প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ২৩ জুলাই, ২০১৫
অনেকদিন পরে ঈদের ছুটির একটা দিন একটু নিজের মতো কাটাতে চাইছিলেন প্রধানমন্ত্রী। একটু মনের মত সময় কাটানো। মনটা একটু ফুরফুরে। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম অদম্য হয়ে উঠেছে। কোন দলই আর ঠিক পেরে উঠছে না এই টিমটির সঙ্গে। মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে একটু মুশফিকুর রহিমকে ফোন করেন। মুশফিক প্রধানমন্ত্রীর ফোন পেয়ে খুব খুশী হয়। কিন্তু আজটা মনটা একটু খারাপ; তাই ঠিক সেই উচ্ছ্বাসে কথা বলতে পারেনা।
প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করেন, কী হয়েছে মুশফিক; তোমার মন খারাপ নাকি!
--না মানে কিছু হয়নি।
--কিছুতো হয়েছেই।
মুশফিক এতো ছোটখাট বিষয় জানাতে চায়না। তবু বাধ্য হয়ে বলে, ফেসবুকে আমার ওয়াইফের সঙ্গে আমার একটা ছবিতে কিছু লোকের কোন অনুভূতি যে আঘাতপ্রাপ্ত হলো জানিনা; একগাদা গালি দিয়ে চলে গেলো।
প্রধানমন্ত্রী বুঝিয়ে বলেন, লোকের অনুভূতির তো সীমা পরিসীমা নেই। তুমি এ নিয়ে মন খারাপ কোরোনা বাবা। মন দিয়ে খেলো। আনন্দে খেলো।
প্রধানমন্ত্রীর খুব দুঃশ্চিন্তা হয় কিছু মানুষের আচার আচরণ নিয়ে। এগুলো মেরামত না করলেতো আসল কাজটাই হবে না। শুধু টাকা-পয়সা উপার্জন করে লাভ নেই, জাতিগত আচার-আচরণের সুনামটাও তো থাকা চাই।
মনটাকে একটু সুন্দর কোন চিন্তায় ব্যস্ত রাখতে তিনি একটা ক্যানভাসে পেইন্টিং করতে শুরু করেন। ছোট বেলায় দেখা দাদুবাড়ীর গ্রামটাকেই আঁকতে ইচ্ছা করে। শৈশবটাতে গিয়ে একটু বসত করে আসার মতো আনন্দ পাওয়া যায় তাতে।
হঠাত বিনা এপয়েনমেন্টে একজন রবীন্দ্রভক্ত আসেন। সৌজন্য বশতঃ প্রধানমন্ত্রীকে বসার ঘরে আসতে হয়।
--কী শিল্পী আজ কোন গান শোনাতে এলেন নাকি! হারমোনিয়ামটা কী আনাবো!
--আসলে খুব একটা গুরুতর প্রয়োজনেই আসা। রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে যাচ্ছে তাই সব এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। প্রত্যেকদিন আমার রবীন্দ্র অনুভূতিতে আঘাত লাগছে।
--রবীন্দ্র অনুভূতি মানে।
--মানে প্রধানমন্ত্রী আমার এই যে সারাজীবনের রবীন্দ্রভক্তি তা ক্রমে ক্রমে রবীন্দ্রনাথকে আমার সৃষ্টিকর্তা করে তুলেছে। এ আমার সৃষ্টিকর্তা অনুভূতিতে আঘাত।
--এটাতো খুব জটিল অনুভূতি; কিন্তু আমি তো আইন করে কারো গানের এক্সপেরিমেন্ট বন্ধ করতে পারিনা।
রবীন্দ্রভক্ত উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকারকে শুধু দিয়েই গেলাম, কিছু পেলাম না। এই সামান্য আবদার রাখলেন না।
প্রধানমন্ত্রী অনুরোধ করেন অন্ততঃ এককাপ চা খেয়ে যেতে। কিন্তু রবীন্দ্রভক্ত ফোঁপাতে ফোঁপাতে বেরিয়ে যান।
প্রধানমন্ত্রী ঠিক বুঝতে পারেন না; উনার হাসা উচিত না কাঁদা উচিত।
আবার পেইন্টিং আঁকতে ফিরে যান। স্মৃতির কুয়াশা ফুঁড়ে বার বার একটি নদী এসে যেন বলে, আমাকে আঁকো। গুন গুন করে একটা রবীন্দ্র সংগীত গাইতে গাইতে নদীটাকে আঁকতে থাকেন আপনমনে। হঠাত মনে হয় সুর ঠিকঠাক না হলে তো আবার রবীন্দ্র অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হয়ে যায়।
এরি মাঝে এক নজরুল ভক্ত এসে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী তাকে সময় দিতে আবার বসার ঘরে আসেন। গান শুনতে চাননা। কারণ সুনিশ্চিত এই নজরুলভক্তও কোন অনুভূতি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে এসেছেন। এবং বিষয়টি মিলেও যায়।
--মাননীয়া মন্ত্রী নজরুল এদেশে আজ অবহেলিত। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় দায়সারা কাজ করছে। এতে আমার নজরুল অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে।
--সাধ্যমত আয়োজন তো হয়ই। কিন্তু আগে যেমন পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো এখন সে চর্চাটা কোথায়!
