প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ০৯ এপ্রিল, ২০২০
আমাদের জীবনে ডাক্তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। শৈশবে অসুখ-বিসুখ হলে ডাক্তারের কাছে গেলে; উনি স্ট্রেথো লাগিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দুটো ওষুধ লিখে দিলে; তা খেয়ে সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে জাদুকর মনে হতো। সামান্য ফি'য়ের বিনিময়ে মানুষকে সুস্থ করে তোলার এই যে সেবামূলক পেশা; তার চেয়ে আনন্দের তো কোন পেশাই হতে পারে না।
বিটিভিতে যতদিন হুমায়ূন আহমেদের নাটক হতো; ততদিন পর্যন্ত আমাদের সাদাসিধে বসার ঘর ছিলো। এরপর বিটিভির নাটক সরিয়ে দিয়ে আমাদের জীবনে ঢুকে পড়লো প্যাকেজ নাটক। সেই প্যাকেজ নাটকে বসার ঘরের সাজসজ্জা বদলে গেলো। বদলে গেলো আমাদের জীবন।
এরপর ডাক্তারের কাছে গিয়ে দেখলাম; তার চেম্বারের সাজসজ্জাতেও প্যাকেজ নাটকের জেল্লা এসেছে। ডাক্তারের ফি বেড়েছে। ডাক্তারের চেম্বারের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা ভেসপাটি নেই; সেখানে দাঁড় করানো টয়োটা করোনা।
মিডিয়ার বিজ্ঞাপনের ইলিউশন আমাদের স্বপ্নের আকাশ কেড়ে নিতে থাকলো। বাগানওয়ালা একতলা বাড়ি ভেঙে তৈরি হলো বহুতল এপার্টমেন্ট। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণদের সামনে 'এমেরিকান ড্রিম' ধরা দিতে থাকলো হলিউডের ছবির ইলিউশানে।
এসময় পেপসোডেন্টের বিজ্ঞাপনে যে ডাক্তারটি এসে নিজের সাজানো ঝলমলে দাঁতে টোকা দিয়ে টুথপেস্ট বেচতেন; তিনি দেখতে হলিউড ফিল্মের ডাক্তারের মতো।
এমেরিকায় দারিদ্র্যে বিশীর্ণ মানুষকে প্রায় পাতালে লুকিয়ে রেখে যে ঐশ্বর্য আর বিত্ত-বৈভবের স্বপ্ন দাপিয়ে বেড়ায়; তা আমাদের সমাজের ক্ষেত্রে ঘটতে থাকলো। বিত্ত বৈভবের খোঁজে মানুষ দেশান্তরী হতে শুরু করলো।
বিদেশ থেকে নতুন বিত্তের মালিকেরা যখন দেশে ফিরতো; তখন তাদের মধ্যে একটা 'সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্ট' কাজ করতো। তাদের মধ্যমণি করে সাফল্যের গল্প শুনতে হতো।
ঠিক এসময় শ্রমিক ঠকিয়ে নব্য বড়লোক হবার আরেক সাফল্যগাথা গার্মেন্টস শিল্পপতি তৈরি হতে থাকলো। বাংলাদেশের চেয়ে সস্তায় কাপড় তৈরির আর কোন স্বর্গ নেই। শ্রমিকের জীবনের মূল্য আগের চেয়েও সস্তা হয়ে পড়লো।
রূপান্তরই সমাজের নিয়ম। কিন্তু আমাদের সমাজ রূপান্তর একটি নিষ্ঠুরিকরণ প্রক্রিয়ার বেশি কিছু নয়। 'ঢাকায় যখন টাকা' উড়তে শুরু করলো; তখন ক্রমে ক্রমে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়লো ঢাকা শহর।
একটা সমাজের সব পেশার মানুষ যখন হলিউডের প্রাসাদোপম বাড়িঘর আর বলিউডের বিলাসী বিগ ফ্যাট ওয়েডিং-এর স্বপ্নে বিভোর হলো; তখন কৃষক- শ্রমিকদের মতো করে শিক্ষক ও ডাক্তাররা সমাজের সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে থাকলেন।
ব্যবসায়ী-রাজনীতিক-প্রশাসন-পুলিশ এরা সমাজের মাথার ওপর দাঁড়িয়ে মানুষের জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে শুরু করলো। দেশের বিভিন্ন জায়গায় রাজনীতি ও প্রশাসনের লোকেরা শিক্ষক ও ডাক্তারদের ওপর তাদের দম্ভের ছড়ি ঘোরানো শুরু করলেন।
ক্লাসের সবচেয়ে আন্তরিক ও অধ্যবসায়ী ছাত্ররা প্রতিদিন অপমানিত হতে থাকলেন। জাতির মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের দেখভাল করেন যারা; সেই শিক্ষক ও ডাক্তার হারিয়ে গেলেন নৈরাশ্যের অন্ধকারে।
'যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন মডেল' টেকসই নয়; পরিবেশ-বান্ধব নয়; এটা বোঝার মতো শিক্ষা-দীক্ষা-বোধ অনুপস্থিত আমাদের নীতি-নির্ধারণী মহলে। জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজের যেহেতু মৃত্যু ঘটেছে; কাজেই টেকাটুকাভিত্তিক খর্বচিন্তার মানুষেরা তাই রোল মডেল হয়ে উঠলেন। তারা তাদের মোটিভেশনাল সভাসদদের দিয়ে 'সিক্স ডিজিট স্যালারি' বিদেশে বেড়াতে গিয়ে বাঞ্জি জাম্পিং-এর রোমাঞ্চের স্বপ্ন গেঁথে দিতে থাকলো কিশোর-কিশোরীদের মনে।
