প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
কবির য়াহমদ | ৩০ জুলাই, ২০১৫
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর এর বিপক্ষে প্রচার-প্রচারণার জন্যে টাকার খেলা চলছে। প্রথমাবস্থায় টিভি চ্যানেলগুলোতে এমন অনেক লোক যাদেরকে এতদিন আমরা জেনেছিলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে তারাও ইনিয়ে-বিনিয়ে, এমনকি প্রকাশ্যে এর বিরোধীতা করতে থাকে। স্বচ্ছ ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিচার- এ ধোঁয়া তোলে একশ্রেণির লোক বিচারের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যায়- এটা সবার জানা।
এ লোকগুলো আস্তে আস্তে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছে হয়ত অর্থবরাদ্ধের বিষয়টিতে ঘাটতির জন্যে। অথবা তাদেরকে জনগণ গ্রহণ করছে না এ বোধটুকু জন্মানোর কারণে। তবে কিছু লোক এখনও আছে। কিছু লোককে এখনও টিকিয়ে রাখা হয়েছে, আর এ টিকিয়ে রাখা আর থাকার কারণ বাণিজ্যিক এবং একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক চেতনার মানুষ বলে পরিচিতি পাওয়ার কারণে।
এখানে আমাদের স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর একটা ভূমিকা আছে। টিভি চ্যানেলগুলোর বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান টক-শো নামে যা সমধিক পরিচিত সেখানে আদতে কিছু লোককে এক প্রকার ট্যাগ দেওয়াই হয়েছে এবং দর্শকেরা এখন ঠিক আগে থেকে অনুমান করতে পারেন কে কোন স্বার্থ রক্ষা করতে কথা বলবে। আর অনুষ্ঠান শেষে দেখা যায় অধিকাংশক্ষেত্রে দর্শকদের পূর্বানুমান ভুল ছিল না। একই কথা প্রযোজ্য সংবাদপত্রগুলোতেও। তবে এক্ষেত্রে সংবাদপত্রগুলো সামাজিক প্রভাব ও গ্রহণযোগ্যতার দিক থেকে টিভি চ্যানেলগুলো থেকে পিছিয়ে বলেই অনুমান করি।
মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকেই দেখেছি জামায়াতে ইসলামির টাকার খেলা। অর্থের মাধ্যমে তারা বিদেশেও লবিস্ট নিয়োগ করেছিল। দেশে-বিদেশে এ বিচার প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করতে সব করেছে তারা। রাজাকার কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন রায়ের বিরুদ্ধে যখন দেশে গণআন্দোলন গড়ে উঠল তখন তারা আমার দেশ পত্রিকা, মাহমুদুর রহমানদের মাঠে নামিয়েছিল। আস্তিক-নাস্তিক ধোঁয়া উঠল। সারাদেশে হেফাজতে ইসলামের প্রলয়নৃত্য চলল। এসব কাজ যারা করল তাদের সবাই জামায়াতে ইসলামির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত তা বলা যাবে না, এর বাইরে এককালের প্রগতিশীল চিন্তার দাবিদার মানুষেরাও যোগ দিল। এটা যে ধর্মের নামে প্রকৃতই টাকার খেলা সেটা বুঝে নিতে কষ্ট হওয়ার কথা না!
