ প্রতিবাদও করছে না! পুলিশ যা করছে তা ঠিকই করছে, অনেকটা এমন ভাব! এটা কী সংবিধান পরিপন্থী কাজ না?
‘বখাটে স্টাইলে’ চুল কাটতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ প্রসঙ্গে মাগুরা জেলা পুলিশ বলছে, “এটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, উঠতি বয়সের যুবকদের সংযত আচরণ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করা। সম্প্রতি মাগুরায় কিশোর ও উঠতি বয়সের যুবকদের হাতে খুনসহ নানা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যেটির পেছনে তাদের অস্বাভাবিক জীবনযাপন ও আচরণের যোগসূত্র পেয়েছে পুলিশ। এ কারণে নতুন প্রজন্মকে সচেতন করতে এ প্রচারণা চালানো হচ্ছে।”
কী মুশকিল! উঠতি বয়সের যুবকদের সংযত আচরণ ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য পর্যাপ্ত কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা না করে জোর করে তাদের অপমান, অপদস্থ করে কোন ধরনের সচেতনতা বাড়াচ্ছেন তারা? এতে করে তরুণ-যুবারা সচেতন হবে নাকি আরও আত্মবিধ্বংসী হবে? কোন মনস্তত্ববিদই বা তাদের এমন পরামর্শ দিলেন?
দেশে কিশোরদের মধ্যে মাদকাসক্তি মহামারী আকারে ছড়াচ্ছে। খুব সহজেই তারা হাতে অস্ত্র পেয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তারা দ্রুত অপরাধপ্রবণ হচ্ছে। এর সবকিছুই কেন, কীভাবে, কাদের সহযোগিতায় হচ্ছে তার সবটুকুই পুলিশ প্রশাসন জানে। মাদকের বিস্তার রোধ না করে, গডফাদারদের ছত্রছায়ায় সন্ত্রাসী লালনের সংস্কৃতিকে ধ্বংস না করে, শুধুমাত্র চুল কেটে তারা কীভাবে যুবকদের স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত করবেন?
সম্মানিত পুলিশ সদস্যবৃন্দ, গত কিছুদিন আগে আপনাদের যে সকল সহকর্মী ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হলেন তাদের চুল কেমন ছিল? প্রায়ই পত্রিকায় আপনাদের যেসকল সহকর্মীদের নামে নারী নির্যাতনের অভিযোগ ছাপা হয়, তাদের চুল কেমন থাকে? দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সহযোগিতার দায়ে যে সকল পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা চলমান আছে তাদের চুল কোন সেলুনে কাটা হয়েছিলো? যে পুলিশ কর্মকর্তার মেয়ে মাদকাসক্ত হয়ে নিজের বাবা-মাকেই খুন করলো সেই বাবা এবং মেয়ে কোন সেলুনে চুল কাটতেন সম্মানিত পুলিশ সদস্যবৃন্দ?
মাননীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রতি বিনম্র আবেদন, এসব উদ্ভট কর্মকাণ্ড থামান। নয়ন বন্ডের মত সন্ত্রাসীরা ‘বখাটে স্টাইলে’ চুল কেটে বখাটে হয় না। বখাটে হওয়ার পরে তাদের চুল, পোশাক দেখে আপনারা ঐ বাহ্যিক রূপটাকে বখাটে রূপ বলে দাবি করেন। তারমানে সে বখাটে হচ্ছে আগে এবং স্টাইলটা করছে পরে। তাই পরে যে কাজটা করছে সেদিকে ফোকাস না করে, শুরুর কাজটাতে ফোকাস করুন। অপরাধ প্রবণতা কমানোর জন্য সেই গডফাদারদের মূল থেকে উপড়ে ফেলুন, যাদের কল্যাণে এরা বিপথী হচ্ছে।
সত্যিই যদি ইতিবাচক কিছু করার ইচ্ছা থেকে থাকে তাহলে পাড়ায় পাড়ায় কাউন্সিলিং সেল গঠন করুন। প্রতিটি পাড়ার উঠতি কিশোর, তরুণদের কাউন্সিলিং করানোর ব্যবস্থা করুন। বাসায় বাসায় গিয়ে অভিভাবকদের সাথে আলাপ করুন। তাদেরকে সচেতন করার চেষ্টা করুন। বাংলাদেশে অনেক ভাল ভাল সাইক্রিয়েটিস্ট আছেন। তাদের পরামর্শ নিন। অযথা চুল আর কাপড়ের পিছনে ছুটে নিজেদের এবং আমাদের সময় নষ্ট করা থেকে বিরত থাকুন প্লিজ। বিশ্বাস করুন, আপনাদের এসব অযৌক্তিক কর্মকাণ্ড দেখতে দেখতে আমরা ক্লান্ত। আমাদের রেহাই দিন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য