প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আব্দুল করিম কিম | ০৭ মার্চ, ২০২০
রেসকোর্স ময়দান। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের সপ্তম দিন। এ ময়দানে জমায়েত হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। কারখানা থেকে এসেছে তাঁতের শ্রমিক। ঝাঁক বেঁধে এসেছে। ঘামে ভেজা গামছা কাধে কৃষক। প্রয়োজনে পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নেয়ার দৃপ্ত শপথ নিয়ে এসেছে বিদ্রোহী যুবক।খাতা খোলা রেখে কলম হাতে নিয়ে এসেছে তরুণ কবি। সঞ্চয় ভাঙ্গা চলমান জীবনের হুতাশন নিয়ে এসেছে মধ্যবিত্ত ঠিকাদার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এসেছে কপর্দকশূন্য নিম্ন মধ্যবিত্ত– করুণ কেরাণী -এসেছে উদ্বিগ্ন নারী-জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ-স্বপ্নহীন বেশ্যা -ঠিকানাহীন ভবঘুরে। বাঁধ ভাঙ্গা মানুষের জোয়ারে সেদিন ঢাকা শহর ঢাকা পরে যায়।
প্রিয় দল 'আওয়ামী লীগ'কে নিরঙ্কুশ বিজয় ছিনিয়ে এনে দিয়েছে যে মানুষ, সে মানুষের মনে দ্রোহের জ্বালা। এমন বিজয়ের পরেও জাতীয় পরিষদের সভা বসতে দেয়া হচ্ছে না। পাকিস্তানি শাসকগােষ্টির টালবাহানায় মানুষ ক্ষুব্ধ। নিপীড়ন সয়ে সয়ে পিঠ আজ দেয়ালে ঠেকেছে। মানুষ আজ বাঁচতে চায়, বেঁচে থাকার লড়াই শুরু করতে চায়। রেসকোর্সে আজ ক্ষুব্ধ মানুষকে দিকনির্দেশনা দেবেন- বাঙ্গালি জাতির আজন্ম সংগ্রামী নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লক্ষ লক্ষ মানুষের 'জয়বাংলা' শ্লোগান রেসকোর্স ময়দান ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছে। নানা বঞ্চনায় মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ যেন উদগিরণের অপেক্ষায় থাকা আগ্নেয়গিরি । জ্বলন্ত লাভা বিস্ফোরণের অপেক্ষায় টগবগ করছে। সেই লাভা আজ জ্বালামুখ দিয়ে বেড়িয়ে আসবে। রেসকোর্স ময়দানে আজ সেই সব মানুষের মাঝে বাঙালি জাতির ত্রাতা এসে দাঁড়াবেন। অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভূমিধ্বস জয় দিয়ে যাকে রাষ্ট্র পরিচালনায় দেখতে চেয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ; তিনি আজ পশ্চিম পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রের ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আজ তিনি দাঁড়াবেন রেসকোর্সের ময়দানে। জলদগম্ভীর স্বরে সম্বোধন করবেন, ভায়েরা আমার...
সাত কোটি মানুষের বুকে জমা বারুদে আগুন ছুঁয়ে দিলেই সেদিন বাংলার মাটিতে পাকিস্তানি শোষকদের জীবন্ত কয়লা করে দেয়া যায়। এই জনসমুদ্র থেকে ঘোষণা দেয়া যায় 'বাংলাদেশ' নামের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের। কিন্তু তিনি তা করলেন না; একজন বিশ্বনেতার মতই বললেন 'যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলো'। আঘাত এলেই প্রত্যাঘাতের কথা বললেন তিনি। আর বললেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। সেইদিন থেকেই পাকিস্তানিদের অবিচারের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির প্রতিরোধের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ৭ মার্চ বাঙালির ইতিহাসের এক অনন্য উচ্চতার দিন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক সেই ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করতে দেয়নি পাকিস্তান সরকার। প্রায় সাড়ে ৪৬ বছর পর বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণ অমূল্য বিশ্বসম্পদ ও ঐতিহ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করে তা সংরক্ষণ করার এবং বিশ্বকে জানানোর দায়িত্ব নিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো)।
