আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

চাপাতির কোপে প্রাণ হারায় স্বপ্নের কারিগরেরা

দেবজ্যোতি দেবু  

রাজিব হায়দার। পেশায় স্থপতি। ব্যাক্তি জীবনে তিনি "থাবা বাবা" নামে বিভিন্ন ব্লগে লেখালেখি করতেন। রাজাকারদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার থাকা তরুণদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন। রাজাকারের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। মৌলবাদ বিরোধী অবস্থান এবং লেখালেখির কারণে বিভিন্ন সময়ে উগ্র মৌলবাদিরা তাঁকে বিভিন্ন ভাবে হত্যা করার হুমকি ধামকি দিত। খুনের কয়েক দিন আগে জামায়াত-শিবির সমর্থিত 'সোনার বাংলা ব্লগে' তাকে ‘কতল’ করার হুমকি প্রচার করা হয়। তাতেও তিনি থেমে থাকেন নি। কলম চালিয়ে গেছেন মৌলবাদি চক্রের বিরুদ্ধে, রাজাকারের বিচারের দাবিতে।

উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিসহ জামায়াত-শিবির রাজাকার মুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে থাবা বাবা নামে লিখতেন সাইবারযোদ্ধা রাজিব হায়দার শুভ। তাই শিবিরের ব্লগে আরও লেখা হয়-কে এই থাবা বাবা। এরপর রাজীবের বিরুদ্ধে ব্লগে সিরিজ রিপোর্ট করতে শুরু করে শিবির। সিরিজের নাম দেয়া হয় ‘গণজাগরণ মঞ্চের নেপথ্য নায়ক-১।’ ফেসবুক থেকে শুভ'র ছবি নিয়ে সোনার বাংলা ব্লগে পোস্ট করা হয়। নাস্তিক হিসেবে আখ্যা দেয়া হয় শুভকে। তাঁর বিরুদ্ধে লেখা হয় উস্কানিমূলক বক্তব্য। দেয়া হয় প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে হত্যার হুমকি।

১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৩ শুক্রবার। মিরপুরের পলাশনগরের নিজ বাড়ির সামনে মৌলবাদি জঙ্গী হামলায় নৃশংসভাবে খুন হন স্থপতি, ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন। তাঁকে মাথার মধ্যে চাপাতি দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন করায় এবং জামাতের বিরুদ্ধে কথা বলায় তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।

রাজিব হায়দারকে হত্যার পরের দিনই জামাত শিবিরের অর্থায়নে পরিচালিত সোনার বাংলা ব্লগ যেখানে প্রকাশ্যে রাজিব হায়দার সহ বিভিন্ন ব্লগারদের হত্যার হুমকি ও তাঁদের নামে বিভিন্ন অপপ্রচার চালানো হচ্ছিল, তা বন্ধ করে দেয় সরকার।



হত্যার পরের দিন হিজবুত তাহরির নেতা ফারাবী সাফিউর রহমান ফেইসবুকে হুমকি দেয়, “যেই ইমাম থাবা বাবার (রাজীব) জানাজা পড়াবে, সেই ইমামকেও হত্যা করা হবে।" পরে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু কিছুদিন পরে সে জামিনে বেরিয়ে আসে।

হত্যার পরবর্তি সময়ে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং রাজিবের বাসায় উপস্থিত হয়ে তাঁকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ বলে দাবি করেন। তখন পুলিশের হাতে কোন স্বাক্ষী বা ক্লু না থাকলেও ১৪ দিনের মাথায় পুলিশ ৫ জন খুনিকে গ্রেফতার করে। মার্চের ২ তারিখ খুনিদের গ্রেফতার এবং জিজ্ঞাসাবাদের পর দেয়া সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি’র জয়েন্ট কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম জানান, খুনিরা সবাই নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্র। তারা শিবিরের কোন এক বড় ভাইয়ের (রনি) কথায় রাজিব হায়দারকে হত্যা করে নিজেদের ঈমানী দায়িত্ব পালন করেছে। হত্যার পর নিজেদের ভেতরে কোনো অনুশোচনা ছিল না বলে জানায় গ্রেফতারকৃত ৫ আসামী। রাজিব হায়দারের লেখালেখির কারণেই তাঁকে খুন করেছে বলে জানায় তারা।

