প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ | ০২ মার্চ, ২০২০
“ভাঙি’ মন্দির, ভাঙি’ মসজিদ/ ভাঙিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত,/ এক মানবের একই রক্ত মেশা/ কে শুনিবে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।” যুগে যুগে মানবিক সমাজের স্বপ্নই দেখেছে বাঙালি জাতি। বাঙালি জাতি ধর্মের প্রতি যেমন আস্থা রেখেছে, তেমনি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থায় দেখেছে বাঙালি জীবন ও জাতির সার্বিক উন্নয়ন। ইতিহাসের রাজপথে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির গোলকধাঁধায় বাঙালি বিভ্রান্ত যে হয়নি, এমনটি নয়, কিন্তু বাঙালি তার নিজস্ব পন্থায় রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম চালিয়ে আজ অবধি মানবতার বিজয়কেই ছিনিয়ে এনেছে বারবার।
বাঙলা ভাষায় (ধৃ+মন) ‘ধৃ’ প্রকৃতির সঙ্গে ‘মন’ প্রত্যয় যোগে তৈরি হয় ধর্ম শব্দটি। তাই, ধর্ম শব্দের আভিধানিক অর্থ দাঁড়ায় ‘যা মনে বা অন্তরে ধারণ করা হয়।’ মানবিক অর্থে মানুষের প্রকৃত ধর্ম হলো মনুষ্যত্ব। আর তাই, মানুষ মনে বা অন্তরে ধারণ করবে মানবিকতার সব গুণাবলি। ধর্ম, মহাপুরুষদের সৃষ্টি হলেও, তাতে বিশ্বাস এবং তাকে পুঁজি করে ব্যবসা ও রাজনীতি কিন্তু মোটেও এক বিষয় নয়। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এক মানসিক অসুস্থতা। কোনো ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত বলে ধরে নেওয়া হয়, যখন সে কোনো বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধাচরণ বা ক্ষতি করতে প্রস্তুত থাকে। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি গৌণ, মুখ্য হলো সম্প্রদায়। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, সাম্প্রদায়িকতা হলো নিজের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ এক ধরনের আনুগত্য। কিন্তু কোনো ধর্মেই অন্য ধর্ম অবমাননা বা অসম্মান করার কথা বলা নেই। নিজের ধর্মের প্রতি আনুগত্য থাকতে পারে। কিন্তু অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষের কোনো সুযোগ নেই।গ
ইতিহাস পর্যালোচনায় এটি স্পষ্ট হয় যে, বাঙালি জীবনে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষবৃক্ষ বপনে কাজ করেছে মূলত কুচক্রী রাজনীতি ও রাজনৈতিক অনুপ্রবেশকারীরা। বাঙালি সমাজ এবং সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সব সময়ই সোচ্চার থেকেছে। বঙ্গভঙ্গ থেকে শুরু। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বীজ বপনের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করেন। কিন্তু এই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন কারা? দুই বাংলার হিন্দু ও মুসলমানরা। প্রগতিবাদী হিন্দু ও মুসলমান নেতারা ব্যারিস্টার আবদুল রসুল, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মওলানা আকরম খাঁ, মওলানা মজিবর রহমান, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বিপিন পালসহ অনেকেই মাঠে-ময়দানে সেদিন বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা করে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করেছেন আন্দোলনকে উত্তাল করতে। শেষ পর্যন্ত তুমুল সামাজিক আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে দ্বিখণ্ডিত বাংলাকে জোড়া দিতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন বাতিল হলেও, স্তিমিত হয়নি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন। এই গণ-আন্দোলন রূপান্তরিত হলো স্বাধীনতা আন্দোলনে। একই সঙ্গে ধর্মকে ঢাল বানিয়ে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নতুন মোড় নিল। ১৯১৭ সালে স্টকহোমে সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালে যোগ দেওয়ার পর আলীগড়ের দুজন ছাত্র ধর্মের ভিত্তিতে ভারত-ভাগের এক পরিকল্পনা প্রস্তাব করে বসল। ১৯২০ সালে মোহাম্মদ আবদুল করিম বিলগ্রামী নামের জনৈক ব্যক্তি বাদাউন থেকে প্রকাশিত ‘জুলকারনাইন’ নামক সংবাদপত্রে মহাত্মা গান্ধীর কাছে লেখা এক খোলা চিঠিতে একই ধরনের প্রস্তাবনা করেন। এ যেন স্বাধীনতা আন্দোলন নয়, ধর্মের বিপরীতে ধর্মের লড়াই। এর চেয়ে বড় অধর্ম আর কী-ইবা হতে পারে? বাংলা ১৩১৪ সনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘প্রবাসী’তে লিখেছেন, ‘আমরা এক দেশে এক সুখ-দুঃখের মধ্যে একত্রে বাস করি, আমরা মানুষ, যদি এক না হই তবে সে লজ্জা, সে অধর্ম।’ ওই বছরই পাবনায় ভারতীয় কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মিলনীতে সভাপতির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘এদিকে একটা প্রকাণ্ড বিচ্ছেদের খড়গ দেশের মাথার উপর ঝুলিতেছে। কত শত বৎসর হইয়া গেল, আমরা হিন্দু ও মুসলমান একই দেশমাতার দুই জানুর উপরে বসিয়া একই স্নেহ ভোগ করিতেছি। তথাপি আজও আমাদের মিলনে বিঘ্ন ঘটিতেছে।’
