আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

স্মৃতিতে পাবনায় বাষট্টির দাঙ্গা ও তার রিপোর্টিং

রণেশ মৈত্র  

যদিও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরে, ১৯৫৩ সালে পাবনা শহরে বসে সাংবাদিকতা শুরু করি এবং আজও ঐ জগতের সাথে সংশ্লিষ্ট আছি-তবু গোটা পাকিস্তান আমলের সাংবাদিকতা আমার আজকের এই নিবন্ধের বিষয় নয়। লিখতে বসেছি একটি বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৬২ সালের সাংবাদিকতায় একটি বেদনার্ত ঘটনাকে নিয়ে।

১৯৬২ সাল। পাকিস্তান তখন সামরিক শাসনের যাঁতাকলে। রাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ। সাংবাদিকতার বা সংবাদ পত্রের স্বাধীনতার লেশ মাত্র ছিল না। বস্তুত সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে সকল সংবাদপত্রই তখন কার্যত সরকারি প্রেস রিলিজ কেন্দ্রিক অথবা সরকারি ছাড়পত্র নিয়ে প্রতিদিন সকালে আত্মপ্রকাশ করতো। পত্রিকাগুলিকে প্রকাশিত খবর, মন্তব্য, সম্পাদকীয় সব কিছুর মাধ্যমেই দেখাতে হতো দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে, বাজারে পণ্য সরবরাহে ঢল নেমেছে, মানুষের মধ্যে খুশির বন্যা বইছে, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে, উৎপাদনের প্রাচুর্যে দেশ ভাসছে---ইত্যাদি।

শিক্ষা-দীক্ষায়, কৃষিতে শিল্পে আমদানি রপ্তানি উন্নয়ন অগ্রগতির খবর গুরুত্ব সহকারে সকল পত্রিকার পাতায় পাতায় মূর্ত করে তোলা ছিল শাসকগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষিত । যদিও মানুষের কাছে চিত্রটি সম্পূর্ণ বিপরীত হিসেবেই বিবেচিত হতো। ফলে পত্রিকাগুলি হারাত তাদের পাঠক-প্রিয়তা। একমাত্র ‘ইত্তেফাক’ তার বলিষ্ঠ “রাজনৈতিক মঞ্চ”, যা লিখতেন স্বয়ং তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, প্রকাশ করে তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠতে পেরেছিলেন। আইন বাঁচিয়ে অসাধারণ দৃঢ়তার সাথে শ্রদ্ধেয় মানিকভাই যে “রাজনৈতিক মঞ্চ” নিরলসভাবে লিখেছেন, সহজ, সরল সাবলীল ভাষায় তা তুলনাহীন। আর সে কারণেই সংবাদপত্রের জনপ্রিয়তা ও পাঠক-প্রিয়তার ধস নামার ঐ যুগেও ইত্তেফাক পেতে পেরেছিল বিপুল প্রচার। গ্রাহক-গ্রাহিকার সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে যেত সমগ্র পূর্ব বাংলায়।

সেই ১৯৬২ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে (ফেব্রুয়ারিতেও হতে পারে ঠিকমত স্মরণে নেই), পশ্চিম বাংলার মালদহে অকস্মাৎ ঘটে যায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, হিন্দুরাই ছিলেন আক্রমণকারী-বেশ বড় সংখ্যক মুসলিম ঐ দাঙ্গায় প্রাণ হারান।
এই খবর রেডিও পাকিস্তানে এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রসমূহে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। খবরটি সত্য হলেও প্রচার প্রচারণা যেভাবে হয় তাতে মনে হতো গণমাধ্যমগুলি যেন উসকানিদাতার ভূমিকায় নেমেছে। সংযতভাবে তা প্রচার করতো ইত্তেফাক ও সংবাদ এই দুটি মাত্র পত্রিকা।

জন দাবির মুখে পড়ে সামরিক শাসক জেনারেল আইউব খান পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেন তবে সেই নির্বাচনে ভোটার হওয়ার সুযোগ পেলেন তাঁর প্রিয় মৌলিক গণতন্ত্রের সুবাদে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর ও চেয়ারম্যানরা।