হত্যায় উৎসাহদাতা হিসাবে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মো. জসীমউদ্দিন রাহমানীকে ২০১৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷জসীমউদ্দিনের লেখা বই পড়ে এবং সরাসরি তার বয়ান ও খুতবা শুনে বাকি আসামিরা ‘নাস্তিক ব্লগারদের' খুন করতে উদ্বুদ্ধ ও উত্সারহিত হয় বলে পুলিশের অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ব্লগার রাজীব খুন হন৷

২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি সিএমএম কোর্টে আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা। ১৮ মার্চ ২০১৫ তারিখে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ২ বছর পর এই হত্যার বিচার শুরু হয় এবং এর কিছুদিন পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩-এ পাঠানোর আদেশ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ১১ মে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রুহুল আমিন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের এই আদেশে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ আদালতে বদলি করেন। এ মামলায় এখন পর্যন্ত ৫৫ সাক্ষীর মধ্যে ৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষগ্রহণের জন্য আগামী ২৯ জুলাই দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। মামলাটি চলমান থাকলেও প্রধান আসামী রেদোয়ানুল আজাদ রানা এখনো পলাতক আছে।

অভিজিৎ রায়। একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত বাংলাদেশী-মার্কিন প্রকৌশলী। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যন্ত্র কৌশলে স্নাতক ডিগ্রী এবং সিঙ্গাপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতকোত্তর এবং ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। ২০০০ সালে তিনি আটলান্টা, জর্জিয়ায় যান এবং সেখানেই একজন প্রকৌশলী হিসাবে কাজ শুরু করেন। পেশায় তিনি প্রকৌশলী হলেও তিনি তাঁর স্ব-প্রতিষ্ঠিত সাইট "মুক্তমনা ব্লগ"-এ লেখালেখির জন্য পরিচিত ছিলেন। তাঁর যুক্তিনির্ভর এবং বিজ্ঞানমনস্ক লেখালেখির কারণে তাঁর পরিচিতি সারা বিশ্বে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পরে। তিনি বাংলাদেশে সরকার সেন্সরশিপ এবং ব্লগারদের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের সমন্বয়কারক ছিলেন। অভিজিৎ রায় ব্লগ, ম্যাগাজিন এবং দৈনিক পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ জ্ঞান, পর্যবেক্ষণ ও তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণই ছিল তাঁর লেখার মূল ভিত্তি। মানবতার জয়গান করা এই লেখক যেখানেই মানবতা বিপন্ন হয়েছে সেখানেই আওয়াজ তুলেছেন। সকল কুসংস্কারের যৌক্তিক এবং বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ করে সাধারণ মানুষকে অন্ধকার থেকে বের করে আনার চেষ্টা করেছেন। তাঁর রচিত বইগুলো হলো- আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী (২০০৫), মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (২০০৭), স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি (২০০৮), সমকামিতা: বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক অনুসন্ধান (২০১০), অবিশ্বাসের দর্শন (২০১১), বিশ্বাস ও বিজ্ঞান (২০১২), ভালবাসা কারে কয় (২০১২), শূন্য থেকে মহাবিশ্ব (২০১৪), ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোঃ এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে (২০১৫)। আধুনিক জীববিজ্ঞান ও বিবর্তন নিয়ে প্রবল আগ্রহ ছিল অভিজিৎ রায়ের। এই বিষয়ের উপর অসংখ্য ব্লগও লিখেছেন তিনি। মহাবিশ্বের উৎপত্তি, পৃথিবীতে প্রাণের উৎস কি ইত্যাদি নানান বিষয়ে গবেষণালব্ধ জ্ঞান সবার সাথে ভাগ করে নিয়েছেন তাঁর লেখার মাধ্যমে।

