প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
নিখিল নীল | ১৪ জুলাই, ২০১৫
অলি-আউলিয়ার বদৌলতে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আধ্যাত্মিক ভূমি বলে পরিচিত সিলেট। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোল ঘেষে অবস্থিত সিলেটের কুমারগাঁও, যেখানে দিনে-দুপুরে কয়েকজন তরতাজা যুবক সম্মিলিতভাবে মারতে মারতে মেরে ফেলেছে তের বছরের এক স্নিগ্ধ কিশোরকে।
মারতে মারতে মেরে ফেলার দৃশ্যটাকে মোবাইলে ভিডিও করেছে তারা, ছড়িয়ে দিয়েছে ফেসবুকে। স্নিগ্ধ সে-কিশোরের বিরুদ্ধে চুরি করার অভিযোগ, তাই তারা হয়তো বাংলাদেশকে জানিয়ে দিতে চাইল কত মহান কাজ তারা করে ফেলেছে অভিযুক্তকে পিটিয়ে মেরে ফেলে! ভিডিও দেখতে যেয়ে মানুষও বেশ নাড়া খেল, নড়ল বিবেক। কী দেখছে তারা এসব! সমাজবিজ্ঞান বলে ওগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
সামাজিক কোনো ব্যাধিতে ব্যক্তি আক্রান্ত হলে ব্যক্তি উল্লাস করতে করতে এমন ঘটনা ঘটায়। রাজনকে পিটিয়ে মারার দৃশ্যটিও এমন। আউলিয়া, বিজ্ঞান সব ছাপিয়ে এ-সংস্কৃতিটা বাংলাদেশে বলবান হয়েছে বিগত কয়েক দশকেই। হয়েছে গণতন্ত্রের কুহককে কাজে লাগিয়ে। পিটিয়ে মানুষ মারার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে বাংলাদেশে। এ-ঘটনাটি এক স্নিগ্ধ কিশোরের ওপর হয়েছে, আর ঘটনাটির ভিডিওচিত্র সবাই দেখছে বলেই এত হাহাকার—এই যা!
আহাজারিটা অন্য কোথাও হোক। ধরুন, ঘটনাটির ভিডিও তারা করেনি। করলেও সেটা তারা আপলোড করেনি। ধরুন, মারতে মারতে মেরে ফেলার পরে স্নিগ্ধ কিশোরটির লাশ তারা গুম করে ফেলতে সক্ষম হল।
আমরা জানতামই না এমন কিছু হয়েছে! হ্যাঁ, এমন ঘটনা অসংখ্য না হতে পারে, তবে প্রথম নয়। ওগুলো হয়। বেবাকেই জানে না, কারণ মশগুল থাকার মতো বহু বড় বড় বিষয় মানুষের দৈনন্দিন তৈরি হচ্ছে। কিছু কিছু তৈরি করা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে, কারণ দেশ শাসন বা আন্দোলনে সুবিধা দেয় বিভিন্ন ইস্যু। সে শিক্ষা মানুষ পেয়েছে শাহবাগে গণজাগরণের সময়।
মানুষ চিৎকার করছে যুদ্ধাপরাধের শাস্তির দাবী নিয়ে, আর বিরোধীরা সমবেত হল নাস্তিকতার উজবুকি অভিযোগ নিয়ে। যাই হোক, কোন সংস্কৃতিতে মানুষ দিন কাটাচ্ছে এখন? সমাজ ভেঙে পড়ার সংস্কৃতি। আইন ভেঙে পড়ার সংস্কৃতি। নৈতিকতা ভেঙে পড়ার সংস্কৃতি। সমাজ ভাঙছে, নৈতিকতা ভাঙছে প্রতিনিয়ত—পৃথিবী জুড়েই।
কিন্তু, উন্নত বিশ্বে সমাজ ভাঙলেও রাষ্ট্র শক্তিশালি হয়েছে— রাষ্ট্রই মানুষকে নৈতিক রাখছে আইনের কঠোর শাসনের মাধ্যমে। বিপরীতে বাংলাদেশের মতো দেশে সমাজ দুর্বল হচ্ছে, রাষ্ট্র শক্তিশালি হচ্ছেনা।
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ঘটা মৃত্যুর ঘটনাগুলোর দিকে একটু নজর রাখলেই বোঝা যায় আমরা ধীরে ধীরে কোন আত্মঘাতি প্রবণতাকে বপন করে চলছি। বিচারের আওতায় না এনে র্যাব-পুলিশ মানুষ মেরেছে। পুলিশদের পিঠিয়ে মারা হয়েছে।