তৎকালীন পাবনার দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিলেন যদিও কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত ছিল ঐ নির্বাচন বর্জনের। আরও কোন কোন জেলায় (সংখ্যায় খুবই কম) দল দুটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। মূল প্রতিদ্বন্দ্বী সরকার সমর্থিত কনভেনশন মুসলিম লীগ।

পাবনাতে মুসলিম লীগের প্রার্থী হয়েছিলেন পাবনার ভূট্টা আন্দোলনকারীদের উপর গুলি চালানো ক্যাপ্টেন আসগর হোসেন জায়েদি, আওয়ামী লীগের আমজাদ হোসেন ও ন্যাপের মির্জা আবদুল আউয়াল। সিরাজগঞ্জ থেকেও ন্যাপের প্রার্থী ছিলেন সাইফুল ইসলাম। সিরাজগঞ্জ তখন পাবনা জেলার একটি মহকুমা।

আমি ছিলাম আবদুল আউয়ালের পক্ষে কর্মী। পাবনা টাউন হলে স্থাপিত নির্বাচনী বুথে ছিলাম পোলিং এজেন্ট হিসেবে কর্মরত প্রায় সারাটি দিন। বিকেল ৪ টায় ভোট গ্রহণ শেষ হলে বেরিয়ে এসে ভাসানী ন্যাপ নেতা শহীদ আমলেন্দু দাক্ষীর চেম্বারে। ধীরে ধীরে সেখানে নিত্যদিনের মতো চায়ের আড্ডা জমে উঠলো। ভোটার যেহেতু মৌলিক গণতন্ত্রের সদস্যরা তাই প্রতি নির্বাচনী আসনেই ভোটার সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত ছিল। সে কারণে ভোট গণনাও সন্ধ্যারাতেই শেষ হয়ে গেলে দেখা গেল আওয়ামী লীগের আমজাদ হোসেন সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন, ন্যাপ প্রার্থী মীর্জা আবদুল আউয়াল দ্বিতীয় এবং সরকার সমর্থিত মুসলিম লীগ প্রার্থী ক্যাপ্টেন আসগর হোসেন জায়েদী পেয়েছেন সর্বনিম্ন ভোট। তবে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ছিল খুবই কম। তখন ন্যাপ ছিল ঐক্যবদ্ধ কোন বিভাজন তখনও হয় নি ঐতিহ্যবাহী ঐ দলে।

চায়ের আড্ডায় ইতোমধ্যে আরও অনেক ন্যাপ নেতা ও শুভানুধ্যায়ীরা সমবেত হয়েছেন। ডা. দাক্ষীর চেম্বারের বিপরীত দিকে ছিল রমজানের ওয়েসাইড রেস্টুরেন্ট। রমজান চা সরবরাহ করে চলেছেন ক্লান্তিহীনভাবে। ভয় কি? চায়ের দাম তো দেবেন ডা. দাক্ষী। এ কাজটি তিনি বছরের পর বছর ধরে ৩৬৫ দিনই করেছেন।

হঠাৎ করেই সেখানে ঝড়ের বেগে এলেন তৎকালীন পাবনা জেলা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সম্পাদক প্রয়াত মীজানুর রহমান। পরনে একটি লুঙ্গি ও স্যান্ডো গেঞ্জি। চোখে মুখে উদ্বেগের ছাপ। মীজানুর রহমান ছিলেন চাটমোহর কেন্দ্রে ন্যাপের প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট।

মীজানুর রহমান ঢুকেই বললেন, রণেশদা, চলেন আপনার বাসায়। ঐ এলাকা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। সেখান থেকে বৌদি, মাসীমা ও অন্যান্যদেরকে কোন নিরাপদ স্থানে পৌঁছাতে হবে।