২০০৭ সালে মুক্তবুদ্ধি, নাস্তিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসার আর মানবাধিকার ও সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার প্রেক্ষিতে 'মুক্তমনা' ওয়েবসাইট শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক অর্জন করে। চলতি বছর ডয়চে ভেলের ‘‘দ্য বব্স – বেস্ট অফ অনলাইন অ্যাক্টিভিজম'' অ্যাওয়ার্ডের ‘সামাজিক পরিবর্তন' বিভাগের জুরি অ্যাওয়ার্ড পায় মুক্তমনা ব্লগ৷ অভিজিৎ রায় এবং তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদের কাজের স্বীকৃতি স্বরুপ মুক্তমনাকে এই অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়৷

২ জুলাই, ২০১৫ ব্রিটিশ হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশন আয়োজিত এই বছরের ঐতিহ্যবাহী ‘ভলতেয়ার বক্তৃতা’ দেবার জন্য বন্যা আহমেদকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও অভিজিৎ, বাংলাদেশ ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে মুক্তমনা আন্দোলন নিয়ে কথা বলতে তাদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন বন্যা। বলেছেন অভিজিৎ রায় সম্পর্কে চমৎকার কিছু কথা। অভিজিৎ রায় সম্পর্কে তিনি বলেন- "যদি ফ্রেডরিক নিটশে এখানে থাকতেন তাহলে হয়তো বলতেন, অভিজিৎ, ‘বিজ্ঞানকে দেখেছিল শিল্পীর চোখে আর শিল্পকলাকে জীবনের প্রেক্ষাপটে’— অর্থাৎ বিজ্ঞান ছিল ওর ধ্যান-জ্ঞান যা দিয়ে ও জীবনের মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজত আর শিল্পকলা ওর কাছে স্রেফ বিমূর্ত মূল্যহীন কিছু ছিল না বরং ছিল জীবনযাপনের সবচেয়ে বড় প্রভাবক।"

ইংরেজী বক্তৃতাকে তিনি আবার বাংলায় অনুবাদ করে দিয়েছিলেন মুক্তমনা পাঠকদের জন্য। সেই অনুবাদটি এখানে তুলে ধরলাম। আমার বিশ্বাস, এর চেয়ে ভাল অভিজিৎ রায় সম্পর্কে আর কোন তথ্য হতে পারে না।

তাঁর বিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তা ভাবনা এবং স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী হওয়ার কারণে জামাতের কট্টরপন্থী সমর্থক ও কর্মীদের কাছ থেকে হত্যার হুমকি পেয়েছেন বহুবার। মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছ থেকে হুমকি ধামকি পেয়ে বাংলাদেশের অনলাইনে কেনাকাটা ভিত্তিক ওয়েবসাইট "রকমারি.কম" থেকে অভিজিৎ রায়ের বই সরিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু গোলাম আজম, সাঈদী কিংবা নিষিদ্ধ ঘোষিত মওদুদী'র বই বিক্রিতে তাদের কোন অসুবিধা বা আপত্তি ছিল না। ছিল শুধু অভিজিৎ রায়ের বই নিয়ে। কারণ তিনি যুক্তি নির্ভর এবং বিজ্ঞান মনস্ক ছিলেন। বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার মানুষদের উপর হওয়া নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বদা কথা বলেছেন অভিজিৎ রায়। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির নিকট মুক্ত চিন্তার মানুষদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার আহবান জানান তিনি।

২৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৫। একুশে বই মেলা থেকে ফেরার পথে টিএসসি'র সামনে পুলিশের তিন স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনির ভিতরেই জঙ্গীদের হাতে খুন হন প্রকৌশলি, ব্লগার, লেখক, মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়। অভিজিতের ওপর দুর্বৃত্তদের হামলার সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। এ সময় তিনিও গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাফিদা আহমেদ বলেন, "রাত সাড়ে আটটার দিকে একুশে বইমেলা থেকে বেরিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশপথে ফুটপাতে চা-পানের জন্য তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রাত পৌনে নয়টার দিকে যুবক বয়সের দুই দুর্বৃত্ত অতর্কিতে চাপাতি দিয়ে পেছন থেকে অভিজিৎকে কোপাতে থাকে। এ সময় রাফিদা আহমেদ অভিজিৎ রায়কে রক্ষা করতে গেলে দুর্বৃত্তরা তাঁকেও কোপ দেয়। এরপর দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পরে কয়েকজন ফটোসাংবাদিক রক্তাক্ত অবস্থায় তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।" কর্তব্যরত চিকিৎসক সোহেল আহমেদ জানান, "মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে ১০টার দিকে অভিজিৎ মারা যান। রাফিদার মাথায় চাপাতির চারটি আঘাত লেগেছে। তাঁর বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তাঁর অবস্থাও আশঙ্কাজনক।" পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় লেখালেখির কারণে অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়েছে। অভিজিতের ওপর হামলার পর আনসার বাংলা-৭ নামের টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এ হত্যার দায় স্বীকার করা হয়। হত্যাকান্ডের অনেকদিন পর আল-কায়েদা ইন দ্যা ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট'র প্রধান 'আসিম উমর' অভিজিৎ হত্যার দায় স্বীকার করে বলে, তার নেটওয়ার্কের অনুসারীরাই এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।

পুলিশের নিরাপত্তা বেষ্টনির ভিতরে এই হত্যাকান্ড ঘটলেও পুলিশ ছিল নিরব দর্শক। এই হত্যাকান্ডের পরে পুলিশ বলে তাদের হাতে কোন ক্লু নেই। ঘটনার তিনদিন পর ২ মার্চ অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের ইন্ধনদাতা হিসেবে হিযবুত তাহরীরের নেতা শাফিউর রহমান ফারাবীকে গ্রেফতার করে র্যাপব। নিজের ফেসবুক পেজে অভিজিতের পারিবারিক ছবি ও যুক্তরাষ্ট্রের ঠিকানা প্রকাশ করে তাকে হত্যার হুমকি দেওয়ায় ফারাবীকে এ হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে সনাক্ত করে র্যা ব।

পরে তাকে অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্ত সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর তাকে রিমান্ডে নিয়ে কয়েকদফা জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা। রিমান্ডে নেয়া হলেও তার কাছ থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায় নি বলে জানায় গোয়েন্দারা। উল্লেখ্য, এর আগেও ব্লগারদের হত্যার হুমকি দেয়ার অপরাধে ফারাবীকে আটক করেছিল পুলিশ। পরে সে জামিনে বের হয়ে আসে। ৫ মার্চ হত্যাকান্ড তদন্তে ঢাকা আসে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) প্রতিনিধিদল। কিছুদিন মামলাটি তদন্ত করে তারা আবার ফিরে যায়। সন্দেহভাজন হিসেবে অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের দিন সংঘঠিত এক বৈঠকের আয়োজক লেখক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং এরপর তাকে পুলিশের অনুমতি ছাড়া ঢাকার বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

২৭ জুন গোয়েন্দা পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তা দাবি করেন, অভিজিতের হত্যাকারীদের তথ্য দিয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যার এক বন্ধু। বন্যার ওই বন্ধু নাকি হত্যাকারীদের তাঁদের চলাচলের বিভিন্ন তথ্য দিয়েছিলেন।

গত ৭ জুলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার মো. মনিরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, "অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের মূল অপারেশনে অংশ নেওয়া সাতজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় আমরা পাইনি। আমরা শুধু তাদের নিকনেম জানতে পেরেছি। তাদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় বের করার চেষ্টা চলছে। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া সাতজনই আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য। তারা সবাই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের মধ্যে একজন মেডিক্যালের ছাত্র।" গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, সিসিটিভি থেকে পাওয়া ফুটেজ ও অভিজিতের ঘনিষ্টজনদের ফোন কল বিশ্লেষণ করে এবং সেসব নিয়ে বন্যা আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাঁর সনাক্ত করণের মাধ্যমেই এই ৭ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এমন খবর প্রচার হওয়ার পরপরই মুক্তমনা ব্লগ থেকে ৯ জুলাই গোয়েন্দাদের এমন তথ্যকে ভুল দাবি করে প্রতিবাদ জানানো হয়। মুক্তমনা ব্লগ থেকে দাবি করা হয় "আক্রমণের পর চার দিন স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা শেষে বন্যা আহমেদ যখন উন্নত চিকিৎসার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান তখন থেকে আজ পর্যন্ত তাকে বাংলাদেশ পুলিশ বা এফবিআই কারও পক্ষ থেকেই কোনো ছবি পাঠানো হয় নি সনাক্ত করা জন্য। তিনি কখনই অভিজিৎ রায়ের কোনো খুনিকে সনাক্ত করেন নি। বন্যা আহমেদের সাথে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই এর নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে চাই, বাংলাদেশ সরকার, প্রশাসন, অথবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাস কেউই সরাসরি বা এফবিআই এর মাধ্যমে তার সাথে যোগাযোগ করে নি।"

