আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ক্রিয়েটিং সেন্স অফ দ্য কে-অস

মাসকাওয়াথ আহসান  

২০১৯ সালের দক্ষিণ এশিয়া বিশৃঙ্খলার এক চূড়ান্ত রঙ্গমঞ্চ। চারপাশের বাতিগুলো নিভে যাবার অশনি এই ক্ষণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মানুষেরা প্রতিদিন নৈরাশ্যে ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ। ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে সেই জার্মানির উগ্র নাৎসিপন্থার আদলে উগ্রহিন্দুত্ববাদের আগুন জ্বালিয়েছেন। ইসলামি কট্টরপন্থার আগুনে পুড়ে যাওয়া পাকিস্তানে ইমরান খান ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চেষ্টা করছেন বিরোধী দলগুলোকে দুর্বল করে দিতে। বাংলাদেশে শেখ হাসিনা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে যে কাজে এরইমাঝে সাফল্য অর্জন করেছেন।

চীনের একদলীয় শাসন ব্যবস্থার নেশা দক্ষিণ এশিয়ায় যেন আসর জমিয়ে বসেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র মানুষের বসবাস যেহেতু দক্ষিণ এশিয়ায়; সবচেয়ে দুর্বল মেরুদণ্ডের মধ্যবিত্ত আর সবচেয়ে অনৈতিক ধনী মানুষের বসবাস এইখানেই। তাই একদল 'ডাকাত' সংঘবদ্ধ হয়ে 'রাজনৈতিক দল' নাম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার পরিশ্রমী মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করে; ধনী হবার চক্করটিকে নানা দেশপ্রেম আর ধর্মপ্রেমের কথামালা পরিয়ে এতকাল যে ভাঁওতাবাজি করে চলেছে; তা উন্মোচনের বছর ছিলো যেন ২০১৯।

পৃথিবীর সভ্য গণতন্ত্রের দেশগুলোতে সরকার একটা সার্ভিস সেন্টারের বেশি কিছু নয়। সেসব দেশের নাগরিকেরা সরকারকে নিয়োগ করে রাষ্ট্রের হোম-ম্যানেজমেন্টের কাজে। সরকার জনগণের চাকরি করে মাত্র।

কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার নিবিড় গ্রামীণ সমাজে; সরকার মানে দেশের মালিক। রাষ্ট্র যেন এক একটি পিরপ্রজাতন্ত্রী মাজার; এইখানে বংশ পরম্পরায় গদিনশীন পির বংশের শরিকেরা। জনগণকে এই মাজারে এসে পিরের সামনে হাত কচলে অনুনয় বিনয় করে বলতে হয়, আমার সব সম্পদ নিয়ে নিন; শুধু প্রাণটুকু ভিক্ষা দিন।

পির সরকারের খাদেমেরা চোখ-মুখ গরম করে, লোকজনকে ধর্ম-প্রেম, দেশপ্রেম শিখিয়ে বেড়ায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষমতাসীন পিরের খাদেমেরা সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র অবস্থা থেকে তুলে আনা ফুটসোলজার। এরা সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর মতই প্রতিপালিত লুণ্ঠনের অন্নে। ক্ষমতার খাদেমরা পাগল কুকুরের মতো দৌড়ে বেড়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দুর্নীতির বসন্তে।

জনগণের টাকায় কেনা অস্ত্র দেখিয়ে জনগণকেই ভয় দেখিয়ে বেড়ায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সেনাবাহিনী, পুলিশ ফোর্সের লোকেরা। যত্রতত্র 'অপরাধ দমন'-এর নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করে বেড়ায় এরা। এইভাবে পুরো দক্ষিণ এশিয়া হয়ে উঠেছে ভীতির জনপদ।

