প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রণেশ মৈত্র | ২৫ মার্চ, ২০২০
সারা পৃথিবীই বেশ কিছুদিন হলো এক মারাত্মক ভাইরাসে আক্রান্ত। যত উন্নত দেশ, সেখানেই তত বেশি মৃত, আক্রান্ত তার বহু গুণ বেশি। নাম করোনা ভাইরাস (কভিড-১৯) যা আমি অন্তত আমার দীর্ঘ ৮৭ বছরের জীবনে এ যাবত শুনিনি। এই বিশ্ব পরিস্থিতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতেও ভয়াবহ। আমেরিকা সরার দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছে ঐ ভাইরাসজনিত কারণে। ইংল্যান্ডে নির্বাচন এক বছরের জন্য স্থগিত-আক্রান্তও অনেকে। ফ্রান্স-জার্মানিতেও তাই। ইটালি সবাইকে ছাড়িয়ে এক মহাআতংক ছড়িয়েছে বিপুল সংখ্যক মৃত্যু ও বহু সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হওয়ার কারণে। ইরানের অবস্থা ভয়াবহ। চীন তো ভয়াবহতম এবং বলা যায় করোনা-ভাইরাসের তারাই উৎপাদক।
বাংলাদেশ, সৌভাগ্যবশত করোনা ভাইরাসে আজও মারাত্মক তো নয়ই উল্লেখযোগ্যভাবেও আক্রান্ত হয় নি। জানি না পরিস্থিতি বাংলাদেশে কখন কেমন দাঁড়াতে তবে সতর্কতা এবং প্রতিরোধ প্রস্তুতি কতটা তা সঠিকভাবে না জানা থাকলেও আক্রান্তের আশংকা পুরোপুরিই বিদ্যমান।
কিন্তু বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম জেলা শহরে কর্মরত সাংবাদিকবৃন্দ ডিসি ভাইরাসে ভয়ানকভাবে আক্রান্ত। ভাইরাসটি এমনই কল্পনাতীত যে সেখানে কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনের সংবাদদাতা আরিফুর রহমানের বাড়িতে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশ পাঠিয়ে গভীর রাতে তাদের দ্বারা ঐ সাংবাদিকের শোবার ঘরের দরজা ভেঙে ঠুকে তাকে তুলে নিয়ে এসে তাৎক্ষণিকভাবে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে আরিফুর রহমানকে এক বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে জেলে পাঠানো হয়।
আরিফুর রহমানের ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুযোগ কদাপি ঘটেনি-সম্ভবত ঘটবেও না। কিন্তু ডিসি’র অপকর্মের বিরুদ্ধে সাহস করে খবর প্রকাশ করায় তাকে দূর থেকে অভিনন্দন জানাই। কী অসাধারণ ক্ষমতাধর কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক পারভীন সুলতানা। তিনি চাইলেন সেখানকার একটি পুকুর খনন করে তার নাম পারভীন সুলতানা সরোবর। একটি মৌলিক চিন্তা নিঃসন্দেহে। কিন্তু এই মৌলিক চিন্তার মৌলিকত্ব অনুধাবন না করে সাংবাদিক আরিফুর রহমান তার বিরোধিতা করে খবর বের করলেন। তা ছাড়াও ঐ জেলা প্রশাসকের কথিত কর্মকর্তার দুর্নীতির খবরও তিনি প্রকাশ করলেন।
একবিংশ শতাব্দীর সিকিভাগে পৌঁছে জনগণের সেবকের দায়িত্বে এসে জেলা প্রশাসক পারভীন সুলতানা আরিফুর রহমানকে একটা উচিত শিক্ষা দিতে অগ্রসর হলেন। সাংবাদিকের বাড়িতে গভীর রাতে কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও আনসার পাঠিয়ে ঘুমন্ত আরিফুর রহমানের শোবার ঘরের দরজা ভেঙে তাকে তুলে আনালেন। অতঃপর ঐ রাতেই বসানো হলো ভ্রাম্যমাণ আদালত। ঐ আদালত এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫০,০০০/= টাকা জরিমানার আদেশ দিয়ে আরিফকে পাঠিয়ে দিলেন কারাগারে ঐ রাতেই।
মুজিববর্ষে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পূরণ হবে ১৭ মার্চ। তা ঐ জেলা প্রশাসক জানেন। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বলেও জানা গেল। তিনি নিশ্চয়ই ঘটা করে বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী যথাযথভাবে উদযাপনের প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। যদি ঐদিন পর্যন্ত তিনি কুড়িগ্রামে কর্মরত থেকে যেতে পারেন যার কোন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না তবে নিশ্চয়ই তিনি সহস্র কণ্ঠের সাথে নিজের কণ্ঠ মিলিয়ে ভাষণ দেবেন বঙ্গবন্ধুর জীবনী, তাঁর কর্ম ও নীতি আদর্শ প্রভৃতি সম্পর্কে।