উদ্বিগ্নকণ্ঠে সবাই বলে উঠলেন, কী ব্যাপার মীজানুর, রণেশদার পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সরাতে হবে কেন? মীজানুর রহমান বলে উঠলেন,চাটমোহর থেকে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন শেষে সন্ধ্যার আগেই পাবনাতে ফিরে গোসল করে খেতে বসেছি।
এক মুঠ মুখে পুরতেই বাড়ির কাজের মেয়েটি বলে উঠলো, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তাড়াতাড়ি? কেন? কী ব্যাপার? উত্তরে কাজের মেয়েটি বললো এখনই ‘গণ্ডগোল’ শুরু হবে। কিসের গণ্ডগোল জিজ্ঞেস করলেই মেয়েটি বললো আমাদের পাড়া কেষ্টপুরে দেখে এলাম, দা, বটি ও অন্যান্য অস্ত্রপাতি হাতে নিয়ে সকলে জড়ো হচ্ছে মসজিদের সামনে। তারা হিন্দুদের মেরে ফেলবে। এই শুনেই, মীজানুর বললেন, ভাতের দ্বিতীয় গ্রাস মুখে না দিয়ে অমনি এলাম রণেশদার কাছে। তাঁর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

সবাই উদ্বেগকুল হয়ে পরস্পরকে জিজ্ঞেস করলেন, কী করা যায়? নিরাপদ আশ্রয় কোথায় পাওয়া যাবে? ডা. দাক্ষী বলে ফেললেন, “মীজানুর, আনোয়ার, আনসার, ইদরিস (অধ্যাপক) তোমরা গিয়ে সবাইকে এখুনি আমার বাসায় নিয়ে এসো। এ বাসা খুবই নিরাপদ। সবাই রাজি হয়ে সকলে মিলে তৎক্ষণাৎ রওনা হয়ে গেলাম। বাসায় এসে দেখি একটি হ্যারিকেন জ্বালিয়ে দুটি শিশু সন্তান নিয়ে পূরবী বসে বসে চোখের জল ফেলছেন। আমাদের গলার আওয়াজে দরজা খুলতেই ওরা বললো বৌদি, আমাদের সাথে চলুন। এক কাপড়েই তৎক্ষণাৎ রওনা দিয়ে সবাই পৌঁছানো গেল ডা. দাক্ষীর দোতলা বাসায়। সেখানে দাক্ষী এবং তাঁর স্ত্রী থাকেন। পূরবী ও সন্তানদের বৌদির রুমে রেখে সবাই এসে বসলে দাক্ষী বলে উঠলেন, তোমরা সবাই রাত্রিটা এখানেই থাকো। এখানেই খাবে-রাতটা সকলে মিলে জেগে পাহারা দেওয়া যাবে।

সাংবাদিক আনোয়ার এবং ডাক্তার দাক্ষীর সহকারী আনসারুল থাকলেন বাদ বাকী নিজ নিজ বাসায় ফিরে গেলেনে স্ব স্ব এলাকাবাসীর নিরাপত্তা বিধানে সাধ্যমত ভূমিকা রাখার অভিপ্রায়ে।

আনোয়ার, আনসারুল ও আমি গিয়ে দাঁড়ালাম দোতলার ছদে। ঐ ছাদে উঠতেই চোখে পড়লো পাবনা শহরের পূর্ব-দক্ষিণ কোন থেকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। শহরের দোকানপাট ঝম ঝম করে ঊহৃ হয়ে যাচ্ছে। রিকশাওয়ালারা রুদ্ধশ্বাসে যাত্রীর তোয়াক্কা না করে নিজ নিজ বাড়ির দিকে ছুটছেন। ক্রমান্বয়ে পাবনা শহরটি যেন বিরান একটি শহরে পরিণত হতে চলেছে।

আমরা তিনজন, আনোয়ার, আনছারুল ও আমি ছাদে একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখছি আগুন পূর্ব-দক্ষিণ কোণ থেকে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ থেকে পশ্চিমে ইছামতী নদীর তীর ঘেঁষে দাউ দাউ করে ছড়িয়ে পড়ছে। মহাশূন্য থেকে ভেসে আসছে অসহায় মানুষের আর্ত চীৎকার। কিন্তু আমরাও অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে সব দেখছি, শুনছি কিন্তু কিছু করতে পারছি না।