এই হত্যাকান্ডের তদন্তেও রেদওয়ানুল আজাদ রানা'র নাম উঠে আসে। গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা "আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের স্লিপার সেলগুলোর সমন্বয়ক রেদওয়ানুল আজাদ রানা অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি সমন্বয় করেছিলেন। ঘটনার দিন বই মেলায় মোড়ক উন্মোচনের পর রাত ৮টার দিকে রানা একটি কোড মেসেজ পান, যাতে বলা হয়েছে, অভিজিৎ ও বন্যা মেলা থেকে বের হচ্ছেন। রানা ঐ মেসেজটি স্লিপার সেলের আরও দুজনের কাছে পাঠান। যারা টিএসসিতে অভিজিৎ দম্পতির ওপর হামলা চালায়। হত্যাকাণ্ডের মিশন সফল হওয়ার পর রানার মোবাইল ফোনে আরও একটি ম্যাসেজ যায়।" হত্যাকান্ডের প্রায় সাড়ে চার মাস অতিবাহিত হয়ে গেলেও মামলার এইসব বিতর্কিত তথ্য ছাড়া আর দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই।

ওয়াসিকুর রহমান বাবু। পেশাগত জীবনে মতিঝিলের ফারইস্ট এভিয়েশন নামের একটি ট্র্যাভেল এজেন্সিতে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন। চাকরির পাশাপাশি তিনি তেজগাঁও কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব মেধাবী ছাত্র ছিলেন বাবু। লেখালেখির অভ্যাশ ছিল ছোট থেকেই। তিনি ইস্টিশন নামে একটি ব্লগে লিখতেন। উনার নিজস্ব একটি ফেইসবুক আইডি ছিল। সেখানেও তিনি নিয়মিত লেখালেখি করতেন। মৌলবাদ বিরোধী চিন্তা চেতনা, ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী নানান বৈজ্ঞানিক যুক্তিই ছিল উনার লেখার মূল বিষয়। স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী বাবু বিচার চেয়েছিলেন রাজাকারদের। বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

৩০ মার্চ ২০১৫। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে অফিসে যাওয়ার পথে বাসার সামনেই খুন হন ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু। ৩ জন জঙ্গী বাবুকে চাপাতি দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে আহত করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে তাঁর মৃত্যু হয়। হামলা করে পালানোর সময় কয়েকজন হিজরার হাতে ধরা পরে দু'জন জঙ্গী। আলাদা করে "হিজরা" উল্লেখ করার অবশ্য একটা কারণ আছে। কারণ অভিজিৎ রায়ের খুনের সময় যেভাবে আশেপাশের লোকজন দাঁড়িয়ে খুন হতে দেখেও খুনিদের ধরে নি, বাবুর ক্ষেত্রেও অনেক লোক (কথিত পুরুষ) থাকা সত্বেও কেউ সাহস করে এগিয়ে আসে নি। এসেছিলেন ৩ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় খুনিরা মাদ্রাসার ছাত্র। তাদের একজন ওয়াশিকুরকে হত্যা করতে চট্টগ্রাম থেকে এসেছিল। সে চট্টগ্রামের হাটহাজারি মাদ্রাসার ছাত্র। আর দ্বিতীয় জন মিরপুরের দারুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র। দুটি মাদ্রাসাই হেফাজতে ইসলামের আস্তানা বলে খ্যাত। গ্রেফতারের পরে পুলিশের কাছে দেয়া জবানবন্দীতে খুনিরা বলে- "ব্লগ কি বুঝি না, আর তার লেখাও আমরা দেখিনি। হুজুরের পরামর্শ, সে ইসলামবিরোধী। তাকে হত্যা করা ঈমানি দায়িত্ব। আর সেই ঈমানি দায়িত্ব পালন করতে ওয়াশিকুরকে হত্যা করেছি।"



