টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
সালেহ আহমদ খসরু | ১৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২০
আহ, কতো বড় বিজয়! কেউ কি ভেবেছি একবার! ভাবুনতো! হ্যাঁ, ভারতকে হারিয়ে বা হয়তো কেউ দুষ্টুমি করে বলবে বধ করে যুব বিশ্বকাপ ক্রিকেট জেতা চাট্টিখানি কথা নয়!! কী অসামান্য কাণ্ডটাই না করে দেখালো তরুণ তুর্কি আমাদের ক্রিকেট মানিকেরা! একদম টানা দশ ম্যাচ জেতার গল্পটি পূর্ণতা পেল বিশ্বকাপ জয়ে পচেফস্ট্রমের সবুজ গালিচায়! ঘরে কর্তা ডেকে বলছেন – ওগো শুনেছ, তোমার-আমার সোনার ছেলেগুলো বিশ্বসেরা হয়েছে! বোন চিৎকার করে জানান দিচ্ছে বিদেশবিভুঁইয়ে থাকা পরিশ্রমী ভাইকে – ভাইয়া আমরা না যুব বিশ্বকাপ ক্রিকেট জিতেছি! প্রেমিক তার মানসীকে বলছে আজ আর কথা নয়, কেবল উচ্ছ্বাস একটাই- ভালোবাসি সেই তরুণকে যে আমার লাল-সবুজের রঙ হৃদয় মাঝে ছড়িয়ে দিল তাঁদের! হাড় কাঁপানো শীতে কাতর দিনমজুর উষ্ণ হয়ে বলছে- ঐ বেটা হুনছস, আমাগো দেশ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন! হ্যাঁ প্রিয় স্বদেশ আমাদের বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ বা যুব বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০২০ চ্যাম্পিয়ন! অভিনন্দন জুনিয়র টাইগার্স।
তৃণমূলে ক্রিকেট বেড়ে উঠছে এবং এই প্রক্রিয়ায় মুল বিশ্বকাপ জেতার দিবাস্বপ্ন নয় বরং কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পথ যে খুব বেশি দুরে নয় তা ভাবতে যেমন শিউরে উঠছি তেমনি অনাহুত আশঙ্কাও দানা বেধে আছে যে এর ছন্দপতন হয় কি-না কোন হুতুম প্যাঁচার হুতুম ডাকে!
এমন জয় স্বাধীনতার পর আর কিসে হয়েছে মনে পড়ে না, তবে আইসিসি ট্রফি জিতে যে যাত্রা ১৯৯৭সনে শুরু হয়েছিল তা যেন ক্রমেই গন্তব্যের খোঁজে ছুটে যেতে পাগলপারা তা আরও একবার জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিল এই বিজয়! তাই স্মৃতি বিস্মৃত না হয়ে রকিবুল হাসান, জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহ, ইউসুফ বাবু, দৌলত, স্টাইলিশ প্রিন্স, হীরা, আমিনুল সহ আরও এইমুহূর্তে বিস্মৃত বাকি সব কীর্তিমান অতীত তারকা যারা ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সেইসব মহীরুহদের জানাই লাল সালাম এবং আমার লিখা উৎসর্গ করি তাবৎ সাবেক ক্রিকেটারদের যাদের অঙ্কুরিত বীজ আজ পত্র পল্লবিত সুরের মূর্ছনায় বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন আন্দোলিত করে তুলেছে, তোমাদের আবারও লাল সালাম।
গল্পটি কি রিচার্ড স্টনিয়ার থেকে শুরু হবে না-কি রকিবুল হাসান হতে যাত্রা করবে কিংবা গর্ডন গ্রিনিজ বা ডেভ হোয়াটমোর এর উপাখ্যান আরম্ভিক হয়ে আজকের বিজয়গাঁথার স্তুতি করি! ঠিক অনুধাবন করতে বেগ পেতে হচ্ছে কারণ একটাই তাহল- বিশ্বকাপ বিজয় এবং সেটি যে ফরম্যাটেই হোক! আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মাথা উঁচু করে বলে যেতে পারছি এবং বলে যেতে পারব আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। তাই শুরুটা রকিবুল হাসান দিয়ে করি – ঢাকা টেস্টে যে বাঙালি তরুণ তৎকালীন পাকিস্তান দলে জায়গা করেও নিজের অবস্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও ব্যাটে প্রতিবাদের স্টিকার সংযুক্ত করে জানান দিয়েছিলেন পশ্চিমা শাসন মানিনা সেই প্রজন্ম আজ একটি ফরম্যাটে ভারত পাকিস্তান অস্ট্রেলিয়া ছাপিয়ে মাথা উঁচু করা ক্রিকেট জাতি। তাই বীর রকিবুল হাসান স্মরণ না করে এ গল্প শুরু হয় কি করে!
