প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
কবির য়াহমদ | ১৬ মার্চ, ২০২০
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ শীর্ষ তালিকার দেশ। ব্যবস্থাপনার জন্যে দুর্যোগের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হয়। বর্তমানে যা চলছে, তাতে করে করোনা ভাইরাসের মত পরিস্থিতিকে সরকারের বিভিন্ন মহল কতখানি গুরুত্ব দিচ্ছে সে প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রশ্নের কারণ মূলত দুই মাস সময় ধরে বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে আসা নভেল করোনা ভাইরাস সম্পর্কে আমাদের উদাসীনতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নভেল করোনা ভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করলেও বাংলাদেশ এটাকে এখনও ততটা গুরুত্ব দেয়নি। ফলে দুর্যোগকালীন উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থাপনা সরকারের আছে কি না এ নিয়ে সন্দেহ জাগছে।
শুরুতে তিনজনের দেহে নভেল করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়ার পর দুইজন সুস্থ হয়ে যাওয়ায় এই বিশ্বাস আরও জোরদার হয়েছে, যে আমাদের দেশে কিছু হবে না। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) শনিবার বলেছে, দেশে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী নেই। সন্ধ্যায় নতুন দুইজন যোগ হয়েছে। মন্ত্রীগণ বলতে শুরু করেছেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক। কেউ কেউ এখানে আবার প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বকেও সামনে নিয়ে আসছেন। দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ যেভাবে কথা বলতে শুরু করেছেন তাতে করে দেখা যাচ্ছে কেবল প্রধানমন্ত্রীর নাম শুনেই করোনা ভাইরাস দেশে ঢোকার সাহসই পাচ্ছে না। দুঃখজনক চিন্তার দৈন্য, বোধের ঘাটতি আর অসংলগ্ন বক্তব্য। অথচ এমনটা হওয়া উচিত ছিল না।
সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের প্রস্তুতি আছে। চীন, ইতালি, স্পেনসহ বিশ্বের শতাধিক দেশ যেখানে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় হিমসিম খাচ্ছে সেখানে আমরা স্রেফ ভরসা করে বসে আছি আমাদের রাজনীতিবিদ আর কতিপয় দায়িত্বশীলের বক্তব্যেই। কী প্রস্তুতি আমাদের- এ নিয়ে আমাদের যেমন প্রশ্ন নাই, তেমনি তাদের জানানোর গরজও নাই। নেতা-দায়িত্বশীলেরা একদিকে হাওয়াই আশ্বাস দিচ্ছেন আরেকদিকে কতিপয় মোল্লা ধর্মের নাম নিয়ে আজগুবি বার্তাও ছড়াচ্ছে। আর ওসবে মানুষজন বিশ্বাসও করছে। বিশ্বাসের এই ভাইরাসের সংক্রমণে বেকায়দায় পড়তে যাচ্ছে পুরো দেশ।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে এখন ফেসবুক থেকেই সরকারকে তথ্য নিতে হচ্ছে। ফেসবুকের মাধ্যমে সরকারের দায়িত্বশীলরা জানছেন ইতালি থেকে বাংলাদেশিদের নিয়ে ফ্লাইট আসছে। শনিবার সকালে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে করে ইতালি থেকে যে ১৪২ জন বাংলাদেশি ঢাকায় এসেছেন সেই তথ্য আগেভাগে ছিল না সরকারের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত সেই তথ্য কিছু অনলাইন গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে এবং সেখান থেকেই দায়িত্বশীলেরা তথ্য পেয়েছেন। এই তথ্য পেয়ে তারা এয়ারপোর্টে কোনধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই হাজির হয়েছেন। এরপর সেখানে যে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধেছে এর দায় সবাই শুরুতে একবাক্যে কিছু প্রবাসীর ওপর চাপালেও আসলে তাদেরকে কি একপাক্ষিক ভাবে দোষারোপ করা যায়?
ইতালিফেরত বাংলাদেশি কয়েকজনের এমন আচরণ সত্ত্বেও আমি তাদের একবাক্যে দায়ী করছি না কারণ দীর্ঘ বিমানযাত্রার ক্লান্তি নিয়ে কেউ যখন প্রস্তুতিহীন অনেকগুলো মানুষের সামনে পড়ে, যখন মানুষগুলো তাদেরকে নিয়ে প্রস্তুতি কিংবা কোনধরনের পরিকল্পনার কথা জানাতে না পারে তখন তাদের উত্তেজিত হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। তাদের প্রতিক্রিয়া উত্তেজনা না হয়ে আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারত, কিন্তু সেটা হয়নি বলে এখন আমরা একপাক্ষিক ভাবে তাদেরকে দোষারোপ করছি। ইতালিফেরত এই লোকগুলোর অতিরিক্ত উত্তেজনা, নিয়ন্ত্রণহারা বাক্যগুলো আমাদের পীড়া দিয়েছে ঠিক, কিন্তু এর দ্বারা আমাদের প্রস্তুতি বিষয়ক দুর্বলতা, উদাসীনতা, অমনোযোগিতা, অজ্ঞতাকে আড়াল করা যাবে না। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের প্রস্তুতি যখন এভাবে প্রশ্নের মুখে পড়ে এখন সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ জোরদার হয়।
ইতালিফেরত এই যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রথমে আশকোনাস্থ হাজী ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চাইলে তারা আপত্তি জানায়। শেষমেশ জোর করে ওখানে তাদের নিয়ে গেলেও তাদের কেউ কেউ পালিয়ে যেতে উদ্যত হয়। এরপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেনাবাহিনীর সহযোগিতাও নেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হঠাৎই সরকারি সিদ্ধান্ত বদলে তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। তারা ফিরে যায় যার যার বাড়ি। যখন তাদেরকে বাড়ি পাঠানোর সিদ্ধান্তই নিতে হলো তখন মাঝখানে এই জল ঘোলা করার অর্থ কী? কী দরকার ছিল তাহলে হাজী ক্যাম্পে নেওয়ার, নিয়ন্ত্রণ-নিরাপত্তায় সেনা তলবের? এসবের উত্তর নেই। তবে উত্তর না থাকলেও যা বুঝা যায় তা হচ্ছে করোনা ভাইরাসের প্রতিরোধ সম্পর্কিত প্রস্তুতিতে সরকার এখনও সিদ্ধান্তহীনতায়-দোটানায়। তারা কী পদ্ধতি অনুসরণ করবে এ নিয়ে সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি।