রাতভর রাধানগর এলাকা থেকে এক প্রভাবশালী পরিবহন ব্যবসায়ীকে দেখা গেল ট্রাকে করে কোমরে মালকোঁচা মারা, গামছা দিয়ে কোমর জড়ানো মশাল হাতে “নারায়ে তকবির” স্লোগানে দিগবিগিক কাঁপিয়ে ছুটছে দফায় দফায় পাবনা শহরের প্রধান সড়ক দিয়ে। পুলিশ লাঠি হাতে দু’একজন করে এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে। দুর্বৃত্তবাহী ট্রাককে তারা আদৌ বাধা দিচ্ছে না। ভাবে মনে হচ্ছিল ঐ দুর্বৃত্তদেরকেই যেন তারা নীরবে নিরাপত্তা বিধান করছিল।

হঠাৎ করে রাত একটার দিকে দেখা গেল এক রিকসার সাথে মাইক বেঁধে একজন পুলিশ শহরে অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারী ঘোষণা দিয়ে গেলেন। আবার তারপর পরই ট্রাকে করে কয়েক দফা মশাল হাতে দুর্বৃত্ত বাহিনীকে নানা জায়গায় রেখে আসতেও দেখা গেল। না, পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের কোন অভিযোগ পরবর্তীকালে আনে নি বা তাদের ঐ চলাচলে বাধাও দেয় নি।

আমাদের কারও সে রাতে খাওয়া নেই ঘুমও নেই। শুধুই যেন নিজেদেরকে পাহারা দেওয়া অন্যের ব্যাপারে অসহায়ত্বের বেদনায় ভোগা। এভাবেই কাটলো সেই কালো রাতটি। ডাক্তার দাক্ষীর বিশাল বপু হওয়াতে তাঁকে আমরা উপরে উঠতে দিইনি। সারা বাড়িতে আলোও জ্বালাতে দেই নি। তাই নিঝুম অন্ধকারের নীরবতার মধ্যেই যথাসময়ে প্রভাত হলো।

এবারে আমাদেরও নীচে নামার পালা। নেমে দেখি সবাই জেগে আছেন। কারওই খাওয়া-দাওয়া নেই। কারও মুখে কোন শব্দও নেই। বললাম, এক-পেয়ালা করে চা খেয়ে আমরা আগে দেখে আসব মাকে ও আমার ছোট ভাই পরেশকে। এ দু’জনই পূরবীদেরকে আনার সময় বাসায় অনুপস্থিত দেখেছিলাম। তবে জানতাম, মা চাকীদের দালান বাড়িতে আছেন-তাই সেখানেই আগে গিয়ে মাকে প্রণাম জানালাম তিনজনই। বললাম, আমরা যেখানে আছি-পরে এসে তোমাকে সেখানেই নিয়ে যাব। আগে পরেশকে খুঁজে বের করি এবং আমাদের বাসা লুটপাট হলো কি না দেখি।

নিকটেই আমাদের বাসা। গিয়ে দেখি ঢুকবার ঘরের দরজার খিল ভাঙা। দুর্বৃত্তরা ঠিকই এসেছিল কিন্তু লোকজনের কোন সাড়া না পেয়ে খালি হাতেই চলে যায়। লুট তরাজ হয় নি আমাদের বাসায়।

অত:পর পরেশের খবর পেলাম। দাঙ্গা শুরু হওয়ার সময় তার এক মুসলিম বন্ধুর দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। কিন্তু বন্ধুটি যেই টের পেল ব্যাপারটা কী ঘটতে যাচ্ছে-তখন পরেশকে রেখে আলো নিভিয়ে দিয়ে বাহির থেকে দরজায় তালা মেরে বাসায় চলে যায়। বন্ধুটি পরেশকে বলে গেল, কোন শব্দ করো না আলোও জেল না। প্রয়োজনে পানি খেও পানির জগ থেকে। পরে আমি এসে তোমার খাবার দিয়ে যাব-তবে সারারাত তোমাকে এভাবেই থাকতে হবে ঘুম পেলে বেঞ্চের উপর শুয়ে ঘুমিও। পরেশও বাঁচলো এভাবে।