গ্রুপ পর্বে তিন ম্যাচ জিতে নক আউট এসে সাউথ আফ্রিকা নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়ে শক্তিশালী ভারত বধ করা যে চাট্টিখানি কথা নয় সে হিসেব সকল ক্রিকেট সমঝদার মাত্রই অনুধাবন করেন এবং তাই এই বিজয় ভিন্ন এক ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এর বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে ক্রিকেট দুনিয়ায়, আর সেই গল্পের শুরু রিচার্ড স্টনিয়ার এর হাত ধরে। অতএব এই কন্ডিশনিং ও মাইন্ড সেট কোচ আমাদের বিজয়গাঁথার অংশ হয়ে রইলেন, হ্যাটস অফ রিচার্ড স্টনিয়ার। এই টানা ছয় ম্যাচ জেতার আগে আরও চারটি ম্যাচ টানা জিতেছে যে দল সেটিও এই তরুণ তুর্কি রিচার্ড স্টনিয়ার এর হাত ধরেই। অথচ কোন পত্রিকা বা অনলাইন সংস্করণে এর গাল-গল্প ফুলিয়ে প্রচার করেনি, তাই অনেকটা চুপিসারেই এই বিজয় আকাশ ছুঁয়েছে! সেই মেঘমুক্ত আকাশ জুড়ে আজ ১৬কোটি মানুষ একত্রে উড়ছি, এ-যে কি পরমানন্দের তা বাংলাদেশের বাইরে আর কেউ যদি বোঝে তবে সে ভারত! কারণ তাদের হাতের নাগালে থাকা বিশ্বকাপ ছোঁ মেরে জানান দিল অনেক হয়েছে আর নয়! কুলীন হয়ে উদয়াস্ত শাসন করার দিন শেষ, এবার দেখ এরই নাম বাংলাদেশ। আমার চোখ নিবদ্ধ ছিল এই টুর্নামেন্টের দিকে কারণ এর আগেই এই সোনার ছেলেগুলো নিউজিল্যান্ড ও সাউথ আফ্রিকাকে হারিয়েছে তাই বাড়তি নজর কেড়ে নিতে তাদের বেগ পেতে হয়নি অন্তত ক্রিকেট বোদ্ধাদের চোখে।
অবশেষে সফলতার উপাখ্যান তৈরি করে একটি বিভক্ত জাতিকে নিমিষেই ঐক্যবদ্ধ করে আনন্দিত করলো যে সোনার ছেলেগুলো তাদের প্রতি আমাদের মাথা নিচু করে উঁচু হওয়া বাংলাদেশ অচিরেই মুল বিশ্বকাপ জিতে আমাদের শির উঁচু করবে সে বিশ্বাস প্রবল হলো। তবে এখানে শুধু স্বপ্নবাজ হলেই এক কদম এগুনো যাবেনা বরং রিচার্ড স্টনিয়ার থেকে জানতে হবে তাঁর বিনি সুতার বাঁধন কোন সুতোয় গাঁথা! টিভি ক্যামেরা যখন তাকে দেখাচ্ছে গভীর পায়চারী করছেন আবার সাইড লাইনে এসে স্পষ্ট বাংলায় বলছেন – “শেষ করে আসিও”। এই মুল স্কিপার ইংরেজি না বলে খেলোয়াড়দের প্রাণের ভাষায় বলা সেই টনিকের রেসিপি কি জানতে হবে, নচেৎ আবার পিছিয়ে যাবে স্বপ্নবান মানুষের স্বপ্ন জয়!