কেবল জামায়াতে ইসলামিই নয়, যুদ্ধাপরাধী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর (সাকা চৌধুরী) পরিবারও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও বিচার প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত, বাধাগ্রস্থ করতে অর্থ খরচের বিশাল যোগানদাতা। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ি চট্টগ্রামভিত্তিক ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলামকে রাস্তায় নামাতে সবচেয়ে বেশি অর্থ খরচ করেছে সাকা পরিবার।
এরপরের কাহিনী সবার জানা, হেফাজতের তাণ্ডব, হুমকি-ধমকি এবং এক সময় সরকারের সঙ্গে আঁতাতের মাধ্যমে রেলের জমিসহ অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে হেফাজতের ঘরে ফেরা।
যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী’র রায়কে কেন্দ্র করে সব সময়েই টাকার খেলার চলেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ যুদ্ধাপরাধীর রায় ঘোষণার আগে টাকা দিয়ে তারা খসড়া রায়ের কিছু অংশ ফাঁস করতে সমর্থ হয়। এক্ষেত্রে তারা ট্রাইব্যুনালের পিয়ন, আইনজীবিদের ব্যবহার করেছে। উদ্দেশ্য ছিল রায় ঘোষণার আগে রায় প্রকাশ করে বিচারিক প্রক্রিয়াকেই বিতর্কিত করা।
রায়ের খসড়া যা রায়ের সঙ্গে হুবহু মিল ছিল না এমন কথিত রায় নিয়ে তারা ট্রাইব্যুনালে যায় এবং উল্লেখ করে একটা ওয়েবসাইট এ রায় প্রকাশ করেছে। রায় ফাঁস ছিল মিথ্যা অভিযোগ কিন্তু রায় ফাঁস প্রচেষ্টা মিথা ছিল না বলে বিষয়টি আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেন এবং এটা চলমান হিসেবে আগামি ২০ সেপ্টেম্বর এ মামলার অভিযোগ গঠনের ওপর শুনানি হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাকা চৌধুরীর ফাঁসির রায় হয়েছে এবং আপিল বিভাগও সে রায়কে আংশিকভাবে বহাল রেখেছেন। আপিলের রায়ে কেবল একটি অভিযোগ থেকে সাকা চৌধুরীকে খালাস দেওয়া হয়েছে যেখানে ট্রাইব্যুনাল এ অভিযোগে আসামিকে বিশ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। ট্রাইব্যুনালের দেওয়া অপর আট শাস্তিকে হুবহু বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ যেখানে আছে চার অভিযোগের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের আগেপরে সাকা পরিবারের পক্ষ থেকে বিচার প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টার কমতি ছিল না। আপিল নিষ্পত্তির ঠিক আগ মুহুর্তে হঠাৎ করে জোরপ্রচার সাকা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নাকি প্রধান বিচারপতির সাক্ষাৎ হয়েছে। আওয়ামিলীগের সমর্থক হিসেবে পরিচিত দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় এ নিয়ে এক নিবন্ধ লিখেন সে পত্রিকার নির্বাহি সম্পাদক স্বদেশ রায়।
সেখানে তিনি লিখেন- “৭১-এর অন্যতম নৃশংস খুনী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। নিষ্পাপ বাঙালীর রক্তে যে গাদ্দারগুলো সব থেকে বেশি হোলি খেলেছিল এই সাকা তাদের একজন। এই যুদ্ধাপরাধীর আপিল বিভাগের রায় ২৯ জুলাই। পিতা মুজিব! তোমার কন্যাকে এখানেও ক্রুশে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। তাই যদি না হয়, তাহলে কিভাবে যারা বিচার করছেন সেই বিচারকদের একজনের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পরিবারের লোকেরা? তারা কোন পথে বিচারকের কাছে ঢোকে, আইএসআই ও উলফা পথে না অন্য পথে? ভিকটিমের পরিবারের লোকদেরকে কি কখনও কোনো বিচারপতি সাক্ষাত দেয়। বিচারকের এথিকসে পড়ে! কেন শেখ হাসিনার সরকারকে কোন কোন বিচারপতির এ মুহূর্তের বিদেশ সফর ঠেকাতে ব্যস্ত হতে হয়। [সাকার পরিবারের তৎপরতা : পালাবার পথ কমে গেছে, দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৬ জুলাই, ২০১৫]
এছাড়া গণজাগরণ মঞ্চ একাংশের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার একই অভিযোগ করেন এবং শাহবাগে দাঁড়িয়ে আমলযোগ্যভাবে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন। ইমরানের বক্তব্যগুলো সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং অনেকেই বিচারকদের নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কারণ পত্রিকা পাঠকদের অধিকাংশই যেখানে তাদের প্রতিক্রিয়াকে সরাসরি প্রকাশ করে না সেখানে তরুণ প্রজন্মের একটা অংশের প্রতিনিধি হিসেবে ইমরান এইচ সরকার দ্বারা অনেকেই প্রভাবিত।
এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম আপিল নিষ্পত্তির আগে বাধ্য হয়ে বলেন- প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাকা চৌধুরীর পরিবারের কারও সাক্ষাৎ হয়নি; এসব অপপ্রচার। এ থেকে অনুমান করা যায় তিনি এবং বিচারকগণ এসব অপপ্রচার নিয়ে বিব্রত ছিলেন।
এর প্রমাণ পাওয়া গেল আপিল নিষ্পত্তির দিন। বিচারাধীন বিষয়ে মন্তব্য ও অপপ্রচারের কারণে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ আর নিবন্ধের লেখক স্বদেশ রায়কে আগামি ৩ আগস্ট আদালতে হাজির হয়ে ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া তাদের বিরুদ্ধে কেন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হবে না এ সম্পর্কে রুল জারি করেছেন।
এর বাইরে গণজাগরণ মঞ্চ একাংশের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে তা আদালতে উপস্থাপনের জন্যে অ্যার্টনি জেনারেল মাহবুবে আলমকে নির্দেশ দিয়েছেন। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন বলে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি ও তথ্য সংগ্রহ করতে বলেছেন।
পত্রিকায় মনগড়া তথ্য দিয়ে লেখা, বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে বিচারকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার তখনই হয়েছে যখন যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর আপিলের রায় ছিল সন্নিকটে। সাকা চৌধুরী খুব সাধারণ কোন ব্যক্তি নয়- তা সবার জানা। সীমাহীন ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে সে বিচার চলাকালীন সময়ে। প্রকাশ্যে আদালতে আইনজীবিদের ফাঁসির দড়িতে নিয়ে যাওয়ারও হুমকি দিয়েছে, ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের প্রতি দেখিয়েছে সীমাহীন অশ্রদ্ধা। এ লোকের প্রভাব এখনও বিদ্যমান কারণ সাকা ছিল সাবেক মন্ত্রী, বর্তমানে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা। এমন পরিস্থিতিতে বিচারক ও বিচার ব্যবস্থা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করা এবং তা যুদ্ধাপরাধের বিচারের স্বপক্ষের লোকজনদের দ্বারা যদি সংগঠন হয় তাহলে সে বিশাল এক প্রশ্নবোধক, সন্দেহ নেই।
উচ্চ আদালতের কর্মচারি পর্যন্ত অর্থ প্রলোভন নিয়ে যাওয়া হয়ত সম্ভব না, ফলে অন্য কৌশল যা বিশেষত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের স্বপক্ষের লোকজনদের মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া ও বিচারকদের বিতর্কিত করার অপচেষ্টাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় কি? উদ্দেশ্য যখন বিচার প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সেক্ষেত্রে তা যে কোন উপায়েই সাধিত হোক- এটাই ত সাকা পরিবারের উদ্দেশ্য! এক্ষেত্রে সাকা পরিবার প্রাথমিকভাবে সফল হলেও চুড়ান্ত বিচারে তাদের পরাজয় হয়েছে অ্যার্টনি জেনারেল ও আপিল বিভাগের ভূমিকার কারণে।
আমার ধারণা, রায় নিয়ে আগ্রহ আর উৎকণ্ঠার কারণে আবেগের বশবর্তী হয়ে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ঘটেছে। এবং ভবিষ্যতে আর ঘটবে না- এ থেকে যদি তারা শিক্ষা নেয়। কারণ ব্যক্তির আবেগ আর রাষ্ট্রের সংবেদনশীলতাকে মুখোমুখি দাঁড় করানো উচিত নয়। এ ট্রাইব্যুনাল, এ বিচার প্রক্রিয়া ও বাংলাদেশের বিচারকগণ নিয়েই আমরা আদতে যুদ্ধাপরাধীমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্নই দেখছি।
বিতর্ক সৃষ্টি, বিতর্কিত মন্তব্য এসব কোন সমাধান নয়। মনে রাখা উচিত, দেশের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ বিতর্কিত হয় এমন কিছু লিখা কিংবা বলার সময় তুলনামূলক বিশ্লেষণে গুরুত্বের দিক অনুধাবণ করে রাষ্ট্রকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য