কিন্তু সুলতানা পারভীন কি জানেন, বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের ও সাংবাদিকতার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন এবং অবিরাম সংগ্রাম করে গেছেন? অবশ্য সে কারণে তিনি দফায় দফায় সুদীর্ঘ কারাজীবনও ভোগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
সুলতানা পারভীনের তো ভালভাবেই জানার কথা যে অমনতরো কারাদণ্ড বঙ্গবন্ধুকে এতটুকুও কাবু করতে পারে নি। তিনি তাঁর অগণিত সহকর্মীও সহযোদ্ধা এবং জনগণকে সঙ্গে করে সংগ্রাম চালাতে চালাতে দেশি বিদেশি সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে ১৯৭১ এ এসে দূরদেশের কারাগারে থেকেও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সফল নায়ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এসব কারণেই তো মানুষ তাঁকে বঙ্গবন্ধু খেতাবে সম্মানিত করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর লড়াই-সংগ্রাম-আন্দোলন ও তাতে বিজয় অর্জনের পর এখন সুলতানা পারভীনরা সেই লড়াই এর বেনিফিসিয়ারি হয়েই ডিসি হতে পেরেছেন এবং হয়তো বা আরও অনেক উপরের নানা পদ মর্যাদায়ও স্থান করে নিতে পারবেন। কিন্তু সাংবাদিক আরিফুর রহমান যখন অসংকোচে সত্য প্রকাশের করে তাঁর জেলার ডিসি’র অপকর্মের, ক্ষমতা অপব্যবহারের বিরুদ্ধে দু’কলম লেখেন ও তা প্রকাশিত হয় তখন সুলতানা পারভীন ও তাঁর মত ডিসিরা বা অপরাপর ছোট-বড় আমলাদের একাংশ তা সইতে না পেরে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে বে-আইনি এবং ক্ষমতা-বহির্ভূত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র পরোয়া করেন না। তাই আরিফুর রহমানেরা হন নিগৃহীত, নির্যাতিত এবং নির্মম অত্যাচারের শিকার।
লিখতে বসে এই পর্যায়ে এসে টেলিভিশনের নানা চ্যানেল প্রচারিত খবরে জানতে পারলাম সাংবাদিক আরিফুর রহমানকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, ডিসি সুলতানা পারভীনকে বাংলাদেশ সরকারের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন এবং ঐ ডিসির বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এবারে দেখা যাক, ঐ রাতে বস্তুত: কুড়িগ্রামে কী ঘটেছিল? দৈনিক সমকাল গত ১৫ মার্চের সংখ্যায় শেষ পৃষ্ঠায় “সাংবাদিককে গভীর রাতে তুলে নিয়ে জেল. জরিমানা” দুই কলাম ব্যাপী শিরোনামে যে বর্ণনা প্রকাশ করেছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নীচে তুলে ধরছি: “কুড়িগ্রামে বাংলা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে “মাদক-বিরোধী অভিযানে” আটক ও পরে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই সঙ্গে তাঁকে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। গত শুক্রবার, ১৩ মার্চ রাত ১২টার দিকে কুড়িগ্রাম শহরের চড়ুয়া পাড়ার বাড়ি থেকে আটকের পর তাঁকে এ সাজা দেওয়া হয়। আরিফুলের স্ত্রী মোস্তারিমা সরদার বলেছেন, মাঝ রাতে দরজা ভেঙে বাড়িতে ঢুকে আরিফকে পেটানো ও জোর করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কোন মাদক পাওয়া যায় নি। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ এবং ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে প্রশাসনের লোকজন আরিফুলকে এভাবে তুলে নিয়ে যায়। জানা গেছে, শুক্রবার রাতে কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রিন্টু বিকাশ চাকমার নেতৃত্বে কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আনসার সদস্যদের একটি টিম আরিফুল ইসলামের বাড়িতে যায়। এরপর মারধর করতে করতে তাকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে তার পোশাক খুলে দুচোখ বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে। এসব ঘটনার নেতৃত্ব দিয়েছেন ডিসি কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার নাজিমুদ্দিন। এরপর আরিফুলকে মাদক বিরোধী অভিযানে আটক ও পরে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়ে জেল হাজতে পাঠান ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ঘটনা এটুকুই। কিন্তু এর সাথে জড়িত বহু প্রশ্ন।
এক. তাহলে অপরাধী কে? জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন?