'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম', 'মনে রাখবা-রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব; এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লা'- ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের সেই মহাকাব্যিক দৃপ্ত উচ্চারণ আগে থেকে লেখা ছিল না। এই না লেখা কাব্য স্বভাব কবিদের মত বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি করেন। সেই কাব্য বঙ্গবন্ধুকে আজীবনের জন্য কবিও বানিয়ে দেয়। আর এই কাব্য কবি মুজিবরের কন্ঠেই অনিন্দ্য সুন্দর। অন্য কেউ এই কবিতা আবৃত্তি করতে পারে না, কখনো পারবে না। এই কবিতার জন্য ৭ই মার্চ- ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।
শৈশবে ৭ মার্চের ভাষণ সর্বপ্রথম শুনেছিলাম কোন এক ৭ মার্চে জিন্দাবাজারের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রাঙ্গণে। টেপ রেকর্ডারের সামনে মাইক্রোফোন রেখে চুঙ্গা মাইকে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে বজ্রকন্ঠের সে উচ্চারণ শুনে গায়ের লোম শিহরনে কাঁপে। শুকরিয়া মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই কবিতা শুনি। 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা ।' এতো ভরাট কন্ঠ! এতো জ্বালাময়ী উচ্চারণ! সেই দিন থেকে এই কবিতার প্রেমে পরে যাই। কবির জীবন নিয়ে আগ্রহী হই।
আমাদের শৈশবে 'বঙ্গবন্ধু' নিষিদ্ধ গন্দম। বঙ্গবন্ধুকে জানানোর কেউ ছিল না। তবুও বঙ্গবন্ধুকে জানা হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকে জানবো বলে তাঁর কন্যাকে ভোট দেই। সংসদ নির্বাচনে এই ছিল নিজের দেয়া প্রথম ভোট। একুশ বছর পর আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে। সরকারের শপথ গ্রহণের পরপরই বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রথম শুনি সেই বজ্রকন্ঠে 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা।' সেবারই প্রথম কারো আলোচনায় শুনি বঙ্গবন্ধু সেদিন দুটো সংগ্রামের কথা বলেছিলেন। একটি স্বাধীনতার সংগ্রাম, অন্যটি মুক্তির সংগ্রাম। আমি ভেবেছিলাম, স্বাধীনতার সংগ্রামে জয়ী হওয়া মানেইতো মুক্তির সংগ্রামে জয়ী হওয়া। কিন্তু সেই আলোচনায় আলোচক বলেন, না, মুক্তির সংগ্রাম আলাদা সংগ্রাম। যে সংগ্রামে জয়ী হতে হলে প্রথমে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। আর স্বাধীনতা অর্জন হয়ে গেলেই শুরু হবে মুক্তির সংগ্রাম। সেই মুক্তি হবে মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, সে মুক্তি হবে নিরক্ষরতা থেকে মুক্তি, বঞ্চনা থেকে মুক্তি, সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম' শুনে মাতৃভুমিকে স্বাধীন করতে প্রাণপন লড়াইয়ে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রু মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আমাদের পুর্বসুরিরা। ত্রিশ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ'কে স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলেন কিন্তু 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম'-এর সেই মুক্তি এনে দিতে পারেননি। এদেশের মানুষের জীবনে মুক্তি এনে দিতে বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন দেশে দারিদ্রের বিরুদ্ধে, ক্ষুদার বিরুদ্ধে, ব্যাধির বিরুদ্ধে, অশিক্ষার বিরুদ্ধে, অরাজকার বিরুদ্ধে, দূর্নীতির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন কিন্তু সেই যুদ্ধ শুরু করতে না করতেই তাঁকে স্বপরিবারে হত্যা করে ঘরের শত্রু বিভীষণ। সেই যুদ্ধ আর শেষ হয় না। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অর্ধ শতাব্দী পূর্ণ হতে চলেছে। এতো বছরে ক্ষুধা, দারিদ্র, ব্যাধি, অশিক্ষার বিরুদ্ধে কিছুটা সফলতা পাওয়া গেলেও অরাজকতা, দূর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এখনো সফলতা পাওয়া যায়নি। বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষকে সামনে রেখে এই ৭ মার্চ আমাদের প্রজন্মের শ্রোতা্রা সেই অসমাপ্ত মুক্তির সংগ্রাম শুরুর শপথ নিয়ে 'ক্ষুদার বিরুদ্ধে, দারিদ্রের বিরুদ্ধে, ব্যাধির বিরুদ্ধে, অশিক্ষার বিরুদ্ধে, অরাজকার বিরুদ্ধে, দূর্নীতির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নতুন উদ্যমে লড়াই শুরুর শপথ নিক- সেই শুভ কামনা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য