জাতি নষ্ট ও পচে যাওয়া রাজনীতির আস্ফালন এর দুঃস্বপ্ন ক্রিকেট বা খেলাধুলার অঙ্গনে আর দেখতে রাজি নয়! অনেকেই ক্রিকেট বোর্ড বা সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের যে কৃতিত্ব আছে তা মানতেই নারাজ, কিন্তু আমি তাদের সাধুবাদ দেই এ কারণে যে এখানে তারা অযাচিত হস্তক্ষেপ করেননি বলে যা হরহামেশাই হয়! দুর্মুখেরা এ-ও বলছেন এখন না আবার কাউকে এমপি বানানোর চেষ্টা করা হয় যাতে এটিও আর পবিত্র না থাকে!
এখন আকবর আলি আর তার বাহিনীর গল্প দিয়ে যদি কলম না থামাই তবে আসল গল্পই বলা বাদ দেওয়া হয়েছে বলে আমাকে না আবার বোর্ড সভাপতির মতো দায়ি করা হয়! আকবর আলি যেন মোঘল সম্রাট ‘আকবর দি গ্রেট’ হয়ে তার বাহিনী পরিচালিত করেছেন অনন্য উচ্চতায়, তার পোস্ট ম্যাচ বক্তব্য মনে রাখার মতো – “The plan was simple, stay in the crease and we know India can make it difficult and it was hard work on n off the field with coaching stuff plus maintain physical fitness with physio, can i say in Bengali!? আপনারা ছিলেন আমাদের দ্বাদশ খেলোয়াড়”। উফ ভাবা যায়! আমার দেশের ক্যাপ্টেন, কী সাবলীল তার বাচনভঙ্গি! এটাই বডি ল্যাংগুয়েজ যা জানান দেয় কিছু একটা করতে চায় এই দলটি! ইমনের ইনিংস ছিল অসামান্য ৪৭ রানের যা এই বিজয়ের ভিত্তিপ্রস্তর, যেখানে দাড়িয়ে আকবর দি গ্রেট একটা একটা করে ইটের গাঁথুনি দিয়ে রচিত করেছেন লাল-সবুজের দুর্গ, তাই আকবরের বিজয়ের প্রধান সেনাপতি মানসিংহকে ভুলে যাই কি করে!
পারভেজ ইমন যখন আউট হয়ে ফিরে যাচ্ছিলো তখন তার হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট ছাপিয়ে চোখে যে ব্যথা আমি দেখেছি তা ছিল আরও বহু ব্যথাতুর, হ্যামস্ট্রিংয়ের যাতনা যেন বিশ্বজয়ের হাতছাড়া বুকে পাথর চাপা পড়েছিল! মনে থাকবে ইমন তোমার চোখ বন্ধ করা কান্না, কেবল দেশপ্রেমিক মানুষ বোঝে কি তার যাতনা, হ্যাটস অফ ইমন-জাতির সূর্য সন্তান তুমি। সেমি ফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাহমুদুল হাসান জয়ের শতক, শাহাদাতের ৪০ নট আউট এসব কিছুই আমরা ভুলছিনা, ফাইনালে শরীফুলের একটি স্পেল, অভিষেকের ৩ উইকেট, ফিল্ডিং, কিপিং, ক্যাচিং। সব ডিপার্টমেন্টে অবিচল একাগ্রতা আর প্রতিপক্ষকে ভয় না পেয়ে উল্টো তাদের ছেলেপুলে বানিয়ে ফেলা! এটা অন্তত আমার ভীষণ নজর কেড়েছে, একেই বলে আত্মবিশ্বাস যা অতিবিশ্বাসী নয়! বিশ্বকাপ একা কারও হাত ধরে আসেনি আসেনা! পুরো দল একত্রে যখন যার কাঁধে দায়িত্ব পড়েছে সে-ই পালন করে স্বাক্ষর রেখেছে। আমরা সবাই জানি আমাদের কাজ কি! তাই সবাই তোমরা আমাদের সূর্য সন্তান, বিজয়ী বীর। আর