পুলিশ জানায়, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত দুই তরুণ জিকরুল্লাহ ও আরিফ জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া তারা তিনজনই একে অপরকে আগে থেকে চিনত না। রোববার হাতিরঝিলে বৈঠকের সময় তাদের প্রথম দেখা হয়েছে। তিন জনকে একে অপরের সঙ্গে শুধু নাম পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন মাসুম হুজুর। তিনি আলাদা করেই তাদের ডেকে এনেছিলেন হাতিরঝিল এলাকায়। আগের দিনের পরিকল্পনা মতো ৩০ মার্চ সকাল ৯টায় তারা নিহত বাবুর বাসার সামনে মিলিত হয়েছিল। এই মাসুম হুজুরই এদের বাবু'র পরিচয়, ছবি এবং সকল তথ্য দেন। তিনটি চাপাতি তাদের হাতে ধড়িয়ে দেয়ার সময় বাবুকে মাথায় আঘাত করার কথাও মাসুম হুজুর বলে দেয়। মূলত মাসুম হুজুরের নির্দেশেই তারা বাবু হত্যা মিশনে অংশ নিয়েছিল। ঘটনার সাথে জড়িত আরেক খুনি 'তাহের' এখনো পলাতক। বাবুর ভগ্নিপতি বাদী হয়ে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় উক্ত চারজনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেছেন। আজ অবধি এই মামলার দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই।

অনন্ত বিজয় দাশ। পূবালী ব্যাংকে চাকরি করার পাশাপাশি লেখালেখি করতেন। মুক্তমনা ব্লগে তিনি নিয়মিত লিখতেন। মানবতা এবং যুক্তিবাদ প্রতিষ্ঠায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৬ সালে মুক্তমনা র‍্যাশনালিস্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। মুক্তমনা ব্লগে মূলত মানুষের জন্মের ইতিহাস, জীববিবর্তন, বিবর্তনবাদ, ডারউইন তত্ত্ব ও বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে লেখালেখি করতেন। সাধারণ মানুষের মাঝে অভিজিৎ রায়ের মতো অনন্ত বিজয়েরও বিজ্ঞান মনস্ক লেখারও খুব সুনাম ছিল। যুক্তিবাদী লিখালিখির জন্য বাংলাদেশের বাইরেও তিনি অনেকের কাছেই প্রিয় লেখক ছিলেন। ব্লগে লেখা ছাড়াও তিনি বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানমনস্কতার ছোটকাগজ 'যুক্তি'র সম্পাদক ছিলেন। তাঁর লেখা চারটি বইও ইতিমধ্যে প্রকাশ হয়েছে। প্রকাশিত প্রবন্ধ গ্রন্থ : (১) পার্থিব, (সহলেখক সৈকত চৌধুরী), ২০১১। (২) ডারউইন : একুশ শতকে প্রাসঙ্গিকতা এবং ভাবনা, (সম্পাদিত), ২০১১। (৩) সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব : লিসেঙ্কো অধ্যায়, ২০১২। (৪) জীববিবর্তন সাধারণ পাঠ (মূল: ফ্রান্সিসকো জে. আয়াল, অনুবাদ: অনন্ত বিজয় দাশ ও সিদ্ধার্থ ধর), ২০১৪।



বাংলাদেশের স্বাধীনতায় উদ্ভাসিত তরুণ ছিলেন অনন্ত বিজয়। গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। ছিলেন রাজপথে রাজাকার বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে নির্ভিক যোদ্ধা হয়ে। বিভিন্ন সময়ে জামাত এবং উগ্র মৌলবাদী জঙ্গীদের কাছ থেকে বিভিন্ন ভাবে হত্যার হুমকি পেয়েছেন অনন্ত। ২০১৩ সালে হেফাজত যে ৮৪ জন ব্লগারকে হত্যা জায়েজ বলে তালিকা প্রকাশ করেছিল সেখানেও নাম ছিল অনন্ত বিজয়ের। কিন্তু তাতেও তাঁর কলম থেমে থাকেনি।

জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছেন বহুবার। লিখেছেন অনেক লিখা। জামাতের কুকর্ম সাধারণ মানুষের মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তাঁর লিখার মাধ্যমে। তাঁর সম্পাদিত ছোট কাগজ "যুক্তি"ও পাঠক মহলে বেশ সমাদৃত হয়েছিল।

১২ মে ২০১৫। সকাল ৮ টার দিকে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় নিজের বাসার সামনেই খুন হলেন মুক্তমনা ব্লগের লেখক অনন্ত বিজয় দাশ। চারজন মুখোশধারী জঙ্গী চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে তাঁকে রাস্তায় ফেলে রেখে চলে যায়। সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। হত্যাকান্ডের ঠিক পরপরই জঙ্গী সংগঠন "আনসার বাংলা ৮" টুইটারে এই হত্যার দায় স্বীকার করে পোস্ট দেয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলার পরে খুনিরা মুখোশ খুলে হেঁটে হেঁটে পাড়ার ভিতর দিয়ে চলে যায়। কেউ কিছু বললে তাকেও খুন করা হবে বলে শাসিয়ে যায় খুনিরা। খুনিদের কেউ চিনতে পারেননি বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা।

একজন প্রত্যক্ষদর্শী মহিলা জানান, অনন্তকে যখন মারা হচ্ছিল তখন তিনি তা দেখে প্রতিবাদ করেন, মারার কারণ জিজ্ঞেস করেন। তখন খুনিরা তাকেও থাপ্পর মারে। তিনি প্রাণের ভয়ে সেই জায়গা থেকে সরে যান।

অনন্ত হত্যার পর প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন ‘বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল’ নামক সংগঠনটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও দুজন। ফলে এই সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।

প্রকাশ্যে খুন বা জঙ্গী সংগঠনের টুইটারে হত্যার দায় স্বীকার করে পোষ্ট দেয়ার পরও পুলিশ বলে তাদের হাতে কোন ক্লু নেই। হত্যার ৫ দিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশের তদন্তের কোন অগ্রগতি ছিল না। পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট না থাকায় লেখক অনন্ত বিজয় দাশ হত্যা মামলায় আশানুরূপ অগ্রগতি হচ্ছে না বলে জানান সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি (মিডিয়া) রহমত উল্লাহ।

১২ দিন তদন্ত করে কোন সুরাহা করতে না পেরে অবশেষে তদন্ত ভার দেয়া হয় অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির হাতে। সিআইডি'র হাতে তদন্ত ভার হস্তান্তরের প্রায় দুই সপ্তাহের মাথায় হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার সন্দেহে আটক করা হয় স্থানীয় দৈনিক সবুজ সিলেটের ফটো সাংবাদিক ইদ্রিছ আলীকে। হত্যার পরের দিন সবুজ সিলেটে প্রকাশিত একটি ছবির জের ধরে তাকে আটক করা হয়। গ্রেফতারের পরের দিন তাকে আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। রিমান্ড শেষে তাকে আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাকে জামিন না দিয়ে জেলা হাজতে প্রেরণ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত অনেক তথ্য পাওয়া গেছে বলে গোয়েন্দারা দাবি করলেও এখনো এর দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি চোখে পরে নি।

অনন্ত বিজয় হত্যর পর সিলেটের ব্লগার ও গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠকদের তালিকা করতে মাঠে নামে পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এসব তালিকা করা হচ্ছে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। তবে এখন পর্যন্ত নিরাপত্তামূলক দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন সিলেটের কয়েকজন ব্লগার-এক্টিভিস্ট।

