আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বাংলাদেশের বিজয় দেখেছি শ্রমচঞ্চল মানুষের মুখমণ্ডলে

মাসকাওয়াথ আহসান  

দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক অঙ্গীকারে জন উন্নয়ন বিষয়টি অনুপস্থিত এমনটাই মনে হয়। নিয়মিত বিরতিতে ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করে; তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করলে এটা খুব স্পষ্ট হয়ে যায়। দেশদুটির অভ্যন্তরীণ রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ঢাকতে এই 'যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাটাকে' সাজানো নাটক বলেই মনে হয়।

সেইখানে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিপ্রত্যাশী রাষ্ট্র। এর রাষ্ট্রিক অঙ্গীকার উন্নয়ন। সে কারণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার কোন্দলপ্রিয় দেশগুলোর সঙ্গে হৈ হট্টগোলে জড়ায় না। যে কোন পরিস্থিতিকে খুব ঠাণ্ডা মাথায় মোকাবেলা করে।

বাংলাদেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রমী। তারা কখনো নিষ্ক্রিয় থাকে না। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ দেশের অর্থনীতির চাকাকে নিয়ত ঘুরাতে থাকে। এ কারণে যুদ্ধে মাটিতে মিশে যাওয়া দেশটি অতিদ্রুত এর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলো।

আমরা যারা বাংলাদেশের সমান বয়েসী তারা যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি; শ্রমচঞ্চল বাংলাদেশকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন একটি দেশ আর এর মানুষেরা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশ্বসেরা হয়ে উঠেছে। প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার অদম্য শক্তি যাদের; তাদের থামাবে; এটা কার সাধ্য।

সাধারণ মানুষ দিনমান পরিশ্রম করে। পরিশ্রম শেষে একটু গরম ভাত পেলে মুখে আনন্দের জ্যোতি খেলা করে। এই শ্রমজীবী মানুষের অধিকাংশের কণ্ঠে বিস্ময়কর সুর; কাজেই অসুর বার বার পরাজিত হয় এই জনপদে। ছেলেবেলায় শোনা রাক্ষসের গল্পে; রাক্ষস বধের সাহসী কাহিনী শুনে এদেশের প্রত্যন্তের শিশুরা ঘুমাতে যায়। এ কারণেই ক্রমাগত জীবন সংগ্রামে সাহসী এই শিশুরা।

পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন উচ্ছেদ করে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা দেশমাতৃকাকে আশ্বস্ত করেন, "তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি; শত্রু এলে অস্ত্র হাতে লড়তে জানি।"

অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় জাতি; শ্রমে ও সংগীতে নিরুপদ্রব জীবন কাটাতে আগ্রহী। এ কারণে 'যোদ্ধার জাত' তকমা সংগ্রহ করতে আগ্রহী নয় বাংলাদেশের মানুষ।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে 'শান্তির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহের কথা উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু শান্তির পথে রাক্ষস বধ না হলে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে বলেছেন।

একাত্তরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর; বঙ্গবন্ধু যত দ্রুততার সঙ্গে রাষ্ট্র পুনর্গঠন করেছিলেন; তা অভাবনীয়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ফেলে বাংলাদেশেরই অবিমৃষ্য ও অধৈর্য কিছু লোক। এই একটি নেতিবাচক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে; চট করে রেগে একটা আত্মঘাতী কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলা। বাংলাদেশের নদীঘন সবুজ জনপদে এরকম সহিংসতা খুবই বেমানান। তবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীটি। শ্রমজীবী মানুষেরা কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মাঝ দিয়ে দেশে বিভাজনের রাজনীতির সূত্রপাত হয়। দুই সামরিক সরকার জিয়া ও এরশাদের সময়ে সুবিধাভোগী শ্রেণীর সক্রিয়তা ছিলো আত্মকেন্দ্রিক। অথচ সেই শ্রমজীবী মানুষেরা কিন্তু শ্রমে ও ঘামে সক্রিয় থেকেছেন দেশ উন্নয়নে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকায় অর্থনীতিতে দ্রুতি আসেনি। 'এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা'-র বাধাটি না থাকলে শ্রমজীবী মানুষেরা অনেক আগেই বাংলাদেশকে তার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারতো।