দক্ষিণ এশিয়ার আজকের সমাজ একটি ডিটেনশন ক্যাম্প। এখানে বন্দি নাগরিকেরা ভয়ে ভয়ে তাদের অভিমত প্রকাশ করে। সেই হিটলারের উগ্র-নাৎসি ডিটেনশন ক্যাম্পে ঠিক যেরকম ভীতি কাজ করতো বন্দিদের মাঝে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মানবাধিকার পরিস্থিতি এই মুহূর্তে খুবই আদিম। ব্যাংক ডাকাতির সময় যেমন বেপরোয়া থাকে ডাকাতরা; দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতার খাদেমরা ঠিক তেমনি বেপরোয়া দেশ ডাকাতির এই বিশৃঙ্খল সময়ে। কেউ ক্ষমতার পিরের সঙ্গে 'সহমত' পোষণ না করলেই তার জীবন বিপন্ন হয়ে ওঠে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা সবাই বৃদ্ধ। আজকের এই ইন্টারনেট যুগের বিশ্ববাস্তবতা; তারুণ্যের মন ও মনন বোঝার সামর্থ্য তাদের নেই। তারা এক অচল ভুবনের বাসিন্দা। এর ফলে খুব বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে পুরো উপমহাদেশে।

বৃদ্ধ শীর্ষ নেতারা জীবন সম্পর্কে তারুণ্যকে যেসব উপদেশ দেন, সেগুলো যেন 'মাছকে সাঁতার শেখানো'র মতো হাস্যকর। সমাজে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কেমন হওয়া উচিত; তা তরুণদের কাছে স্পষ্ট; কারণ তারা ব্যক্তিগত জীবনে তা অনুশীলন করে।

বৃদ্ধ নেতা ও তাদের ক্ষমতার খাদেমরা যেহেতু ব্যক্তিগত জীবনকে ফ্যাসিবাদী ফলে তাদের মুখের সব কথাই স্বৈরবচন। গণতন্ত্রের স্বৈরিণী যেন এই জোর করে 'ক্ষমতা দখল' করে রাখা 'অচল রাজারা'।

২০২০ সালে প্রবেশের ক্ষণে দক্ষিণ এশিয়ায় 'রাষ্ট্র' ব্যাপারটা সামষ্টিক সমাজে এর প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। তিরিশের নীচের তরুণদের কাছে, রাষ্ট্র হচ্ছে; ভাত দেয়ার মুরোদ নেই; কিল দেবার গোঁসাই।

আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় অর্ধশিক্ষিত ধর্মের ম্যানেজাররা উগ্র ধর্ম-পুলিশি করতে গিয়ে যেভাবে অপাংক্তেয় হয়েছে সমাজে; আজ অর্ধশিক্ষিত দেশপ্রেমের ম্যানেজাররা উগ্রদেশপ্রেম-পুলিশি করতে এসে চূড়ান্ত অপছন্দের হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে জনমানুষ এখন সবচেয়ে ঘৃণা করে।

কাজেই ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ নেতাদের পুনর্ভাবনা করতে হবে নিজেদের বোঝাপড়া নিয়ে। ইতিহাসে কেবল সেসব রাজনৈতিক নেতাকেই শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়; যাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনায় দেশের মানুষ সুখে ছিলো; যারা সামাজিক সুবিচার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করেছেন।

'হিটলার' নামটা শুনলে আজো তার করুণ মৃত্যুর সাত দশক পরেও প্রতিটি মানুষের মাঝে তীব্র বিবমিষা জাগে। ক্ষমতার জন্য পাগল এক হিংস্র নরভোজির ছবি মানুষের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ নেতাদের এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে; তারা হিটলারের আদলে ইতিহাসে গণধিকৃত হতে চান; নাকি একটু সম্মানজনক স্মরণের মাঝে থাকতে চান। মানুষের অমিত- অপরাজেয় শক্তি; তারা হিটলারের মতো নরভোজি নেতার ডিটেনশন ক্যাম্পের মানবেতর দিনরাত্রি অতিক্রম করে ঠিকই সভ্যতার পতাকা উড়িয়েছে; আর উগ্র নাৎসি হিটলার বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে মানুষের শক্তির কাছে বিপুলভাবে পরাজিত হয়ে।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