--প্রধানমন্ত্রী আপনার বাবা নজরুলকে ভালোবেসে এদেশে নিয়ে এসেছিলেন, আর আপনি তার জন্য কিছুই করছেন না; এতে আমার ‘শেখের বেটি’ অনুভূতিতেও আঘাত লেগেছে।
প্রধানমন্ত্রী তাজ্জব বনে যান। এতো অনুভূতির নতুন কনসেপ্ট। জানতে চান, এটা আবার কী ধরণের অনুভূতি!
নজরুল ভক্ত বলেন, শেখ মুজিবের প্রতি যে ভালোবাসা তা তাঁর কন্যা কতৃক আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া আর কী!
--কথায় কথায় এতো আঘাত পেলে কী চলে! একটু চা-নাশতা খেয়ে নিন। আমরা সাধ্যমত নজরুল-চর্চার চেষ্টা করবো।
--এভাবে হয়না আপা।
ফোঁপাতে ফোঁপাতে বেরিয়ে যান নজরুল ভক্ত।
প্রধানমন্ত্রী মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। এরি মাঝে এসে পড়ে জাতীয় হিজাবী এসোসিয়েশানের সভানেত্রী। সে ক্রোধে অগ্নিশর্মা।
--আপা আমার হিজাবানুভূতিতে আঘাত লেগেছে; কেন সর্বস্তরে হিজাব প্রচলন করছেন না!
--পোশাক ব্যাপারটা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। আপনাকে তো কেউ বাধা দিচ্ছে না হিজাব পরতে।
এরমধ্যে জাতীয় স্কার্ট এসোসিয়েশানের সভানেত্রী চলে আসে ক্যাটওয়াক করতে করতে।
--আপা আমার স্কার্টানুভূতিতে আঘাত লেগেছে; ঐ হিজাব এসোসিয়েশান সভানেত্রী আমাকে নিয়ে যা-তা বলেছে। আমার নাকি দোজখে জায়গা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বোঝান, কে দোজখে যাবে কে বেহেশতে, সেটাতো আল্লাহই ঠিক করবেন। আমরা অতি ক্ষুদ্র।
দুই এসোসিয়েশানের সভানেত্রী ক্যাট ফাইট করতে করতে বেরিয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী ফিরে যান আঁকার ঘরে। স্মৃতির জোয়ার একটি নৌকা এঁকে দেয় শৈশবের প্রিয় নদীটিতে। ভাইবোনেরা মিলে নৌকা করে ঘোরার স্মৃতি এসে চোখ ঝাপসা করে দেয়। কান্না চেপে মনোযোগকে নিয়ে যান ক্যানভাসে।
অবিশ্বাসী দর্শনের একজন বুদ্ধিজীবী এসেছেন দেখা করতে। তাকে আঁকার ঘরেই নিয়ে আসতে অনুরোধ করেন একজনকে। ভদ্রলোক বিক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, আপনি কী বাংলাদেশকে সৌদী আরবে পরিণত করতে চান! একের পর এক নাস্তিক নিহত হচ্ছে, আপনি কিছুই করছেন না!