তরুণ রাজনৈতিককর্মীরা তাদের বিরোধীদের পিটিয়ে মেরেছে। হরতাল আর প্রতিবাদ প্রতিরোধের নামে বাসে আগুন লাগিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়েছে। গুম হয়ে গেছেন বেশ ক’জন রাজনৈতিক নেতা। মাসখানেকের ব্যবধানে তিন-চারজন ব্লগ-লেখককে পাবলিকপ্লেসে কুপিয়ে মারা হয়েছে। আর, এসব ঘটনা নিয়ে সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই পক্ষ-বিপক্ষে বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে তর্কাতর্কি করেছে। বিচার না-করে মানুষ মারার পক্ষে বৈধতার যুক্তি অনেকেই উপস্থাপন করেছেন। দিনে-দুপুরে মানুষকে কুপিয়ে নিরাপদে চলে যায় খুনি, আর বেবাক মানুষ তখন হত্যার বিচার না-চেয়ে হত্যাকাণ্ডকে পরোক্ষ সমর্থনের যুক্তিগুলোকে একত্রিত করছে। এ এক ভয়ংকর ব্যাধি।
এ অদ্ভূত সংস্কৃতির চিত্র আঁচ করা যায় তথাকথিত স্যোশাল মিডিয়াতেও। “স্যোশালমিডিয়ায়” বেশ বিপ্লব ঘটে গেছে গত এক দশকে। ফেসবুক ব্যবহার করেন এমন মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশে কত সে পরিসংখ্যান আছে কীনা জানা নেই । তবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির, বিশেষত নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির সাংস্কৃতিক চরিত্র সেখানে বেশ ভাল করে উপলব্ধি করা যায়। স্যোশাল মিডিয়াকে একটা শক্তিশালি প্লাটফর্ম হিসেবে দেখেন অনেকেই। তাদের বেশিরভাগই সমাজ বিচ্ছিন্ন, তবে সমাজ নিয়ে এক অদ্ভূত জাদুবাস্তবতায় মোহাবিষ্ট থাকেন সব সময় তারা। স্ক্রিণে সমাজ দেখলে যা হয়!
বাড়তি পাওনা হিসেবে এসেছে আলোচনার ভিতরে গালিগালাজের সংস্কৃতি! অসহনশীল আর অগণতান্ত্রিক আচরণের উর্বরক্ষেত্র এসব স্যোশাল মিডিয়া। মেরুকরণ হয়েছে ভয়ানকভাবে। গণতন্ত্রের পথ বন্ধ করে গণতন্ত্র চর্চার রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় বাস্তবতাটাই ফেসবুকে চরম আকারে প্রতিফলিত হচ্ছে। সে চিত্র সমাজেই আজ প্রকট; স্যোশাল মিডিয়াতেও।
কিশোরটির হত্যাকাণ্ড মানুষের চোখে পানি নিয়ে আসে। গালাগালিতে কোনো সমাধান আসবে না। এ সব বর্বর ঘটনা থেকে যথার্থবোধটা না-নিতে পারলে বাংলাদেশের পতনের পথ আরও দীর্ঘ হবে।
স্নিগ্ধ কিশোরটির হত্যাকারীদের বিচার হয়তো হয়েই যাবে। কারণ ওটা নিয়ে রাজনীতি করার তেমন কিছু নেই। কিন্তু, যে অসহনশীল, অগণতান্ত্রিক, ও মেরুকরণের সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়েছে তা সংশোধনের কোনও সহজ পথ খোলা নেই। কারণ, সে- কাঙিক্ষত গণতান্ত্রিক চর্চার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। মানুষের বোধোদয় হোক, আর নজরটা মূলে পড়ুক। সমস্যা না চিনতে পারলে, সমাধানও আরেকটা সমস্যা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য