প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ২৪ এপ্রিল, ২০২০
বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বিষয়ক ২০২০ সালের সূচক প্রকাশ করেছে ‘রিপোটার্স উইদাউট বডার্স’। তাতে গত বছরের তুলনায় এ বছর এক ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। রয়ে গেছে সাংবাদিক ও সংবাদ মাধ্যমের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ রেড জোনে। বাংলাদেশের চেয়ে কয়েকধাপ ওপরে থাকলেও ভারত-পাকিস্তান রয়েছে রেডজোনেই।
যে দেশে মিডিয়ার স্বাধীনতা আছে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। কেননা মিডিয়ার মাধ্যমে সরকার প্রতিমুহূর্তে খাদ্য সংকটের খোঁজ-খবর পায়; দ্রুত ক্ষুধার্তের কাছে খাদ্য পৌঁছে দিতে পারে।
করোনা মহামারী একদিকে ঘাতক ভাইরাস অন্যদিকে ক্ষুধায় মানুষের মৃত্যুর এক বিভীষিকা মেলে ধরেছে। দেশে দেশে সরকারগুলো ব্যস্ত করোনা ভাইরাস ও ক্ষুধার বিরুদ্ধে অতন্দ্র প্রচেষ্টায়। মানুষের জীবন বাঁচানোর চেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই।
দক্ষিণ এশিয়ায় করোনাভাইরাস সম্পর্কিত সচেতনতার অভাব নীতিনির্ধারক ও নাগরিক উভয় পর্যায়েই প্রকটভাবে থাকাতে; এ অঞ্চলে একটু ঢিলেঢালাভাবে করোনাভাইরাস ও ক্ষুধার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রচেষ্টার শুরু হয়েছে।
এতো বিশাল জনসংখ্যার উপমহাদেশ; অত্যন্ত সীমিত অর্থনৈতিক সামর্থ্যের রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে করোনার মতো মহাবিপদে সাড়া দেয়া কঠিন। আর দেশগুলোর নীতি-নির্ধারক পর্যায়ের 'তথ্য-গোপন' ও 'সত্য-অস্বীকার' করার ধারাবাহিক অপসংস্কৃতির কারণে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার করোনা মহামারীর ফলাফল।
ইন্টারনেট যুগে 'সত্য অস্বীকার বা গোপন' করা; 'তথ্য ধামাচাপা' দেবার ইচ্ছা ও চেষ্টা খুবই অপ্রাসঙ্গিক। আর মনে রাখা দরকার; দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সরকারগুলোকে ক্ষমতা ধরে রাখা ও উন্নয়নের বিজ্ঞাপন নির্ভর সাফল্য প্রদর্শন করার ক্ষেত্রে যে 'তথ্য গোপন' ও 'সত্য অস্বীকার' জাতীয় কলাকৈবল্য দেখাতে হয়; সেগুলো করোনাকালে স্থগিত রাখাই যৌক্তিক। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প আর ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি বলসোনরো ছাড়া আর কাউকে করোনার মৃত্যু-মড়ককালে নির্বাচন বা ক্ষমতা নিয়ে চিন্তিত হতে দেখা যায়নি।
মানসিকভাবে বিভ্রান্ত ও প্রায় নরভোজী মানুষ ছাড়া করোনাকালে 'ক্ষমতা নিয়ে ভাববে না'। কেননা এখন মানুষের জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। করোনাভাইরাসের মতো অদৃশ্য শত্রু লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে গণহত্যায়।
কাজেই দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষমতা কাঠামোর লোকেরা; যারা ক্রিকেট খেলার আদলে রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনা নিয়ে খেলেন; আর তার চারপাশে ক্ষমতার চিয়ার লিডাররা উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে যে সাফল্য উদযাপন করেন; সেটা স্থগিত রাখার সময় এসেছে। এখন ওসব ছেলেখেলা দেখার সময় কারো হাতে নেই। ডাক্তার-নার্সরা করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে রয়েছেন। মানুষের জীবন বাঁচানোর এ লড়াইয়ে রয়েছেন পুলিশ-প্রশাসন-সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সাংবাদিকরা নিরলস কাজ করছেন, জনমানুষের স্বাস্থ্য ও ক্ষুধা-পরিস্থিতিটি কেমন তা তুলে ধরতে। এই মানুষ বাঁচানোর লড়াইয়ে প্রত্যেক পেশার মানুষ অন্যান্য পেশার মানুষের সহযোগীর ভূমিকায়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থাকায়; প্রতিটি মানুষই নাগরিক সাংবাদিকের ভূমিকা পালন করছে। করোনা এমন ভয়াবহ বাস্তবতা যে, পৃথিবীতে এমন কোন গুজব বা প্রোপাগান্ডা নেই যা এসে সে বাস্তবতায় এতোটুকু হেরফের ঘটাতে পারবে।
