আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

করোনাকালে ক্ষুধার ধর্ম

মাসকাওয়াথ আহসান  

করোনায় গৃহবন্দি জীবন মেনে নিয়ে 'নিউ নরমাল' জীবন যারা যাপন করছে; তারা স্বাভাবিকভাবেই বিস্মিত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার কিছু সংখ্যক মুসলমানের মসজিদে নামাজ পড়তে যাবার জেদ দেখে। কিছু সংখ্যক হিন্দুর পুণ্যস্নানে জমায়েত দেখে। যুক্তরাষ্ট্রে কিছু সংখ্যক খ্রিষ্টানের চার্চে জমা হবার প্রবণতা কিংবা ইজরায়েলের কিছু সংখ্যক ইহুদির সিনাগগে জমা হবার জেদও বিস্মিত করেছে বিপন্ন বিশ্ববাসীকে।

অথচ খ্রিস্ট ধর্মের পীঠস্থান ভ্যাটিকানের প্রার্থনার উঠোনের পাশে উদাস মুখে প্রার্থনা করেছেন পোপ একা। ইসলাম ধর্মের পীঠস্থান মক্কার কাবাগৃহে প্রার্থনার উঠোনে একা বসে প্রার্থনা করেছেন কাবা-গৃহের ইমাম।

ভ্যাটিকান সিটি কিংবা মক্কার মানুষকে করোনা কালের সামাজিক দূরত্বের প্রয়োজন সম্পর্কে যতটা সহজে বোঝানো গেলো; দক্ষিণ এশিয়ায় কিংবা এমেরিকার কিছু মানুষকে তা বোঝানো কঠিন হচ্ছে কেন! সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন।

যেখানে রাষ্ট্র সামাজিক নিরাপত্তা ও মৌলিক চাহিদা পূরণ করে; সেখানে যে কোন জরুরি পরিস্থিতিতে আইন মেনে চলার সামাজিক বোধ ক্রমে ক্রমে তৈরি হয়ে যায়।

যে মানুষটির পাশে রাষ্ট্র নেই; অনাথ সেই মানুষটির সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কোন আশ্রয়ই থাকে না। রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক নিষ্ঠুর আচরণের কারণে যে মানুষটি নিরন্তর দারিদ্র্যে জীবন কাটান; জরুরি সময়ে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকে না। কেননা সারাক্ষণ ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করতে করতে তার চিন্তা করার ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে।

করোনার বিপজ্জনক সময়ে আশা জেগেছিলো; হয়তো ভোগ- বিলাসিতা আর দম্ভের ম্যালোম্যানিয়ায় বেড়ে ওঠা মানুষেরা আত্মসমালোচনা করবে। করোনা যখন দিকে দিকে জীবনের শুল্ক নিচ্ছে; মানুষ তখন প্রায় 'অচল' মানবতা শব্দটির অর্থ নতুন করে উপলব্ধি করবে।

যারা মানবতা বিষয়টিকে সহজাতভাবেই উপলব্ধি করেন; তারা করোনার গ্রহণকালে মানুষকে বাঁচাতে সচেষ্ট। করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধের সৈনিক ডাক্তার-নার্স-অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী এই অশনি সময়ে মানবিক প্রত্যাশার পতাকা উড়িয়েছেন। মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গের এমন অনন্য দৃষ্টান্ত বিরল।

কিন্তু করোনার কালে একটি আশ্চর্যজনক প্রবণতা দৃশ্যমান। সামাজিক সঙ্গ নিরোধের গুরুত্ব না বুঝে মসজিদে ছুটে যাওয়া মানুষ; কিংবা পুণ্যস্নানে ছুটে যাওয়া মানুষের বুদ্ধিহীনতা দেখে; রুটিন ইসলামোফোবিয়া ও হিন্দুফোবিয়ার ক্লিশে মানসিক দ্বন্দ্বে কোয়ারিন্টিনের একঘেয়েমি কাটাতে চেষ্টা করছে দক্ষিণ এশিয়ার অপেক্ষাকৃত স্বাস্থ্যবান; পাকস্থলী ভরপুর সৌভাগ্যবান নাগরিকেরা। যে শুধু করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে সে কী করে বুঝবে যে মানুষ ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করছে; তার জীবনের ট্র্যাজেডি। যে রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী নাগরিক নয়; তার তো আল্লাহ বা ভগবান ছাড়া আর কেউ নেই।

রাষ্ট্রের সুবিধাভোগী যারা কোয়ারিন্টিন নিষেধাজ্ঞা ভেঙে সমুদ্র সৈকতে জলকেলি করেছে কিংবা করোনা ডিজে পার্টি থ্রো করেছে; তার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে। কিন্তু দারিদ্র্যে বিশীর্ণ যে মানুষ কোয়ারিন্টিনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রার্থনা গৃহে যেতে চাইছে; তাকে সমালোচনা না করে বরং রাষ্ট্র ও এর সুবিধাভোগী অংশকে আত্মসমালোচনা করতে হবে। কতোটা বৈষম্যের মাঝে বেড়ে উঠলে একজন মানুষ করোনা দৈত্যকে ভয় না পেয়ে জমায়েতের চেষ্টা করতে পারে।

দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলো খুব আত্মকেন্দ্রিক ও মোহরমুখী মানুষ তৈরি করে। এরা শুধু নিজেকে নিয়ে চিন্তিত। করোনা ভাইরাস থেকে সে আর তার পরিবার বেঁচে গেলে সে সুখি। এটাই তার জীবন চর্যা। সারা বছর সে শুধু নিজেকে আর নিজের পরিবার নিয়ে চিন্তা করে।

দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক গতিশীলতায় কেউ দরিদ্র থেকে একটু ধনাঢ্য আর শিক্ষিত হলেই; সে একটা অভিজাত ভঙ্গি রপ্ত করে দরিদ্র মানুষকে দাস ভাবতে শুরু করে। সামাজিক রক্ষাকবচের ভেতরে কিছুকাল অবস্থান করেই সে ভুলে যায় সামাজিক নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকারহীন জীবনের কথা।

সব সময় যারা ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করছে; তার জন্য করোনার সঙ্গে লড়াই একটা বিলাসিতা। এই সহজ সত্য দক্ষিণ এশিয়ার নব্য শিক্ষিত- নব্য ধনিক ও নব্য আধুনিকদের বোঝানো খুব কঠিন। কারণ তার চিন্তা করোনা ভাইরাস আর গৃহবন্দি জীবনে চর্বি কী করে ঝরাবে তা নিয়ে। কিংবা সে মনের ডাক্তারের কাছে অনলাইন কাউন্সেলিং নিচ্ছে, কী করে মনকে শান্ত রাখবে। অন্যদিকে দরিদ্র মানুষের পেট শান্ত রাখার লড়াই।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