প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ১০ অক্টোবর, ২০১৯
আবরার হত্যাকাণ্ড বেশ বড় একটা নাড়া দিয়েছে বাংলাদেশকে। আবরারের অপরাধ কী ছিল? সে শিবির করতো, সে ফেসবুকে ভারত বিরোধী স্ট্যাটাস দিয়েছিল। আবরার; শুধু শিবির নয়, সে আইএস কিংবা তালেবান যোদ্ধাও নয়, তাকে পিটিয়ে মারার অধিকার কারো নেই। গোলাম আযম, সাঈদী, মুজাহিদ কিংবা সাকা চৌধুরীকে তো বিচার না করে পিটিয়ে মেরে ফেলা যেত। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদেরও বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। কেউ তো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারেনি।
মত এবং ভিন্ন মতই পৃথিবীর সৌন্দর্য। ভিন্ন মতকে, মত দিয়ে সমালোচনা করুন, আলোচনা করুন। তাই বলে হত্যা? "মানুষ হত্যা মহাপাপ" সেই মহাপাপ করেছে ছাত্রলীগ। এর প্রায়শ্চিত্ত অবশ্যই করতে হবে অবশ্যই। যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম সে অপরাধ করেছে, দেশে আইন আছে, আদালত আছে, তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা করা যেত। কিন্তু হত্যা করতে হবে কেন? কারো মতের সাথে নীতির সাথে না মিললে হত্যা করতে হবে কেন?
পৃথিবীতে যতো ধর্ম এসেছে, সবই ভিন্ন মত নিয়ে এসেছে। প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস এবং মতবাদকে গুড়িয়ে দিয়ে নিজের মত ও মহিমা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে। অতএব ভিন্ন মতকে হত্যার কোন বিধান বা অধিকার পৃথিবীতে কারো নেই।
আজকে যারা আবরার-আবরার করছেন, আপনাদের জন্য করুণা হয়। এই হত্যাকাণ্ড, এই ভিন্ন মত সহ্য না করার অপরাধ আমাদের, আপনার আমার। অভিজিৎ রায় যেদিন লাশ হয়ে পড়েছিল বইমেলায়, রাজীব হায়দার, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয়ের হত্যাকাণ্ড আমাদের বিচলিত করেনি সে সময়। নানা ভাবে সেই সব হত্যাকাণ্ডকে মেনে নিয়েছি। তাদের ভিন্ন মতের সাজা হিসাবে তাদের প্রাপ্য মিটিয়েছি। সেই মানুষই আবরার হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে জেগে উঠেছেন। সেই দিন মাহমুদুর রহমান সহ আমার দেশ গং মেতেছিল সেইসব হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দিতে। সেদিন যদি রুখে দাঁড়াতেন, প্রতিবাদ করতেন আবরার পর্যন্ত হয়তো আসতে হতো না আমাদের।
আর এইবার, বিবিসির মতো গণমাধ্যম একটি সংবাদ ছাপিয়ে দিল কোন ধরণের নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়া। যে সংবাদটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার দিয়েছিল আবরার। এই সংবাদ বা সাংবাদিক নিয়ে কেউ কথা বলছে না। দুঃখ প্রকাশ করে তাদের দায় মিটিয়েছে বিবিসি বাংলা। কিন্তু আবরারের জীবনের দাম কি সেই দুঃখপ্রকাশেই মিটে যাবে? আবরারকে আমরাই খুন করেছি, ভিন্ন মত শ্রদ্ধা না করার যে সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতির বলি হয়েছে আবরার। আবরার হত্যাকাণ্ডের পর যতোটা না হত্যার বিচারের দাবি করছি তার চেয়ে বেশি উসকে দিচ্ছি ঘৃণা আর বিদ্বেষ। অনিক নাম দেখেই তাকে ভিন্ন ধর্মের ধরে নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিচার শুরু হয়েছে। অমিত ঘটনাস্থলে ছিলনা, তবু তাকে কেন আসামি করা হল না তার সাম্প্রদায়িক ব্যবচ্ছেদ করছি। খুনি দলের ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেখানে হিন্দু, মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান পরিচয় বড় নাকি খুনি হিসাবে বিবেচ্য?
বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক , স্বাধীনতার পর থেকেই গেল গেল, ভারত নিয়ে গেল সব শুনেই আসছি। এক বাংলাদেশ বারবার ভারতের কাছে বিক্রি হচ্ছে। এক দেশ বোকার মতো বারবার কিনছে ভারত!
সরকার বা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কোন ধরণের বিবৃতি বা অফিশিয়াল বক্তব্য ছাড়াই প্রচার পেল ফেনী নদীর পানি দিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ভারতের কাছে গ্যাস বিক্রি করবে। ব্যাস আর যায় কোথায়! শুরু হলো গেল গেল…
ফেনী নদীর পানি ত্রিপুরার সাবরুম শহরে সুপেয় পানির জন্য তাদের প্রদান করতে রাজী হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, শুকনো মৌসুমে ফেনী নদীতে ৪৬-৪৭ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়। নদী বিশ্লেষকের মতে, সেখান হতে ভারতের ত্রিপুরার সাবরুম শহরে তাদের তীব্র সুপেয় পানির অভাব পূরণের জন্য ১ দশমিক ৮ কিউসেক পানি সরবরাহ করলে ফেনী নদীর প্রতিবেশ ও জীব বৈচিত্র্যের কোন পরিবর্তন ঘটবে না। সবচেয়ে বড় কথা ফেনী একটি আন্তর্জাতিক নদী। হুম প্রশ্ন উঠতে পারে আমাদেরকে তিস্তার পানি দিচ্ছে না ভারত। আমরা কেন ফেনীর পানি দেব? সেই প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক।
এই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ত্রিপুরায় যে পানি দেওয়া হচ্ছে, তা হচ্ছে খাবার পানি। কেউ খাবার পানি চাইলে, তা যদি না দিই, তাহলে কেমন হয়?
ছেলেবেলায় আমাদের একটা কবিতা ছিল মাতৃভক্তি, যেখানে বায়োজিদ বোস্তামীর মা তার কাছে গভীর রাতে পানি পান করতে চেয়েছিল, কিন্তু ঘরে এক ফোটা পানি ছিল না, ছোট বায়োজিদ বোস্তামী গভীর রাতে মায়ের জন্য পানি নিয়ে এসে মায়ের শিয়রে দাঁড়িয়েছিল সারা রাত। কখন মায়ের ঘুম ভাঙবে। আমাদের শেখানো হয়েছিল কেউ পানি পান করতে চাইলে না করতে নেই। এইটাই মানবতা। তৃষ্ণার্ত মানুষকে পানি দিতে হয়।
আর এলপিজি ( বাসা-বাড়িতে রান্না করার জন্য বোতলে ভরা গ্যাস) ভারত বাংলাদেশ থেকে আমদানি করবে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশ হতে ত্রিপুরায় এলপিজি আনতে ১২০০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়। আর তারা বাংলাদেশ হতে আমদানি করতে পারবে ২০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে। এলপিজি গ্যাস বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করে। প্রয়োজনের অধিক আমদানিকৃত গ্যাস মাগনা নয়, মুনাফা করেই ভারতের কাছে বিক্রি করবে বাংলাদেশ।
তৃতীয়ত বাংলাদেশ ও ভারত মিলে সমুদ্রে একটা রাডার বসাবে যাতে কোন অপকর্ম দু-দেশের সীমান্ত দিয়ে সংগঠিত না হয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বলি হয়েছে ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা। বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদেছে। এই বুয়েটেই ২০১৩ সালে আরিফ রায়হান দ্বীপ নামে একটা ছেলেকে এমনিভাবে রাতের আঁধারে, চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল...