নব্বুই-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বাদ দিলে পোশাক শিল্পের বিকাশ ও খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা আনতে যথাক্রমে খালেদা জিয়ার সরকার ও শেখ হাসিনার সরকার শ্রমজীবী মানুষের সহায়ক হয়েছে বলে মনে হয়। ফলে একবিংশ শতকে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে গড়ে প্রায় পাঁচ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে।

টুইন টাওয়ার হামলার পরে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া সন্ত্রাসবাদের অভিঘাতে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ প্রত্যন্ত এলাকায় কিছুটা সামাজিক জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। কিন্তু পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো ভয়ংকর জঙ্গিবাদের উপযোগী সমাজ বাংলাদেশ নয়। ফলে আঞ্চলিক জঙ্গিবাদের একটা বাংলাদেশী ভার্সন মাথাচাড়া দিতে থাকে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমর্থন জুটে যাওয়ায় 'বাংলা ভাই' নামের এক আফগান যুদ্ধফেরত মুজাহিদ 'জঙ্গিনেতা' হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ঝুঁকি বোধ করায় বিদেশী বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসতে চায়নি বাংলাদেশে। যে কারণে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ হয়নি।

এক-এগারোর পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তারা এই জঙ্গিবাদ ইস্যুতে মনোযোগ থিতু করে। ফলে বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন পরিকল্পনা সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়ায়; বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক মিরাকল উপহার দেয়।

দক্ষিণ এশিয়ার ভারত-পাকিস্তানের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যখন পাঁচ এর ঘরে; বাংলাদেশ তখন একে নিয়ে গেছে আটের ঘরে। প্রবাসী শ্রমিক, বস্ত্রশিল্পের শ্রমিকের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি শ্রমিকেরা অর্থনৈতিক উন্নয়নের নতুন শক্তি হিসেবে এগিয়ে এসেছে।

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে একটি প্রবাদ প্রচলিত রয়েছে, 'ভিক্ষা চাই না মা কুত্তা সামলাও।' বাংলাদেশের শ্রমমুখর মানুষ বড় কোন সাহায্য চায়না; কেবল দুর্নীতির কুকুর সামলালেই বেঁচে যায়। হরতালের কুকুর সামলাতে পারায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মিরাকলটি সম্ভব হয়েছে বলে মনে হয়।

রাজনীতিতে 'গণতন্ত্র'; 'মত প্রকাশের স্বাধীনতা' এরকম বিষয়গুলোতে আত্মঘাতী কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলার একমাত্র রোগটি সব তরফেই দৃশ্যমান। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক সূচকে উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনার মতো মৌলিক বিষয়গুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এখন রোল মডেল; এটা আঞ্চলিক শত্রু-মিত্র প্রতিটি রাষ্ট্রই স্বীকার করে। বাংলাদেশকে তারা অনুসরণ করে এমন দৃষ্টান্তও রয়েছে।

বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ করবে ২০২১ সালে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর মানবিক উন্নয়নের সমন্বয় করা গেলে; বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষের গর্বিত হবার মতো অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা বিনির্মাণ দ্রুতই সম্ভব। কল্যাণ রাষ্ট্র হয়ে ওঠাই এখন বাংলাদেশের প্রধান লক্ষ্য।

জীবন পুষ্প-শয্যা নয়। রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাড়তি দায়িত্ব এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতের নাগরিক আইন সংশোধনের মাঝ দিয়ে সৃষ্ট আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি বাংলাদেশকে এর উন্নয়ন যাত্রায় কিছুটা শঙ্কিত করেছে।

বাংলাদেশের যে পররাষ্ট্রনীতি; কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়; সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব; এ অত্যন্ত সভ্য ও সমসাময়িক রাষ্ট্রদর্শন। বাংলাদেশের অগ্রাধিকার জন উন্নয়ন; তাই পররাষ্ট্রনীতির ভারসাম্যের কৌশল অবলম্বন করে আলোক সম্ভবা আগামী যাত্রাকে নির্বিঘ্ন করাই প্রত্যাশিত।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