প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ১৪ নভেম্বর, ২০১৯
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে। নেই নেই করেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের অর্থে পাবলিক স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে শিক্ষা দিয়েছে। আজ আমরা যে জীবন যাপন করছি; সেখানে যা-কিছু প্রাপ্তি; এ সমস্তটুকুই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অবদান।
এখন দেখার বিষয়; বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শিক্ষাদান প্রচেষ্টাকে আমরা কীভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছি।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে স্বাধীন করতে যে মুক্তিযোদ্ধারা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছিলেন; তাদেরকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে সম্মান ও সম্মানী দিতে। কিন্তু নব্যশিক্ষিত আমলা-নাগরিক সমাজ-রাজনীতির ক্যাডারেরা মুক্তিযোদ্ধাদের পদে পদে অপমান করেছে। পত্রিকার পাতায় আসা অপমানে অভিমানে মুক্তিযোদ্ধার আত্মহত্যার খবর; মৃত্যুর পর কথিত রাষ্ট্রীয় সম্মান না নেবার সংকল্প প্রকাশ; এসবই নব্য শিক্ষিত বাংলাদেশ সমাজের ব্যর্থ হবার ছবি।
মুক্তিযুদ্ধের পর গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা; নব্বুইয়ের গণ-অভ্যুত্থান। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ন্যুনতম গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে নব্বুই-এর যোদ্ধাদের অবদান অনন্য।
কিন্তু বাংলাদেশ সমাজ যেহেতু 'নতুন টাকার' চাবুকে দৌড়ে চলা উন্নয়নের ঘোড়া; এখানে ব্যবসায়ী নেতারা ক্রমে ক্রমে এতো উদ্ধত হয়ে উঠেছেন যে, নব্বুই-এর গণ-আন্দোলনের শহীদ নূর হোসেন সম্পর্কে 'মুখে যা আসে তা-ই বলা'র গ্রাম্য অভ্যাসে অত্যন্ত আপত্তিজনক মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির ব্যবসায়ী নেতা মশিউর রহমান রাঙ্গা।
এই রাঙ্গারা রাজনীতির মই পেয়ে; আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। নতুন টাকার আত্মবিশ্বাসে মানুষ স্থান- কাল-পাত্র ভুলে লুজ টক করে থাকেন। এটা হচ্ছে ভ্যাড়ভেড়ে গ্রাম্যতা। আর এই সমস্যা বাংলাদেশ সমাজে প্রবল। নব্বুই-এর গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছিলো; তার প্রতিনিধিত্বশীলতা ক্ষীণতর হয়ে এসেছে।
জাতীয় পার্টি-বিএনপি-আওয়ামী লীগ রাজনীতি থেকে রাজনীতিকদের উচ্ছেদ করে রাজনীতির জুয়াঘরে ব্যবসায়ীদের হাতে রাজদণ্ড তুলে দেয়ায় বাংলাদেশ সংস্কৃতির আলো নিভে গেছে। লাখপতি হয়ে লক্ষ বাতি জ্বালিয়ে সাফল্যের উদযাপন আর হেলিকপ্টারে চড়ে ওয়াজ-মেহেফিল করে বেড়ানোর স্থূল-সংস্কৃতির প্রকোপে; সত্তর ও আশির দশকের সাংস্কৃতিক আলো নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে।
এই নব্য ধনিক স্থূল-সমাজের স্তবগানে দলীয় ভিত্তিতে কিছু অর্ধশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীর আবির্ভাব ঘটেছে। বলা হয়ে থাকে প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শিষ্টাচার শিক্ষা।
কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপি ও ইসলামপন্থী যে ফাঁপা বুদ্ধিজীবী সমাজ তৈরি হয়েছে; তারা যে যার ইতিহাসের ন্যারেটিভ বিনির্মাণের প্রচেষ্টায় গালি দিয়ে আলোচনা শুরু করার সংস্কৃতি প্রচলন করেছে। এরা জাতীয় পার্টির লব্ধপ্রতিষ্ঠিত রাঙ্গার ভাষায় কথা বলে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই 'রাঙ্গা-ভাষা'-র কাটতি আছে।
লুঙ্গি-পাজামা খুলে জিনস-টিশার্ট-ব্লেজার-সৌদি ঝোলা পরার পরেই তারা অতি-আত্মবিশ্বাসী হয়ে সাধারণ মানুষকে পালা করে জাতীয়তাবাদ, দেশপ্রেম, ধর্ম ইত্যাদি শিক্ষা দিয়ে বেড়ায়। এই হিরো হীরালালেরা 'আইকন' হয়ে পড়ায় তাদের অনুকরণে অনেক তরুণ 'রাঙ্গা ভাষায়' গালি দিয়ে কথা বলাকে ট্রেন্ডি বলে মনে করে। বিশ্বের সব দেশের সামাজিক মাধ্যম ছাপিয়ে গালাগাল দূষণে শীর্ষস্থান দখল করেছে 'বাংলা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম'।
এই দূষিত সংস্কৃতির তালগাছদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে; তার চেনাজানা জগতটিই তার পৃথিবী। নিজের অভিজ্ঞতার বাইরের উদার জগতটি তাদের অজানা। পাতকুয়া চিন্তার ঘেরাটোপে অত্যন্ত উগ্র আর জেদি জীবন তাদের।
যে বাংলা-সংস্কৃতির পরতে পরতে সংগীত-নৃত্যের ঐতিহ্য; সেখানে ঢাকার লিটফেস্টে আসা বিদেশি অতিথিদের বাংলা লোক গানের সঙ্গে নাচের ভিডিও দেখে; কথিত উদার ও কট্টর মানুষেরা একই রকম তামাদি রক্ষণশীলতার আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে, এইসব নাচ আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই নয়। কেউ কেউ আরেকটু এগিয়ে টাইটস পরা বিদেশিনী অতিথির নাচ নিয়ে গ্রাম্য রগড় করে।
ভাবতে অবাক লাগে; ষাট-সত্তর-আশির দশকের বাংলাদেশ সমাজের সাংস্কৃতিক রেনেসাঁটি কীভাবে ছিনতাই হয়ে গিয়ে স্থূল-অর্ধশিক্ষিত-রাঙ্গাভাষার লোকেদের হাতে পড়লো! এখন দেশের তরুণ-তরুণীর অভিব্যক্তির স্বাধীনতা তো নেই-ই; এখানে বিদেশী অতিথি আমন্ত্রণ জানানোও বিপদ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্যাথলজি সেন্টারে তাদের নিয়ে যে রাঙ্গাভাষায় আলোচনা হয়; তা জানার পর; যে সংস্কৃতি সমৃদ্ধ সবুজ দ্বীপের মিথ শুনে তারা বাংলাদেশে এসেছিলেন; তাতে মালিন্য আসবে; আর তারা এমুখো হবেন বলে মনে হয় না।
প্রবৃদ্ধি-ব্যাংক রিজার্ভ-পরিসংখ্যানিক উন্নয়নের গর্বের ঢোল দিয়ে সাংস্কৃতিক দৈন্য কী ঢাকা যায়! সাংস্কৃতিক ঔদার্য আর সৌন্দর্য ছাড়া জাতিগঠন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অসম্পূর্ণ অবয়ব নিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন অত্যন্ত বেদনাবহ। এ নিয়ে ভাবা প্র্যাকটিস করার তাগিদ অনুভব করছি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য