১৯২৩ সালের জানুয়ারিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ‘স্বরাজ’ নামক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করতে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য অটুট রাখতে ১৯২৪ সালে অবিভক্ত বাংলার সিরাজগঞ্জে এক সভায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ঘোষণা করেন ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অবিসংবাদিত ঐতিহাসিক দলিল ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’। এই প্যাক্টের মূল সুরটি ছিল হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা। কিন্তু শেষ রক্ষা যে হলো না। লাহোর প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে মুসলমান ও হিন্দুদের জন্য পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি রাষ্ট্র জন্ম নিল ১৯৪৭ সালে। দ্বিজাতিতত্ত্বের পাশা খেলায় ধর্মের কার্ড জিতেছে তো বটেই। কিন্তু লাহোর প্রস্তাবনা উত্থাপনের বৈঠক তদানীন্তন বঙ্গীয় কংগ্রেস নেতা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, কিরণশংকর রায়, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর অগ্রজ শরৎ চন্দ্র বসু, মুসলিম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমসহ অনেক নেতাই সেদিন প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে তৎকালীন রাজনীতির রাঘববোয়াল নেতারা কেউই অখণ্ড বঙ্গের পক্ষপাতী ছিলেন না। আর তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি, ১৯৪৭-এর দেশভাগ বাঙালি সমাজে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এক বায়বীয় কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করেই দিল। ধর্মের ভিত্তিতে বাঙালিকে টুকরো করা হলো। বাঙালি জীবনে ধর্ম-অধর্মের বিবাদ ছিল না বলা যাবে না, তবে সম্মিলিত অগ্রযাত্রার উদাহরণও রয়েছে প্রচুর। আমরা দেখেছি, ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে কলকাতার রাস্তায় হিন্দু মুসলমান পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। আবার তারাই ১৯১৯ সালে রাওলাট আইনের সময় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সত্যাগ্রহ আন্দোলনে একে অপরের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ১৯৩০ সালে ঢাকার জনগণ যৌথভাবে ‘আইন অমান্য আন্দোলন’ পরিচালনা করেছে। ১৯৪৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার হিন্দু-মুসলমান ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর বন্দিদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করার সময়ও ঐক্যবদ্ধ ছিল। অথচ মাত্র পাঁচ মাস যেতে না যেতেই তারাই প্রচণ্ডতম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হলো। ১৯৪৬ সালের ভয়াবহ কলকাতা হত্যাকাণ্ড এবং নোয়াখালী-ত্রিপুরার চরম নিষ্ঠুরতা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। তাই ভাবি, ১৯৪৭ বাঙালির জীবনে সত্যিই কি এক অমোঘ বাস্তবতা ছিল? কী করে সম্ভব? বাঙালি সারাজীবন শিখেছে ‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান। মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ॥’
বাঙালি আলোকিত জাতি। ধর্ম ভণ্ডদের ঠিকই চিনে ফেলে। এই বাংলা সুফি, বাউল, বয়াতি ও ফকির লালন শাহের। এই বাংলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির। বাংলার ‘হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ, চেতনাতে নজরুল’। বাঙালির হাতে অগ্নিবীণা, আর কণ্ঠে গীতাঞ্জলী। চোখের তারায় হাজার সূর্য সঙ্গে নিয়ে বাঙালির পথ চলা। বাঙালির হৃদয়ে অসাম্প্রদায়িক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বসবাস। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে তাই বাঙালির আজন্ম অবস্থান। দ্বিজাতিতত্ত্বের জয়-জয়কারে ১৯৪৭-এ যে দেশভাগ হলো, ১৯৭১-এ তারই বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঙালি নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে করেছে সংবিধানের অন্যতম স্তম্ভ। কিন্তু সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই এখনো দুই বাংলায় চলছে ও চলবেই। সরস্বতী পুজোর দিনে মেয়র নির্বাচন বাতিল করতে বাংলাদেশে একসঙ্গে রাজপথের আন্দোলন করেছে হিন্দু-মুসলমান। ওপার বাংলায় ‘জয় শ্রীরাম’ আওয়াজ তুলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের হুঙ্কার দেওয়া হলেও রাষ্ট্রদ্রোহির মামলার পরোয়া না করে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন অপর্ণা সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়সহ অনেকেই। বাংলাদেশে কোনো হুমকি কখনোই থামাতে পারেনি নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা। ধর্মের অপব্যবহার নিয়ে ওপার বাংলায় সত্যজিত রায় ‘গণশত্রু’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, আর এপার বাংলায় তারেক মাসুদ নির্মাণ করেছেন ‘মাটির ময়না’। এপার বাংলায় ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর সনাতন ধর্মের মন্দিরের নিরাপত্তার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে হাটহাজারীর কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা। ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর ওপার বাংলায় সাম্প্রদায়িক নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান স্লোগান দিয়েছে, ‘হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই, একই সঙ্গে থাকতে চাই’।
সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিপরীতে বাঙালির এই যে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রাম, তা কি থামানো সম্ভব? কখনোই নয়। মানবপ্রেমী বাঙালির বাউল মন লালনের মতো যে শুধুই জানতে চায় ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।/ যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান/ জাতি গোত্র নাহি রবে॥’
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য