আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

‘নিষ্পাপ’ সাইদি ‘সাহেব’ এবং ইয়ামাশিতা ষ্ট্যাণ্ডার্ড

আরিফ রহমান  

Doctrine of hierarchical accountability for war crimes বলতে আপনি কী বোঝেন? যদি কিছু না বোঝেন তাহলে আপনার ফৌজি বন্ধুকে জিজ্ঞেস করতে পারেন অথবা আন্তর্জাতিক আইন পড়েন এমন কাউকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। বন্ধুকে আরও জিজ্ঞাসা করুন hierarchical accountability মানে কী? Command responsibility বা Superior responsibility-র মানে কী?

এসবের মানে সহজ ভাষায় বুঝতে হলে ইয়ামাশিতার কাছে ফিরে যেতে হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হয়ে লড়ে যাওয়া জেনারেল ইয়ামাশিতা সাহেব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখ ফিলিপাইনের ম্যানিলার এক আদালতে জেনারেল তময়উকি ইয়ামাশিতার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো war crime-এর। ম্যানিলা গণহত্যা সংগঠনে ভূমিকা, সিংগাপুর এবং ফিলিপাইনে নিরীহ মানুষদের হত্যার অভিযোগে তাকে দায়ী করা হয়।

বিচারে আদালত তার সেনাবাহিনীর অপরাধের দায়ে তাকে দণ্ডিত করে। যদিও আদালত পরিষ্কার করে বলে, "যে সেনারা যুদ্ধাপরাধ করেছে তাদের যে ইয়ামাশিতা এই অপরাধ গুলো করার অর্ডার দিয়েছে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। Yamashita was found guilty of his troops' atrocities even though there was no evidence that he approved or even knew of them।"

তার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল he had failed in his duty as commander of Japanese forces in the Philippines to prevent them from committing atrocities।

ইয়ামাশিতার নিজের আইনজীবীরা অভিযোগ ডিফেন্ড করেছে এই বলে যে, "জাপানি বাহিনী গণহত্যা করেছে এই কথা সত্য তবে যুদ্ধের ভেতর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো এবং জাপানি সেনাদের ভেতর চেইন অফ কম্যান্ড পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আর তাই ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও জেনারেল ইয়ামাশিতা তার সৈন্যদের হত্যা, ধর্ষণ থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি।"

ইয়ামাশিতার পক্ষে লড়েছিলেন আমেরিকান আইনজীবী Harry E. Clarke যিনি নিজে ছিলেন একজন কর্নেল। ম্যানিলায় স্থাপিত কোর্টে বিচারের প্রথম বক্তব্যেই তিনি যে কথাটা বলেন তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন,

"অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জগুলো 'তিনি কি করেছেন' কিংবা 'তিনি কি করেননি' এমন নয় বরং 'তিনি কি করতে পারতেন' এটাই আলোচ্য"

এই বিচারে কেবল মাত্র সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ব্যর্থতার কারণে (যারা অপরাধ করেছে বলে ইয়ামাশিতা স্বীকার করেছেন এবং যাদের তিনি অপরাধ করতে নির্দেশও দেননি) জেনারেল ইয়ামাশিতাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত, ১৯৪৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর কার্যকর করা হয় এই মৃত্যুদণ্ড।

হিটলারের নাৎসি বাহিনী, পলপটের খেমাররুজ বাহিনী, কিংবা রুয়ান্ডার বেতার ষ্টেশন Radio Television Libre des Mille Collines (RTLM) এরা সবাই জেনসাইডের অপরাধে দণ্ডিত।

একটা রেডিও ষ্টেশনের কথা যখন আসলো তাহলে সেই রেডিও নিয়ে দুটো তথ্য দেই। রুয়ান্ডার রেডিও Radio Television Libre des Mille Collines থেকে সেসময় সাধারণ হুতুদের উদ্দেশ্যে বলা হতো তারা যেন তুতসিদের ওপর আক্রমণ করে। নিয়মিত গান, নাটক, বিজ্ঞাপনে তুতসিদের Cockroach, Wicked, Sorcerers নামে সম্বোধন করে ডিহিউমেনাইজেশন করা হতো।

এই সব উসকানিতে মানুষ হত্যাকাণ্ড করেছিল এই মর্মে জাতিসংঘ পরিচালিত The International Criminal Tribunal for Rwanda-তে এই রেডিও ষ্টেশনের বিচার বসে। সেই রেডিওর গোটা দশেক কর্মচারীদের ভেতর তিনজন ধরা পড়েছিল। তিনজনের একজন ছিল রেডিওটির ডাইরেক্টর, একজন ছিল এক্সিকিটভ কমিটির চেয়ারম্যান আর একজন সামান্য এনাউন্সার, অর্থাৎ তার সামনে যা এনে দেওয়া হতো তিনি সেটা শুধু পড়তেন।

নিজেদের ডিফেন্ড করতে গিয়ে ডাইরেক্টর বলেছেন তার ওপর সরকারে চাপ ছিল এসব হেইট স্পিচ ছোড়ানোর জন্য। এক্সিকিটিভ কমিটির চেয়ারম্যান বলে সে জানেই না তাকে এটার চেয়ারম্যান করা হয়েছে। এনাউন্সার বলে সে কি বলবে সেটা সে ঠিক করতে পারতো না।

এই তিনজনের একজনও একটা মানুষকে খুন করেনি, শুধু অর্ডার তামিল করেছে, একজন জানেই না তাকে যুদ্ধাবস্থায় সরকার এই রেডিওর চেয়ারম্যান বানিয়েছে। তবুও জাতিসংঘ পরিচালিত এই ট্রাইব্যুনাল এই তিনজনকে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।