--বাংলাদেশ বাংলাদেশই থাকবে। কোন কিছুতে পরিণত হবার আশংকা নেই। আমি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখি। সাধ্যমত প্রতিটি হত্যাকান্ডের তদন্তের চেষ্টা করি। বিচারের কাজটা বিচার বিভাগের। আপনি শিক্ষিত মানুষ। আপনি জিও-পলিটিক্স বোঝেন। আজকের দিনে আইন-শৃংখলা রক্ষা করা বেশ কঠিন একটা চ্যালেঞ্জ সর্বত্রই।
--এসব আপনার রুটিন কথা প্রধানমন্ত্রী। আপনি আমাদের অবিশ্বাসের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছেন! আপনি আমাদের এড়িয়ে চলতে চান মোল্লাদের খুশী রাখতে।
--আমি কাউকে খুশী রাখতেই কারো অনুভূতিতে আঘাত দিইনা। আমি নিজে ধর্ম-কর্ম করি। ৭৫-এর অগাস্টে পুরো পরিবারের নির্মম হত্যাকান্ডের পর আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে শোক সইবার শক্তি চেয়েছি; একটা আশ্রয়ের জায়গা তিনি আমার। কিন্তু তাই বলে কোন অবিশ্বাসীর অনুভূতিতে আঘাত দেবো কেন! জীবন যার; সিদ্ধান্ত তার।
--আই এম নট কনভিন্সড।
বলেই গট করে বেরিয়ে যান নাস্তিক বুদ্ধিজীবী।
প্রধানমন্ত্রী আবার ফিরে যান স্মৃতির ক্যানভাসে। নদীর পাশ দিয়ে গিয়ে দিগন্তে মিশে যাওয়া একটা পথের ছবি আঁকেন; এই পথ দিয়ে হেঁটে বোশেখী মেলায় যাবার স্মৃতি পথটিকে মনের মাঝে আনন্দপথ করে তোলে। কিন্তু আনন্দ যে উনার ভাগ্যে নেই।
বসার ঘরে উপস্থিত আলেম সমাজ।
প্রধানমন্ত্রী আসতেই এক মওলানা লম্বা সালাম দিয়ে বলেন, মাননীয়া দেশতো কাফের আর নাস্তিকে ভইরা গ্যালো; আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি তো ক্ষতবিক্ষত। আপনি কিছুই করছেন না।
--সৌদী আরবে অন্য বিশ্বাসের মানুষকে কাফের বলা নিষিদ্ধ করে আইন হয়েছে; আমি তো তা-ও করছিনা।
মওলানা চুপসে গিয়ে আবার শক্তি সঞ্চয় করে বলে, এর পরিণাম ভালো হবে না প্রধানমন্ত্রী মহোদয়া; আপনি যদি আমাদের অনুভূতির সুরক্ষা না দেন আমরা ধর্মের হেফাজতের জন্য আবার শাপলা ক্ষেতে বসে পড়বো।
ইতোমধ্যে অনুভূতি শব্দটি তীব্র বিবমিষা তৈরী করে প্রধানমন্ত্রীর মনে। তবুও শান্তভাবে বলেন, আপনারা কথায় কথায় এরকম রেগে না গিয়ে যদি একটু সহিষ্ণু আচরণ করেন; তাহলে ধর্মের সুনাম হবে। আর আপনারা যদি হঠকারিতা করেন ধর্মের দুর্নাম হবে।
আলেম সমাজ মনোঃক্ষুণ্ণ হয়ে বেরিয়ে যান।
এরপর একদল তরুণ আসে। ডিজিটাল রাইজিং স্ল্যাং এসোসিয়েশানের তরুণরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তোলে। এরপর একজন একটু সাহস করে বলে, আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে ফেসবুকে কাজ করি। কিন্তু ফেইক আইডি বন্ধ করার আইন করে আমাদের মুক্তচিন্তা প্রকাশের সুযোগ বন্ধের চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে আমাদের ফেইক আইডি অনুভূতি আহত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফেইক আইডি অনুভূতি আবার কী জিনিস! মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চর্চায় ফেইক আইডি লাগবে ক্যানো!
তরুণদের সঙ্গে আসা প্রাক-বৃদ্ধা এক নারী অভিযোগ করে, গুজব ছড়ানো ছাগুদের জবাব দিতে আগে কত সুখে গালিগালাজ করতাম। আর এখন তা-ও বন্ধের ষড়যন্ত্র চলছে। আমার গালিগালাজ অনুভূতি আহত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী রীতিমত বিস্মিত, গালিগালাজের অনুভূতির কথা আগে কখনো শুনিনি। আর গুজবের জবাব মানুষ সত্য তথ্য দিয়ে দেয়, যুক্তি দিয়ে দেয়। গালিগালাজ করতে হবে কেন। এ খুব খারাপ অভ্যাস। আমাদের সোনার টুকরো ছেলে ক্রিকেটারগুলোকেও ফেসবুকে গালি দিয়ে চলে যায় লোকজন। না না এসব চলবে না।
ভগ্ন হৃদয়ে ফিরে যায় স্ল্যাং এসোসিয়েশান।
এবার প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন পেইন্টিং-এ আকাশের ছবি আঁকবেন। আধাবেলা চলে গেলো নানা অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ শুনে।
একজনকে ডেকে বলেন, কেউ এলে জিজ্ঞেস করে নিও কোন অনুভূতিতে আঘাত পাওয়ার অভিযোগ নিয়ে এসেছে কীনা! আজ আর অনুভূতির রোগী দেখবো না। অনুভূতিময় অতিথিকে মাথায় আইসব্যাগ দিয়ে কিছুক্ষণ বসিয়ে রেখে; চা-নাশতা খাইয়ে আরেকদিন আসতে বলো। আমি যাই একটা আকাশের ছবি আঁকি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য