যে ১৪২ জন ইতালিফেরত বাংলাদেশিকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হলো তাদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কোথায়? যখন হাজী ক্যাম্পেই রাখতে পারেনি সরকার তখন যাত্রীদের বাড়িতে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? এরা হোম কোয়ারেন্টাইনের শর্ত ও পদ্ধতি যে অনুসরণ করবে সে নিশ্চয়তা কী? এতে করে সত্যিকার অর্থে কেউ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত থাকলে তার মাধ্যমে পরিবার থেকে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার যে শঙ্কা সেটা কিন্তু থাকছেই। শনিবার পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় সহস্রাধিক লোক হোম কোয়ারেন্টাইনে, তাদের বেশিরভাগ যে সেই শর্ত মানছে না সেটা অনেক গণমাধ্যমে এসেছে। ওই ব্যক্তিদের ওপর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা-প্রতিষ্ঠানের কোন নিয়ন্ত্রণ নাই। ফলে অদ্ভুত এক অবস্থা বিরাজ করছে; আশ্চর্য এক উদাসীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যার খেসারত দিতে হতে পারে বাংলাদেশকে। ইতালিফেরত যাত্রীদের বেশিরভাগই ওখানকার কোয়ারেন্টাইনে ছিলেন এমন যুক্তিকে এখানে প্রাধান্য দেওয়া উচিত না। নভেল করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে এখন পর্যন্ত কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় সন্দেহভাজন যে কেউ একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আক্রান্ত হতে পারেন। এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও তাদেরকে ছেড়ে দিয়ে দায় এড়িয়ে যাওয়া উচিত হয়নি। এটা সরকারের প্রস্তুতিহীনতা, পরিকল্পনাহীনতাকে সামনে এনে দেয়।
নভেল করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে জনসমাগম এড়াতে মুজিববর্ষের মত মেগাইভেন্ট স্থগিত করতে হয়েছে সরকারকে। এখানে জনস্বাস্থ্যের দিককে উল্লেখ করা হলেও জনস্বাস্থ্যের দিক বিবেচনায় দেশের মধ্যে থাকা জনসমাগমকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না। এখনও স্কুল-কলেজে যাচ্ছে শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা। গণপরিবহন-হাটবাজার সেই আগের মতই। ওখান থেকে কেউ একজনও আক্রান্ত হলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, ভাবা যায়? আমরা সম্ভবত অপেক্ষা করে বসে আছি শতাধিক আক্রান্তের পর এ নিয়ে কিছু করার। নিরাময়ের চাইতে প্রতিরোধ যে সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা এই বোধটুকু দায়িত্বশীলদের জাগ্রত হচ্ছে না।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) সংবাদ সম্মেলন করে মিডিয়াকে জানাচ্ছে দেশের নভেল করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত সর্বশেষ তথ্য- এই আমাদের প্রস্তুতি। এখানে-ওখানে কোয়ারেন্টাইন সেন্টার, আইসোলেশন ইউনিট আছে এই কথাগুলোর মধ্যেই কি সীমাবদ্ধ আমাদের প্রস্তুতি? হোম কোয়ারেন্টাইনে না পাঠিয়ে দায়িত্ব নিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় রাখতে কেন আগ্রহী হচ্ছে না সরকার? এইসব প্রশ্নের উত্তর নেই।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যেন পাঁচজন নভেল করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া গেছে তাদের সকলেই নিজেদের আক্রান্তের খবর জানিয়েছেন। এরপর সরকার তাদেরকে চিকিৎসা- পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। এই পাঁচজনের মত সকলেই যে তথ্যগোপন করবে না সে নিশ্চয়তা কোথায়? ইতালিফেরত ১৪২ বাংলাদেশি যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, এর আগে সিলেটের হাসপাতালে ভর্তি এক বৃদ্ধা করোনার সন্দেহ চিকিৎসকেরা প্রকাশের পর যেভাবে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেছেন তখন এই উদাহরণগুলোই সামগ্রিক চিত্র। এই পাঁচ ব্যতিক্রম বাদে বাকিরা ত ইতালিফেরত কিংবা ওই বৃদ্ধার মতই মানসিকতায় অভ্যস্ত।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা শুরুর দরকার। সরকারকে বিষয়টি নিয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কেবল হাওয়াই আশ্বাস এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। হাওয়াই আশ্বাসে আমরা বিশ্বাস করে এসেছি আমরা প্রস্তুত, কিন্তু বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া আর প্রস্তুতিহীন অবস্থার প্রকাশে কাল সেটা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে। প্রমাণ হয়ে গেছে আদতে আমরা প্রস্তুতিহীন, ‘অলৌকিক কিছু হবে’ এই বিশ্বাসে আমরা বন্দি ও বন্দী।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য