দুই. যদি সাংবাদিকে অপরাধী হয়ে থাকেন অর্থাৎ যদি তিনি মিথ্যা সংবাদ প্রকাশ করে থাকেন এবং মাদক দ্রব্য ঘরে রেখে থাকেন তবে যা যা ব্যবস্থা আইনত বাধ্যতামূলক তা কি সরকারিভাবে গৃহীত হয়েছিল?
তিন. রাতের বেলায় সাংবাদিক বা যে কোন নাগরিকের বাড়িতে কি সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া কোন পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট বা অন্যকোন সরকারী কর্মকর্তা আইনত ঢুকতে পারেন?
চার. কোন নাগরিকের ঘরে রাতের বেলায় ঢুকে কি কোন সরকারি লোক কারও ঘরের দরজায় ভেঙে ঘরে অনুপ্রবেশ করতে ও তাঁকে মারধর করাসহ জোর করে তুলে নিয়ে যেতে পাবেন?
পাঁচ. ঐভাবে কোন সাংবাদিক বা নাগরিককে কালেক্টরেট বিল্ডিং এ রাতের বেলার তুলে নিয়ে তাঁর কাপড় খোলার মত অশ্লীল, বিকৃত কোন পদক্ষেপ করা যায়? যদি তিনি প্রকৃত অপরাধী হন তবুও কি এগুলি করার আইনগত কোন সুযোগ আছে?
ছয়. সাংবাদিক আরিফুলের ঘর থেকে মাদক দ্রব্য কি সত্যই উদ্ধার হয়েছিল? হয়ে থাকলে তার Seizure List কোথায়? তাতে বেসরকারি সাক্ষী এবং সরকারী সাক্ষী হিসেবে কে কে স্বাক্ষর করেছেন?
আরিফুলের বিরুদ্ধে আনিত সকল অভিযোগই ভিত্তিহীন। তাই তাঁর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাটিরও কোন আইনগত ভিত্তি না থাকায় বিনাশর্তে মামলাটি প্রত্যাহার যোগ্য হওয়ায় অবিলম্বে তা প্রত্যাহার করে নিয়ে আরিফুলের পূর্ণ স্বাধীনতা (আদালতে হাজিরা প্রভৃতি থেকে অব্যাহতি) দেওয়া হোক; এবং ডিসি সুলতানা কামাল কেন মারাত্মক অপরাধ সমূহে দোষী হওয়া সত্বেও কেন শুধুমাত্র কুড়িগ্রাম থেকে প্রত্যাহার ও “বিভাগীয় মামলা” নামে লোক দেখানো ব্যাপার করা হবে। যা প্রয়োজন তা হলো, সুলতানা পারভীনের বিরুদ্ধে (১) ক্ষমতার অপব্যবহার; (২) মিথ্যা অজুহাতে সাংবাদিক নির্যাতন; (৩) সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের মানহানি; (৪) সাংবাদিকের বাড়িতে রাতের বে-আইনিভাবে একদল ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ আনসার পাঠিয়ে অনুপ্রবেশ করিয়ে দরজা ভাঙ্গার ক্ষতিপূরণ প্রভৃতি নির্দিষ্ট অভিযোগে অবিলম্বে ফৌজদারি মোকদ্দমা দায়ের করা।
এই সকল পদক্ষেপই পারে নাগরিকদের নিরাপত্তা ও অধিকার সংরক্ষণ করতে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য