পরদিন বেলা ১০ টা। কিন্তু শহরে কোন লোকজন তেমন একটা নেই। আমরা ঘুরছি তথ্য সংগ্রহ করতে। জানতে পারলাম রাতে নিজ নিজ বাড়িতেই ৩১ জন হিন্দুকে খুন করা হয়েছে। কয়েক হাজার বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। লুট পাটও হয়েছে বিস্তর। নিহতদের নাম ধামও সংগ্রহ করেছিলাম। দু’তিন জন শিক্ষক ও একজন প্রভাবশালী আইনজীবী এবং বাদ-বাকী প্রায় সবাই ছিলেন ব্যবসায়ী।

বিকেলে এই তথ্যগুলি এবং আগের রাতের ঘটনাবলী লিখে প্রেস টেলিগ্রাম করলাম সংবাদ ও মর্নিং নিউজে। পরদিন পত্রিকা এলে দেখি খবরটা কোথাও নেই। টেলিগ্রাম অফিসে গিয়ে ব্যাপারটা জানতে পারলাম যে ডিএসবি টেলিগ্রামগুলি আটকে দিয়েছে।

পরদিন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে টাউন হলের অভ্যন্তরে একটি সভা ডাকা হয় শহরের শান্তিরক্ষার জন্য একটি সরকারি বেসরকারি ব্যক্তি নিয়ে কমিটি গঠনের লক্ষ্যে। জেলা প্রশাসক আমাকেও ডেকেছিলেন ঐ সভায়। গেলাম-ঢুকেই বেরিয়ে এলাম। জেলা প্রশাসক জিজ্ঞেস করলেন, ফিরে যাচ্ছেন কেন? বললাম, প্রতিবাদে। কারণ, দেখেছি গতরাতে যে ব্যক্তি ট্রাকে করে মশাল হাতে গুণ্ডা সরবরাহ করেছে সারারাত তাকেও দেখছি এখানে। যে এস.পি.ওসি. শহর জুড়ে অগ্নিসংযোগ হত্যা লুণ্ঠন প্রভৃতি ঘটে যাওয়া সত্বেও এবং এমন কি, যে এস.পি.ওসি ১৪৪ ধারা প্রকাশ্যে ভঙ্গ করা সত্বেও গুণ্ডা সরবরাহে বিন্দুমাত্র বাধা দিলেন না বা কাউকে গ্রেপ্তার পর্যন্ত করলেন না তাঁদের সাথে বসে শান্তি কমিটি গঠন করতে রাজি নই।

বেরিয়ে এসে আমার প্রতিবাদের কথা উল্লেখ না করে জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে এবং পুলিশ কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট জনদের উপস্থিতিতে দাঙ্গা বিধ্বস্ত পাবনা শহরে শান্তিরক্ষায় একটি কমিটি গঠিত হয়েছে এবং কমিটির পক্ষ থেকে সকলকে আহ্বান জানান হয়েছে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য। এই জাতীয় একটি প্রেস টেলিগ্রাম পরদিনও পাঠালাম। ফল দাঁড়ালো একই। টেলিগ্রামটি যেতে দেওয়া হলো না। কোন পত্রিকায় তা প্রকাশও হতে পারল না।

পরের দিন টেলিগ্রাম করলাম শহরের দোকানপাট খুলছে না, গাড়ি ঘোড়া চলছে না, গ্রাম থেকে শাকসবজি তরি-তরকারী মাছ মাংস আসছে না, স্কুল কলেজ চলছে না-শিশুদের খাদ্য দুধও পাওয়া যাচ্ছে না পাবনা শহরে। এভাবে লিখে পুনরায় প্রেস টেলিগ্রাম করলাম-কিন্তু তাও গেল না ছাপাও হলো না কোন পত্রিকায়।