এই বীরদের আমি মহান মুক্তিযুদ্ধের ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের সাথে তুলনা করলে কি বেশি হয়ে যাবে!! হয়তো! হয়তো না!! তবুও এরাই এ প্রজন্মের বীর সেনানি। আর এদের যিনি উজ্জীবিত করেছেন সেই রিচার্ড স্টনিয়ার তোমাকে লাল সালাম দিয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের তথা বোর্ড সভাপতি জনাব নাজমুল হাসান পাপনকে আহবান জানাই রিচার্ড স্টনিয়ার যেন গর্ডন গ্রিনিজ বা ডেভ হোয়াটমোর এর মতো বিদায় না নেন, নাহলে অগণিত অভিশাপের প্রায়শ্চিত্ত বহন করতে গিয়ে আমরা আবার সেই তিমিরেই হারিয়ে যেতে পারি! রিচার্ড স্টনিয়ারকে নাগরিকত্ব দিয়ে সম্মানিত করার প্রস্তাব করছি, সংশ্লিষ্ট মহল ভেবে দেখতে পারেন।
সে যাক এই বিজয় নতুন বিশ্বাস জন্ম দিয়েছে এরা পারবে অতএব এদের দিয়ে হবে, শুধু নিরন্তর সাধনা এবং লক্ষ্যে স্থির করে ধীর ও শান্তভাবে এগিয়ে নিতে হবে সুচারু পরিকল্পনা। তবেই সম্ভব বিশ্বচুড়ায় টিকে থাকা। সেই পরিকল্পনা হতে হবে খেলোয়াড়দের মস্তিষ্ক থেকে, কোন এমপি বা তৈল মর্দনকারী ‘হযরত’ থেকে নয়। বিশ্ব ক্রীড়া মঞ্চে ধারাভাষ্যকার হিসেবে থাকেন সাবেক খেলোয়াড় অথচ আমাদের দেশে জীবনে ক্রিকেট ব্যাট হাতে নেয়নি এমন মানুষও এ রাজ্যে দখল করে আছেন, আবার সুন্দরী হলেই বুম হাতে বলে যাচ্ছে ক্রিকেটের গল্প! অথচ ক্রিকেট দুরে থাকুক লুডু খেলেছে বলেও এদের মনে হয় না! তবুও এরা কি করছে তা আমলে না নিয়ে ধীমান সাবেক খেলোয়াড় ও সংশ্লিষ্ট সকলের ঐকান্তিক আন্তরিকতা আজ জরুরি। এমন বিজয়ের ঊষালগ্নে আমরা যেন খেই হারিয়ে না ফেলি, আমাদের এই সূর্যোদয় যেন আলোকিত করে রাখে পাইপলাইনে থাকা অসংখ্য কিশোর কিশোরী ক্রিকেটারদের এবং এই ধারাবাহিকতা যেন খোঁজে পায় আমাদের মুল জাতীয় দল সেই আশাবাদ করতে পারি। আর মিডিয়ার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি বন্ধ করে যথাযথ রিপোর্টিং এর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে খোঁজে ফিরতে হবে নতুন নতুন আকবর দি গ্রেট বা ইমন কিংবা অভিষেক তবেই হবে যথার্থ স্পোর্টস সাংবাদিকতা যা আজ সময়ের বার্তা।
পরিশেষে ভারতের খেলোয়াড় দ্বারা আমাদের জাতীয় পতাকা টেনে নেওয়ার যে কুৎসিত আচরণ হলো তা আইসিসির টনক নড়ে কি-না দেখার বিষয়! আমি শুধু তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা প্রকাশ করছি। সব ছাপিয়ে এই মহান বিজয়ে আবারও লাল-সবুজের পুরো ক্যানভাস জুড়ে এবারের বৈশাখী আম্রকাননের মুকুল ফুলে তোমাদের অভিনন্দন রিচার্ড স্টনিয়ার ও আকবর দি গ্রেট এন্ড কোম্পানি! লাল সালাম।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য