করোনার সময় যে দেশে যে সরকার রয়েছে; তার দায়িত্ব দেশের নাগরিকদের প্রাণ বাঁচানো। সুতরাং মৃত্যুর মড়ক আর ক্ষুধার যন্ত্রণায় মানুষ বিক্ষুব্ধ হবে। এই বিক্ষোভটুকু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নাগরিকের তার এখতিয়ারে থাকা একমাত্র মৌলিক অধিকার।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে। সবচেয়ে ভালো করোনা ব্যবস্থাপনা করা জার্মানিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাগরিকের বিক্ষোভ খুঁজে পাওয়া যায়।
কাজেই দক্ষিণ এশিয়ার একটু গ্রামীণ মাতবরি আদলের রাষ্ট্রকাঠামোতে ক্ষমতাসীনের কোন সমালোচনা সহ্য না করার যে বাতিক আছে; তা করোনার মহামারীর সময় স্থগিত রাখা দরকার।
'কিব্বা হনুরে' একেবারেই পশ্চাৎপদ মনোভঙ্গি। একটু শহুরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির দেশ যুক্তরাজ্যে দেখুন; হাসপাতালে একজন সেবিকা জেনি, করোনা রোগী প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে কেবল রোগী ভেবেছেন। প্রধানমন্ত্রী ভাবেননি। এটাই হচ্ছে আধুনিক সংস্কৃতি। আর মিডিয়া সে খবর প্রকাশ করেছে। প্রত্ন রাজতন্ত্রের দেশের গণতন্ত্রে এই খবরটুকু প্রকাশ করে মিডিয়া আরেকবার জনগণের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দিয়েছে; হাসপাতালে প্রতিটি মানুষের সমান অধিকার।
বিজ্ঞাপন
আর বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক এই করোনা বিভীষিকার মাঝে সরকারের কাছ থেকে যতটুকু উপকার পাচ্ছে; তাকে স্বাগত জানাচ্ছে; ডাক্তার ও পুলিশ সদস্যদের কারো কারো করোনাভাইরাস আক্রান্ত হবার খবরে বিমর্ষ হচ্ছে। সবাই যখন করোনার ভয়ে পালিয়ে গেছে; লাশ ফেলে; তখন প্রশাসনের কর্মকর্তা আর পুলিশকে শেষকৃত্যের দায়িত্ব পালন করতে দেখে কৃতজ্ঞতার বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। করোনার এই বিভীষিকার মাঝেও যদি কোন ভালো সংবাদ থাকে; সেটি হচ্ছে নাগরিকের সঙ্গে ডাক্তার-পুলিশ-প্রশাসনের সম্পর্ক মানবিক হচ্ছে প্রতিদিনই।
ক্ষমতাসীন চিয়ার লিডারেরা যেহেতু হাততালি দিয়ে বা সহমত ভাই বলে সশব্দে প্রশংসা না করলে প্রশংসা জিনিসটা বুঝতে পারেন না। তাই ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছেন, সশব্দ প্রশংসার ঘাটতি দেখে। কিন্তু সাধারণ মানুষের চোখের অভিব্যক্তিতে প্রশংসার গভীর অভিব্যক্তি থাকে।
করোনার মহাবিপদকালে একটু মেচিওরড আচরণ করতে হবে ক্ষমতাসীন দলের সদস্যদের। 'অমুক ঘটনা ঘটে নাই; এইটা গুজব' বলে নাগরিক সাংবাদিক-সাংবাদিককে গলায় গামছা দিয়ে মাতবর বাড়িতে ধরে এনে হুজ্জতি করার সময় এটা নয়। এটা তথ্যের অবাধ প্রবাহের সময়। ধরা যাক একটি মৃত্যু সংবাদ ভুল বা একজন মানুষ ক্ষুধার্ত থাকার খবরটা ভুল। এর চেয়ে আনন্দের তো আর কোন ফেইক নিউজ হয়না পৃথিবীতে। বরং প্রাপ্ত সব তথ্য কাজে লাগালে দেখা যাবে অনেক মৃত্যু ও অনেক ক্ষুধা এড়ানো গেছে।
বিজ্ঞাপন
আর জরুরি পরিস্থিতিতে জনস্বার্থে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতামূলক আচরণ করা মিডিয়া নৈতিকতার মাঝে পড়ে। সুতরাং ত্রাণের চাল-চুরির খবর মিডিয়ায় এলে সরকারের জন্য সেটা চোর ধরতে কাজে দেয়। এতে ত্রাণ-বণ্টনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি তৈরি হয়। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, খাদ্যের অভাবে পৃথিবীতে কখনো দুর্ভিক্ষ হয়নি; হয়েছে সুষম বণ্টনের অভাবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য