উল্লেখ্য যে দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য-ব্যবস্থাকে আত্মকেন্দ্রিক-স্থূল নীতি নির্ধারকদের কখনোই অগ্রাধিকার মনে হয়নি। কারণ তারা তাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিকে পশ্চিমে পড়িয়েছে; নিজেরা একটু সর্দি-জ্বর-শ্বাসকষ্ট হলে ছুটে গেছে উন্নত দেশের হাসপাতালে।
ঠিক এরকম একটি শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অবহেলার মলিন সমাজে; জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে পশ্চিমা দেশে নিজেদের জন্য 'সেকেন্ড হোম' বানিয়েছে নরভোজী ক্ষমতা ও সুবিধা কাঠামোর লোকেরা। এরা দরিদ্র সমাজ থেকে ক্ষমতার ক্যাসিনোতে জুয়া খেলে নব্য ধনী সমাজে উঠে আসায়; নতুন চর্বিতে জমে থাকা মনের দারিদ্র্যের নির্মমতায় 'গরীব নিয়ে' মাংসের কারবার চালিয়ে যায় অবিরত।
'টাকা দ্যান দুবাই যামু' স্লোগানে মাতোয়ারা অনন্যোপায় বিদেশে মানবেতর জীবনের চাকায় পিষে যাওয়া দাসশ্রমিকের পাঠানো রেমিটেন্স; 'রানা-প্লাজা'র ধসে চাপা পড়া সহস্র শ্রমিকের 'হীরার খনি'-র হতভাগ্য কর্মীদের উপার্জিত রপ্তানির টাকায় তৈরি করা জিডিপির তাজমহল নিয়ে প্রতিদিন উচ্ছ্বসিত মন্ত্রী-সেপাই-এর আত্মতুষ্টির খোয়ারির আড়ালে যে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাটি টিকে আছে; এ হচ্ছে জিডিপির রেশমি শাড়ি জড়ানো নূপুর পরা রানাপ্লাজার মৃত সেলাইবুবুর কংকাল।
কাজেই করোনা কাল আমাদের আত্ম-উপলব্ধির সময়। মানবিক উন্নয়ন কেমন হয়; তা বুঝে দেখার সময়। 'আমি যা বুঝি তাই ঠিক' এই গোঁ থেকে বেরিয়ে এসে জীবনের স্কুলে আবার ভর্তি হবার সময়।
অন্তত এতটুকু আশা বোধ হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও করেছিলেন, এই করোনার মৃত্যু মড়কের মাঝে 'বঙ্গবন্ধু'-র আক্ষেপের 'চোরের খনি'টি হয়তো ত্রাণ চুরি করবে না। কিন্তু 'রূপের রাণী চোরের রাজা'-রা যে সমাজে সাফল্যের সংজ্ঞা; সেখানে চুরি বন্ধ করবে এ সাধ্য কার!
রোগী হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে ডাক্তার না পেয়ে মারা গেছে; এ খবরে বেদনাহত প্রধানমন্ত্রী; ডাক্তারদের মাঝে যারা দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য দেখিয়েছেন; তাদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
অন্যদিকে পথে-ঘাটে ডাক্তারকে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে পুলিশি হেনস্থা; প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে আশার সওদাগর রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসন-পুলিশের কাল্পনিক আপডেট জানানোর সময়; এই মুহূর্তে করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সম্মুখ সমরে থাকা ডাক্তারদের দুটি কথা বলার সুযোগ অনেক দেরিতে আসার মাঝে 'প্রতিরোধ পরিকল্পনা'র অবাস্তবতা ধরা পড়ে।
করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতা- প্রশাসন-পুলিশ ক্রিকেট মাঠের ভিআইপি গ্যালারিতে বসে থাকা দর্শক আর নিরাপত্তা-কর্মীদের মতো গুরুত্ব রাখেন। ডাক্তার গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেট ম্যাচের ক্রিকেট খেলোয়াড়ের মতো। আর ম্যাচ চলার সময় খেলোয়াড়কে ধমকা-ধমকি কোন কাজের নয়।
করোনাকালে ডাক্তারের ভূমিকা; নিঃশেষে প্রাণদানে প্রস্তুত নায়কের মতো। করোনার বিরুদ্ধে সম্মুখ-সমরের নায়ক ডাক্তারদের অভিবাদন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য