প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রাজেশ পাল | ২৮ এপ্রিল, ২০২০
কিছুদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন দল গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন জামায়াতের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক এবং ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ট্রাইব্যুনালে তাদের পক্ষে জানবাজি রেখে আইনি এবং মিডিয়া লড়াইয়ে অংশ নেওয়া ব্যারিস্টার তাজুল ইসলাম এবং আরও কয়েকজন প্রথম সারির সাবেক শিবির নেতারা। চট্টগ্রাম বারের একজন আইনজীবীও ছিলেন সেখানে। যিনি জামায়াতের ব্যাকিং এ ইউপি নির্বাচনে নির্বাচিতও হয়েছিলেন। দলের নাম দেয়া হয়েছে ❛আমার বাংলাদেশ পার্টি❜।
যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার বা নির্বাচনে অংশ নেয়ার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকেরই আছে। অন্যকেউ হলে কিছু বলার সুযোগ ছিলো না কারোরই। কিন্তু এই নবগঠিত প্লাটফর্মটি নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে ব্যাপক আপত্তি রয়েছে আমার। আর তা যৌক্তিক কারণেই। এরা স্রেফ নতুন বোতলে পুরাতন মদের পরিবেশন ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিজ্ঞাপন
প্রথমেই নতুন দলের নেতাদের দিকে একবার তাকিয়ে দেখুন। ব্যারিস্টার রাজ্জাকের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে একাত্তরে আলবদর বাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্টতার। শহীদ জননী জাহানারা ঈমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়েরের অন্যতম নেপথ্য কুশীলব ছিলেন ব্যারিস্টার রাজ্জাক। সেসময় আদালত ভবনে আইনজীবীদের চেম্বারে-চেম্বারে ঘুরে ঘুরে জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলেন এই আব্দুর রাজ্জাক। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের শুরুতে তাদের পক্ষে প্রধান আইনজীবীও ছিলেন তিনিই। আদালতে, টকশোগুলোতে সর্বোচ্চ ডিফেন্ড করার চেষ্টা করেছেন নিজামী-মুজাহিদ-কাদের মোল্লাদের। ৬ বছর লন্ডনে বসে চেষ্টা করেছেন কী করে আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করে একাত্তরের ঘাতকদের শাস্তি থেকে রক্ষা করা যায়। আর তিনিই এখন বলছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা! হাসবো নাকি কাঁদব?
এরপর ধরা যাক মুজিবুর রহমান মঞ্জু ভাইয়ের কথা। মঞ্জু সাহেবকে আমি মঞ্জু ভাই বলবো। কারণ ভার্সিটিতে সিনিয়র হিসেবে এই ভাবেই সম্বোধন করতাম উনাকে। আমাদের সময়ে ছাত্রলীগের মন্দ ছেলেদের শায়েস্তা করতে পরপর তিনবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি করা হয় উনাকে। ২০০১ সালে তাদের বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ছাত্রলীগ ঠ্যাঙানোর জন্য পুরস্কৃত হন। একটি ইউনিট থেকে এক লাফে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি পদে আসীন হন। এরপর জামায়াতের পত্রিকা ❛কিশোর কণ্ঠের❜ জয়েন্ট এডিটর আর ❛দিগন্ত টিভি❜র পরিচালক ও হন। ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক ইতিহাসে অন্যতম সফল এই সভাপতিকে সবদিক দিয়েই পূর্ণ সহায়তা দেয় জামায়াত। আজকের যে অর্থ বিত্তে বলীয়ান মুজিবুর রহমান মঞ্জুকে আপনারা চেনেন তার সবটাই জামায়াতের অবদান। এই লেখা যদি মঞ্জু ভাইয়ের চোখে পড়ে আশা করি তিনি নিজেও সেটা অস্বীকার করতে পারবেন না। সেই মঞ্জু ভাই যখন ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন, তখন পেট ফেটে হাসি আসে; দুঃখ ও হয়। কারণ আপনাকে অন্য কেউ না চিনলেও আপনার ফেলে আসা চবি ক্যাম্পাসের এই ছোট ভাইয়েরা তো হাড়ে হাড়েই চেনে। আর চেনে বলেই আপনার এই মুফাসসিল ইসলাম মার্কা পল্টিবাজি আমাদের চোখে প্রচণ্ড হাস্যকর ঠেকে। ভূতের মুখে রামনাম শোভা পায় কি না সেটা আপনিই বিবেচনা করে দেখুন প্লিজ।