দিন কয়েকের মধ্যে পাবনাতে বিদায়ী সাক্ষাতকারে এলেন পাঞ্জাবে বদলির আদেশ প্রাপ্ত গভর্নর মেজর জেনারেল আজম খান। পাবনার ঘটনা জানতে পেরে তিনি সারা শহর ঘুরে বেড়িয়ে পোড়া দোকান-পাট, বাড়িঘর স্বচক্ষে দেখলেন অশ্রুজল ভরা চোখে। অত:পর একটি জমায়েতে প্রশাসনকে নির্দেশ দিলেন তিনদিনের মধ্যে দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার করে বিচারামলে আনতে। তিনি সমগ্র প্রদেশের সকল জেলায় বিদায়ী সাক্ষাতে বেরিয়েছিলেন।

গভর্নর চলে যাবার পর শহরে পুলিশি তৎপরতা শুরু হলো। পরদিন এসে গেল ইপিআর বাহিনীর এক বিশাল বহর। শুরু হয়ে গেল গণ-গ্রেপ্তার। নির্দোষ মানুষেরাই গ্রেপ্তার হতে থাকলেন-বাড়ল আতংক। কিন্তু গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ৫৪ ধারায়। কয়দিন পর সবাই জামিনে মুক্তি পেল। মামলা চালানো হলো না। অপমৃত্যুর গহ্বরে চলে গেল মামলাগুলি।

যা হোক গভর্নর আজম খানের সফর পাবনা শহর প্রদক্ষিণ এবং তাঁর বক্তব্য দিয়ে ঐ দিনই পাঠালাম আরও একটি টেলিগ্রাম। মর্নিং নিউজ ও সংবাদে পাঠালাম আমি এবং অন্যান্য পত্রিকায় সেগুলির জেলা প্রতিনিধিরা। কিন্তু গভর্নরের সফর এবং বক্তব্য আলোর মুখ দেখলো না না সে টেলিগ্রামগুলিও আটকে দেওয়া হয়েছিল।

ভাবছি কি করা যায়। সাংবাদিকতা এত দীর্ঘদিন করেও এমন একটি খবর প্রকাশ করতে পারছি না। মানুষ তো জানতেই পারলো না কেন এত বড় ঘটনার খবর প্রকাশিত হলো না কোন একটি পত্রিকাও। তাঁরা তো জানছেন না কেন ছাপা হচ্ছে না। ফলে সাংবাদিক হিসেবে ভাবমূর্তি রক্ষাই বা করি কি করে?

অকস্মাৎ একটা বুদ্ধি বের করলাম। দাঙ্গা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি উল্লেখ না করে শহরে হঠাৎ কয়েক দিন যাবত অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, গাড়ি ঘোড়া সাতদিন হলো চলছে না-দোকানপাট খুলছে না-স্কুল কলেজ বন্ধ ইত্যাদি সবিস্তারে বর্ণনা দিয়ে ‘সংবাদ’ এর তৎকালীন বার্তা-সম্পাদক তোয়াব খানের নামে একটি খামে পুরে “সংবাদ” এর বংশাল রোড কার্যালয়ের ঠিকানায় বুক পোষ্টে পাঠানোর জন্য লোক মারফত শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরবর্তী টেবুনিয়া পোষ্ট অফিস থেকে পোষ্ট করার ব্যবস্থা করলাম।

দিন সাতেক পরে সংবাদে তিন কলাম শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠায় আমার নাম দিয়ে প্রকাশিত হলো খবরটি। হট কেকের মত সেদিন ‘সংবাদ’ বিপুল সংখ্যায় বিক্রি হলো। কিন্তু অনেকে ভয় পেয়ে গেলেন আমি গ্রেপ্তার হয়ে যেতে পারি এই আশংকায়। অবশ্য তেমন কিছু ঘটাতে সম্ভবত পুলিশ সাহস পেলো না দেশের সাংবাদিক মহলে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে এই আশংকায়।

এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা পাকিস্তান আমলের সাংবাদিকতার।

রণেশ মৈত্র, লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