সাইদি লন্ডনের বাংলা টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের মুখে বলেছেন যে ছাত্র অবস্থায় তিনি মউদুদির রচনার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ছাত্র জীবন শেষ করার পর আনুষ্ঠানিক ভাবে তিনি জামায়াতে যোগ দেন। একই ইন্টার্ভিউতে তিনি বলেছেন, তার ছাত্র জীবন শেষ হয়েছিল ১৯৬২ সালে। একই ইন্টার্ভিউতে তিনি বলেছেন, সত্তরের দশকে (৬১-৭০) তিনি জামায়াতের রোকন হন। সত্তরের দশকে যিনি রোকন তিনি ৭১ সালে কি? সর্বনিম্নে রোকন।

১৯৭১ সালে কি জামায়াতে ইসলাম নামের দলটি যুদ্ধাপরাধ করেছে? গণহত্যা করেছে? ধর্ষণ করেছে? লুটতরাজ করেছে? এগুলো কি ক্রাইম এগেইন্সট হিউম্যানিটির আওতায় পড়ে? যেকোনো rational মানুষের এসব প্রশ্নের উত্তর একটাই হওয়া উচিত "হ্যাঁ"।

দেলোয়ার হোসেন সাইদি, ১৯৪০ সালে যার জন্ম। ১৯৭১ সালে যার বয়স ৩১ বছর। ১৯৭১ সালে তিনি কি করেছেন? রাষ্ট্র কর্তৃক আনিত সমস্ত অভিযোগ এক মুহূর্তের জন্য যদি বাদ দেই, তিনি তো নিজের মুখে বলেছেন তিনি তখন জামায়াতের রোকন ছিলেন। তিনি কি ১৯৭১ সালে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধ থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছেন? সমাবেশ করে বলেছেন "মানুষ হত্যা করা উচিত নয়"। এমনকি যদি সমাবেশ করার মত ক্যাপাসিটি ওনার না থাকে ওনার দলের নেতারা যে সমাবেশ করে বলেছিল "যেখানেই তথাকথিত মুক্তিবাহিনী সেখানেই তাদের খতম কর" (সংগ্রাম, জুলাই ১৯৭১) তখন কি তিনি এর বিরোধিতা করেছেন?

আচ্ছা ধরেন যুদ্ধের সময় যোগাযোগ ভেঙে পড়েছিল দেখে তিনি প্রতিবাদ জানাতে পারেননি। তাহলে নিশ্চয়ই যুদ্ধের পর তিনি গণহত্যা সংগঠনে পেছনে জামায়াতের অবস্থানের কারণে ঘৃণা ভরে দল ত্যাগ করেছেন? করেছিলেন কি?

নাকি তিনি জামায়াতের আরও বড় নেতা হয়ে উঠতে লাগলেন? ‘জামায়াত ১৯৭১ সালে কিছুই করেনি’ এই স্ট্যান্ডকে স্টাব্লিস করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন?

জেনোসাইড ওয়াচের প্রেসিডেন্ট জর্জ স্ট্যান্টনের “এইট স্টেইজ অফ জেনসাইড” প্রবন্ধটা পড়ে দেখবেন। এই একাডেমিশিয়ান দেখিয়েছেন কিভাবে গণহত্যার সংগঠকেরা গণহত্যার পর গণহত্যাকে চাপা দেওয়ার জন্য কাজ করে যায়। তিনি বলেছেন “গণহত্যা অস্বীকার গণহত্যারই অংশ”।


সিদ্ধান্তে আসি।
আপনি যদি 'আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন' মেনে থাকেন। আপনি যদি 'দশক' শব্দের অর্থ বুঝে থাকেন। সাইদি যদি সত্তরের দশকে জামায়াতে রোকন হয়ে থাকেন। ডক্টর জর্জ স্ট্যান্টন যদি একাডেমিশিয়ান হয়ে থাকেন। সাইদি যদি গণহত্যার সাথে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে থাকেন। আর জামায়াত যদি প্রকৃতই যুদ্ধাপরাধ করে থাকে।

তাহলে শুধু সত্তরের দশকে জামায়াত করা, ৭১ সালে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধ করতে বাধা না দেওয়া এবং ৭১ সালের পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধকে অস্বীকার করা কেবল এই তিন অপরাধে তাকে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া খুব যৌক্তিক। আর আমাদের আদালত তো তার সরাসরি মানুষ হত্যায় অংশ নেওয়ার পক্ষে প্রমাণ পেয়েছেই।

এখন আপনার যদি মনে হয় জামায়াত ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধ করেনি তারা মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে “পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া” গানের তালে তালে মুজরা করেছে তাহলে মিজানুর রহমান আযহারীদের ভাষায় বলুন-

অ্যাই সরকার ফ্যাসিবাদী, অ্যাই সরকার জালেম;
অ্যাই সরকার খুন করেছে আড়াই হাজার আলেম!

আযহারী সাহেব প্রতিটা ওয়াজে বলেন "ঘরে ঘরে সাইদি দাও"। মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে জামায়াতের হেডকোয়ার্টারে ষোলই ডিসেম্বরের পর এক বস্তা চোখ পাওয়া গিয়েছিল। একটু ভেবে দেখেন ৭১ সালে ৩১ বছর বয়সে যেই সাইদি ছিল জামায়াতের রোকন, ২০২০ সালে ৭৯ বছর বয়েসে জেলে বসে জামায়াতের নায়েবে আমীর হয়ে আছেন সেই সাইদিই। এক বস্তা চোখ আর তিরিশ লক্ষ লাশ যাকে জামায়াতের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি আপনারা ঘরে ঘরে তেমন সন্তান চান? সত্যিই কি চান?

আরিফ রহমান, লেখক, অনলাইন এক্টিভিষ্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