জামায়াত যে একটি যুদ্ধাপরাধীদের দল, রাজাকারদের দল, ধর্ম ব্যবসায়ীদের দল সেটা জেনেশুনেই এই সংগঠনের জন্য একসময় দিনরাত খেটে মরেছেন এরা। সমানে নানাধরনের কুযুক্তি দিয়ে তরুণদের ব্রেনওয়াশ করে গেছেন জামায়াতি আদর্শের পক্ষ নিয়ে। ক্যাম্পাসে কোরাস গাইতেন, “পদ্মা মেঘনা যমুনার তীরে আমরা শিবির করেছি, জিহাদের হুংকারে তিতুমীর হয়ে আল কোরানের পথে চলেছি”। তারা স্লোগান দিতেন, “নারায়ে তাকবীর, আল্লাহ আকবর, এক নেতা এক দেশ, দেলোয়ার হোসেন সাইদীর বাংলাদেশ” এরকমই। সবইতো আমাদের নিজেদের চোখেই দেখা।
আর আজ ১৮০ ডিগ্রি ইউটার্ন নিয়ে আপনারাই যখন আবার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়ান তখন মীরাক্কেলের জোকসের চেয়েও তা অধিক বিনোদনের খনি বলেই মনে হয় আমাদের। কারণ মানুষের চিন্তার জগত কখনোই রাতারাতি পরিবর্তিত হতে পারেনা। রাতারাতি পরিবর্তন হলে ধরে নিতে হবে যে এর পেছনে কোনো ধরণের কিন্তু আছে। আমাদের অনলাইন জগতের মুফাসসিল ইসলাম-সানিউর রহমানদের মতো। দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে মানুষের আদর্শ আর বিশ্বাসের জগতে আসে পরিবর্তন। যার পেছনে কাজ করে অসংখ্য সোশিওপলিটিক্যাল ইস্যুজ। আর সে পরিবর্তনও আসে ব্যক্তিগত পর্যায়েই। যেমন রত্নাকর দস্যু হয়েছিলেন বাল্মীকি মুণি আর নিজাম ডাকাত হয়েছিলেন নিজামউদ্দিন আউলিয়া। সমষ্টিগতভাবে এভাবে রাতারাতি পরিবর্তন একমাত্র গণহিস্টিরিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রেই সম্ভব। আর আপনারা কেউ যে হিস্টিরিয়ার রোগী নন, সেটা সারা জাতি জানে।
বিজ্ঞাপন
তাহলে হঠাৎই কেন এই পল্টিবাজি:
১. আপনারা সত্যি সত্যিই নিজেদের অতীতের সব ভুল বুঝতে পেরে একাত্তরের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে একটি শোষণ বঞ্চনাহীন সেকুলার আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেন। তাই এই নতুন রাজনৈতিক প্লাটফর্মের জন্ম দিয়েছেন।
২. যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের বিচারের ফলে সাংগঠনিকভাবে জামায়াত এখন অনেকটাই পর্যুদস্ত। মুখে যতই বোস্ট মেকিং করুন না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে উনাদের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড এখন অনেকটা পরিচালিত হচ্ছে ষাটের দশকের কমিউনিস্ট পার্টির মতোই আন্ডারগ্রাউন্ড পলিটিক্সের আদলে। এছাড়া ছাত্রশিবির একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে লিস্টেড হয়েছে মার্কিন নথিতে। সবগুলো দখলকৃত ক্যাম্পাস হয়ে গেছে হাতছাড়া। তাই দীর্ঘদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিলো যে জামায়াত এবার ভোল পাল্টে ফিরে আসবে নতুন কোনো চেহারা নিয়ে।
৭২-এ নিষিদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরে জামায়াত-শিবিরের অনেক নেতাকর্মীরাই যোগ দেন জাসদে। বিপ্লবের মুখোশের আড়ালে মেতে ওঠেন ৭১-এর পরাজয়ের বদলা নেয়ার সুযোগসন্ধানে। ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান নিজের আসন পাকাপোক্ত করার মানসে ❛বহুদলীয় গণতন্ত্রের❜ ছদ্মাবরণে রাজনীতির অধিকার ফিরিয়ে দিলে ৭১-এর ঘাতক ❛ইসলামী ছাত্র সংঘ❜-এর নতুন আত্মপ্রকাশ ঘটে ❛ইসলামী ছাত্রশিবির❜ নামে। মজার ব্যাপার হলো, ছাত্রশিবিরের প্রথম কমিটির কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায় সবাই ৭৮ সাল পর্যন্ত জাসদের সাইনবোর্ডের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। আর প্রথম সুযোগেই মুখোশ খুলে মায়ের কোলেই ফিরে গেলেন।
এবারও সম্ভবত সেই একই ঐতিহাসিক নাটকেরই পুনঃমঞ্চায়ন ঘটানোর গোপন মিশনেই মেতে ওঠেছেন তারা।
হুমায়ূন আজাদ স্যার বলেছিলেন , ❛মানুষ যেমন সাপ চেনেনা, বাঙালিও চেনে না জামায়াতকে। একদিন এই কালসাপের দংশনের বিষে নীল হয়ে যেতে হবে পুরো জাতিকে❜। এবার আরেক রাজনৈতিক মুফাসসিল নাটকের পরবর্তী অংক মঞ্চায়নের অপেক্ষায় রইলাম।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য