প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রণেশ মৈত্র | ১৩ অক্টোবর, ২০১৯
যে মাসটি আমরা অতিক্রম করে এলাম অর্থাৎ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ এবং যে মাসটি আমরা অতিক্রম করছি অক্টোবর তা ভয়ংকর। এই সময়কালে যা আমরা প্রত্যক্ষ করছি তা কল্পনাতীত সকল কল্পনাকে হার মানানো। এক কথায় মারাত্মক ও বীভৎস। দেখলাম প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে (তাঁর নির্দেশ কেন প্রয়োজন তা দুর্বোধ্য) বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এই দুই শীর্ষক নেতাকে হঠাৎ করেই ঐ সংগঠনের নিজ নিজ পদ থেকে পদচ্যুত করা হলো বিশাল অংকের চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজির চালানোর অভিযোগে।
আবার এটাও দুর্বোধ্য, অমন মারাত্মক ফৌজদারি অপরাধ করা সত্বেও তাদের বিরুদ্ধে আজও কোন থানায় কোন সুনির্দিষ্ট মামলা দায়ের হলো না বা তারা কেউ গ্রেপ্তারও হলো না। শুধুমাত্র জানা যায়, তাদের সয়-সম্পত্তি কি আছে না আছে তার খোঁজ খবর করা হচ্ছে।
এর পর দিন দুয়েক যেতে না যেতেই প্রধানমন্ত্রী বলে বসলেন, “ছাত্রলীগের পর এবার যুবলীগকে ধরা হবে।” আর যায় কোথা? আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তৎপর হলো, র্যাব অভিযান সুরু করলো কয়েকজন যুবলীগ নেতা গ্রেপ্তার হলো। সন্ধান মিললো তাদের আস্তানায় শতাধিক কোটি টাকার বাংলাদেশী মুদ্রা, হাজার হাজার মার্কিন ডলার, আইনি, বে-আইনি অস্ত্র, অসংখ্য মদের বোতল ইত্যাদি। আর আবিস্কার হলো ক্যাসিনোর-যার নাম আমি জীবনে এই প্রথম শুনলাম।
ক্যাসিনোতে জুয়া খেলে তারা নাকি দিনে রাতে কোটি কোটি টাকা আয় করতো যার সবটাই বে-আইনি।
মানুষ এগুলি দেখে বিস্মিত ও স্তম্ভিত। কীভাবে বিগত দশটি বছর ধরে প্রকাশ্যে দিবাভাগে ও রাত্রিকালে, রীতিমত সকল মহলের জ্ঞাতসারে, এমন অবৈধ কাজ করবারে বছরের পর বছর ধরে দলে দলে লিপ্ত থাকতে পারলো, বিন্দুমাত্র গোপনীয়তা রক্ষা না করলেও তাদের বিরুদ্ধে সামান্যতম আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হলো না।
কারণ যদি এটা হয়ে থাকে যে এর সাথে বহুসংখ্যক রুই-কাতলা জড়িত-বহু মন্ত্রী, এম.পি, পুলিশ কর্মকর্তা এবং অপরাপর নানা প্রভাবশালী মহল জড়িত তা হলে তো বলতেই হয় দুর্বলেরা অপরাধ করলে শাস্তি পাবে-সবলেরা নয়। দেশবাসী নিশ্চিতভাবে দেখতে চান আমাদের পেনাল কোডের কত নম্বর ধারায় এমন বৈষম্যমূলকভাবে আইনের ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া আছে। নতুবা ঐ সকল প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
আর যদি তেমন কোন বৈষম্যমূলকভাবে আইনের ব্যবহার করার কোন বিধান পেনাল কোডে না থেকে থাকে এবং পেনাল কোডের অবশ্য পালনীয়।
অবাক বিস্ময়ে দেখা গেল “কুখ্যাত যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটের বিস্তর অপরাধের খবর নানা সূত্র থেকে সংগ্রহ করে সংবাদপত্রগুলিতে প্রকাশিত হওয়া সত্বেও তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছিলোই না। তার হদিস সম্পর্কে কোন তথ্যও জানা যাচ্ছি না। সবাই ভাবছিলেন সম্রাট হয়তো কোন ফাঁকে দেশ থেকে অন্য কোথাও পালিয়ে গেছে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে।
এমন সময় হঠাৎই পাওয়া গেল তার গ্রেপ্তারের খবর তাও প্রধানমন্ত্রী বিদেশ সফর শেষে দেশে ফেরার দিন কয়েক পর। অনুমান করতে আদৌ কোন কষ্ট হয় না যে, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে কড়া নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তার করার সাহস কেউ পাননি যদিও, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং বলেছিলেন যে, “সম্রাট গোয়েন্দা নজরদারিতে আছে”। যদি তাই হয় তবে দীর্ঘ তিন সপ্তাহ গ্রেপ্তার করা হলো না কেন? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই সংগত প্রশ্নটির জবাব না দিয়ে নিশ্চুপ থাকতে পারেন না।
সম্রাটকে ধরা হলো কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে এক জামায়াতে ইসলামীর নেতার বাড়ি থেকে মস্ত বড় এক অভিযান চালিয়ে সম্রাটের সকল অপকর্মের এক সহযোগী আরমান সহ। যুবলীগ নেতা আশ্রয় নেন এক জামায়াতে ইসলামীর নেতার বাড়িতে। সেখানে নিরাপত্তা নিশ্চিত ভেবে জামায়াত নেতা ও যুবলীগ নেতাদেরকে আশ্রয় দেন, নিরাপত্তা দেন, নিশ্চিতই বিপুল পরিমাণ প্রাপ্তিযোগের কল্যাণে। এতে বুঝি ঐ জামায়াত নেতার যথেষ্ট ‘সওয়াব’ও হয়।
আবার যুবলীগ নেতারা-যারা দিবারাত্র “বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক” বলে গলা ফাটাতে কসুর করেন না তারা দিব্যি জামায়াত নেতার বাড়িতে এভাবে বঙ্গবন্ধুর সুমহান আদর্শের প্রতি ইচ্ছাকৃত অবমাননা এবং তার দ্বারা মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা আর কত? তথ্য হলো, এই সম্রাটই আওয়ামী লীগ, যুবলীগের বড় বড় সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর নামে ও জয় বাংলা বলে স্লোগান দিয়ে লাখো লোক সরবরাহ করে নেতাদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সেভাবেই যুবলীগ নেতৃত্বে পদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। কী কলঙ্কজনক ঘটনাবলীই না ঘটছে এবং প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে মানুষকে।
সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটলো বুয়েটে। ভয়াবহ নৃশংস ঘটনাই বটে এবং তা ঘটালো ছাত্রলীগ নেতারা। এ ব্যাপারে একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র তাদের ৮ অক্টোবর তারিখে প্রকাশিত সংখ্যায় লিখেছে: কোন কিছুতেই থামছে না ছাত্রলীগ, চাঁদাবাজি আর নির্মাণকাজ থেকে কমিশন। বে-আইনি ভাবে চাঁদার দাবিসহ নানা অভিযোগের প্রমাণ পেয়ে সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ক্যাসিনো, জুয়া আর অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে যুবলীগ, কৃষকলীগ সহ অন্য সহযোগী সংগঠনের নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করলো ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।
প্রায় ১১ বছর ধরে ছাত্রলীগ মূলত: আলোচনায় এসেছে হত্যা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই কিংবা টেন্ডারবাজির কারণে। গত রবিবার রাতে একইভাবে মেধাবী শিক্ষার্থী আবরাবকে হত্যা করে আবারও শিরোনামে এলো ছাত্রলীগ। ভাল কাজের জন্য ছাত্রলীগ গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে এমন নজীর নিকট অতীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির অতীতকালের সংগ্রামের বিষয়টি মুক্তিযুদ্ধের আগে ও যুদ্ধ চলাকালে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে।
প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বহুল প্রচারিত ঐ পত্রিকাটিকে বলেন, ফেসবুকে কোন একটা মত প্রকাশের কারণে বুয়েটের একজন শিক্ষার্থীকে মেরে ফেলা হয়ে থাকলে তা খুবই হতাশাজনক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকে, তা হলে আর কী বাকি থাকলো? তাঁর মতে ছাত্রলীগ এখন যা করছে এটা কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ঠিকাদারি কাজ থেকে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্যদের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হচ্ছে অন্যদিকে ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িতরা নৃশসংতা করছে। আমরা তো অন্ধকারেই আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি। এভাবে তো চলতে পারে না।
আওয়ামী লীগের নেতাদের একটি অংশ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষুব্ধ। প্রকাশ্যেই তাঁরা তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক অনুষ্ঠানে তাদেরকে সতর্ক করেছেন। কিন্তু ছাত্রলীগ ও যুবলীগের এই জাতীয় কর্মকাণ্ড তাদের বন্ধ হয় নি।
২০০৯ সালে এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে কয়েকটি নিষ্ঠুর ও নৃশংস ঘটনর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগের নাম। এক হিসাবে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ছাত্র লীগের নিজেদের কোন্দলে নিহত হন ৩৯ জন। আর এই সময়ে ছাত্রলীগের হাতে প্রাণ হারান অন্য সংগঠনের ১৫ জন।
সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোন কাজে ছাত্রলীগকে খুঁজে পাওয়া না গেলেও বারবার তাদের ন্যায্য আন্দোলনে হামলা চালিয়েছে সংগঠনটির কর্মীরা। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে পরিচালিত জনপ্রিয় আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধোর করার অসংখ্য অভিযোগ তাদের বিরুদ্ধে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি নূরুল হকের উপর ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অন্তত: সাতবার হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ।
আরও অসংখ্য অভিযোগ তথ্য প্রমাণ সহ হাজির করা যায় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। মূল দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সুযোগের অপব্যবহার করে তার মূলে “জয় বাংলা” স্লোগান দিয়ে তাই ভেবে দেখা প্রয়োজন, কেমন ধরণের ছাত্র-যুব-কৃষক সংগঠন কেমন ধরণের সহযোগী বা অঙ্গ সংগঠনের প্রয়োজন দেশের রাজনীতির স্বার্থে। এ ভাবনাকে উপেক্ষা করার আর সময় নেই। ইতোমধ্যেই অনেক বিলম্ব ঘটে গেছে।
বিভাগোত্তর এদেশের রাজনীতি, আন্দোলন, সংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ, বিজয়, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ যাদের অকুতোভয় সংগ্রাম ও অবদানে সমৃদ্ধ ছাত্রলীগ-যুবলীগ তাদের মধ্যে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকলেও স্বৈরাচার পতনের পরবর্তী কাল থেকে তাদের যে অবক্ষয় ঘটেছে তা দেশে সমগ্র রাজনীতিকে কলুষিত করে ফেলেছে।
ছাত্রলীগ, যুবলীগ, কৃষক লীগ বা তাদের মতো সংগঠনের অস্তিত্বের কতটুকু কীভাবে প্রয়োজন তাও ভাবা দরকার। জরুরী ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়াও অপরিহার্য। উল্টোপথ যে পথে হাঁটছে বাংলাদেশ, সেটি বড্ড ক্ষতিকর।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য