মনে আছে?? শুধু আবরার নয়, দ্বীপ, সাদেকুর নাহার সানি, কিংবা অভিজিৎ, রাজিব, অনন্ত, বাবু বাচ্চু, জুলহাস হত্যায় সেদিন যে ঘৃণা পুষেছিলাম, বিচার চেয়েছিলাম, আজ আবরার হত্যাকাণ্ডে ও একই ঘৃণা জানাচ্ছি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
কিন্তু, প্রতিবাদের ভাষা যখন রাজনৈতিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট হয়ে যায়, মূল দাবি তখন হারিয়ে যায়। এতো বড় হল, কয়েকশ' ছাত্র, সারা রাত নির্যাতন করে একটা ছেলেকে মেরে ফেলা হলো, কেউ জানতে পারলো না, প্রতিবাদ করার সাহস পেলো না। এখন মৃত্যুর পর রাস্তায় নেমে, ক্যামেরার সামনে বীর পুরুষ সেজে লাভ কি! লাশের রাজনীতি বন্ধ হউক। আবরার হত্যার বিচার হউক।
রাষ্ট্র ধারণায় একজন সাধারণ নাগরিক কী আশা করে? পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, জিডিপি, বৈদেশিক রিজার্ভ? কিছুই না। মানুষ সুবিচার আশা করে। সংখ্যালঘু, ভিন্ন চিন্তা, আস্তিক নাস্তিক নারী পুরুষ, তৃতীয় লিঙ্গ সবার জন্য একই বিচার ব্যবস্থা। বিচার হীনতার সংস্কৃতি মানুষকে দানব করে তুলেছে। এই দোষ ছাত্রলীগের নয়। সব রাজনৈতিক দল এই দোষে দুষ্ট। ছাত্রলীগ ভিন গ্রহের কোন প্রাণি নয়। এই দেশ, রাষ্ট্র, সমাজের আলো বাতাসে বেড়ে উঠা সংগঠন। তাই সমাজ ব্যবস্থার প্রভাব থাকবেই। সেটাই স্বাভাবিক।
আমরা এতো বেশি রাজনৈতিককরণ করেছি যে, সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে পিতাকে তার রাজনৈতিক পরিচয় দিতে হয়! একপক্ষ সোজা দাঁড়িয়ে গেলেন সরকারের বিপক্ষে।
বাঙালি নিয়ে একটা প্রচলিত কৌতুক আছে, মৃত্যুর পর এক লোকের বিচার করতে গিয়ে যমরাজ পড়েছেন ঝামেলায়, তার পাপ এবং পুণ্য এমন ভাবে কাটায় কাটায় মিলে গেছে যে, তাকে স্বর্গে পাঠাবেন না নরকে পাঠাবেন এই নিয়ে যমরাজ মহাচিন্তায়, সমাধান হিসাবে বললেন দেখো তোমার পাপ পুণ্য সমান সমান এখন তুমিই বেছে নাও তুমি স্বর্গে যাবে না নরকে যাবে। সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে ঐ লোক দুইটাই দেখে আসার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। যমরাজ তার লোকজন সহ ঐ ব্যক্তিকে পাঠালেন ঘুরে দেখে আসার জন্য। ঘুরতে ঘুরতে দেখল স্বর্গের দুয়ারে প্রহরীরা কড়া নিরাপত্তা দিয়ে একজন একজন করে ভিতরে প্রবেশ করাচ্ছে, পাশেই অন্য দরজায় কয়েকজন বসে তাস খেলছে দরজায় প্রচণ্ড ভিড়, লোকটি জানতে চাইলো এইখানে ঘটনা কী? প্রহরীরা তাস খেলছে এতো ভিড়! সাথে থাকা প্রহরীরা জানালো, এইটা বাঙালিদের স্বর্গের দরজা, পাহারা লাগে না। পরীক্ষা নিরীক্ষা ও লাগে না। লোকটি খুব খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, বাঙালিদের জন্য স্বর্গের দরজা খোলা? প্রহরী বললো, না। আইন সবার জন্যই সমান। কিন্তু এইখানে কেউ স্বর্গে ঢুকতে গেলে অন্যেরা টেনে ধরে নীচে গর্তে নরকে ফেলে দেয় কেউ ঢুকতেই পারে না। তাই প্রহরীরা বিরক্ত হয়ে এইখানে বসে তাস মারছে, আর দরজায় এই টানাটানি যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য