নিলয় নীল। মুক্তমনা, নবযুগ ও ইস্টিশন ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ফেসবুকেও সক্রিয় ছিলেন এবং তিনি যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সরব ছিলেন। ছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের একনিষ্ঠ কর্মী। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। সামাজিক দায়িত্ব পালনে সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন নীল। তাঁর ফেইসবুক প্রোফাইলে দেখা যায় তিনি প্রায়ই বিভিন্ন জনের জন্য রক্ত চেয়ে পোস্ট দিতেন। কার কোথায় কতো ব্যাগ রক্ত লাগবে, কার রক্তের গ্রুপ কি, রক্ত কোথায় পাওয়া যাবে এসব নিয়ে তাঁর মাথা ব্যথার কমতি ছিল না। এক কথায় মানবতার সেবায় ব্রত থাকা এক নিরলস প্রাণ ছিলেন নিলয় নীল। সর্বশেষ পোস্টে তিনি কাবুলে জঙ্গী হামলার প্রতিবাদ করেছিলেন।

৭ আগস্ট দুপুরে নিলয় নীলের খিলগাঁও ১৬৭ গোড়ানের বাসায় ঢুকে অজ্ঞাত পরিচয় সন্ত্রাসীরা তাঁকে জবাই করে হত্যা করে। অসমর্থিত সূত্র মতে, বাসা ভাড়া চাইতে আসা কিছু লোক বাসা দেখার নাম করে ঘরে ঢুকে তাঁকে হত্যা করে। বরাবরের মতো এইবারও পুলিশের হাতে কোন ক্লু নেই।

ব্লগার অনন্ত বিজয় হত্যাকান্ডের পরে নীল তাঁর ব্যাক্তিগত ফেইসবুক আইডিতে লিখেছিলেন দুইজন সন্দেহভাজন লোক তাঁকে রাস্তায় অনুসরণ করছিল। এরফলে তিনি থানায় জিডি করতে গেলে কর্তব্যরত পুলিশ তাঁর জিডি নেয় নি। বরং তাঁকে দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে যাবার উপদেশ দিয়েছিলেন।

একটি ঘটনা ছাড়া বাকি প্রায় প্রতিটি ঘটনাই ঘটেছে প্রকাশ্যে এবং একই কায়দায়। সবার মাথায় চাপাতি দিয়ে কোপানো হয়েছিল যেন মৃত্যু নিশ্চিত করা যায়। প্রতিটি খুনের সাথেই মৌলবাদি ব্যক্তি বা সংগঠনের সম্পৃক্ততা পরিস্কার। কখনো মাদ্রাসার হুজুরের কথায়, কখনো জামাতের বড় ভাইয়ের কথায় এসব হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছে ধরা পরা খুনিরা। এখনো বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠীর নাম নিয়ে সমাজের সুশীল ব্যাক্তিদের হুত্যার হুমকি দিয়ে তালিকা প্রকাশ করছে তারা। বাসায় বাসায় চিঠি পাঠাচ্ছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে,এতোগুলো খুন হয়ে যাবার পরও,এভাবে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেয়ার পরও পুলিশ নির্বিকার। তাদের হাতে কোন ক্লু নেই বলে তারা চুপ করে বসে আছে। প্রথম হামলার শিকার হওয়া রাজিব হায়দারকে প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ বলে আখ্যায়িত করলেও পরের সকল হত্যাকান্ডের বিষয়ে তিনি কোন কথা বলেন নি। বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রীরা বাকি সকল হত্যাকান্ডকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চাপা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রায় দুই বছরে ৪ জন ব্লগারকে হত্যা করা হলেও এখন পর্যন্ত এই হত্যা মামলাগুলো কোন সুষ্ঠ বিচারের মুখ দেখেনি। দুইটি খুনের সাথে জড়িত কয়েকজন ধরা পরলেও বাকি দুইটি হত্যা মামলা এখনো অন্ধকারেই ঘুমিয়ে আছে। পুলিশ নির্বিকার,সরকার নির্বিকার,সাধারণ জনগণও নির্বিকার। যেন কিছুই হয় নি। মানুষ না, ৪ টা কচু গাছ কেটেছে কেউ। তাই সেটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। এখন তাঁরা শুধুই একেকটা গল্প ছাড়া আর কিছুই না।

এই পাঁচজন ছাড়াও এখন পর্যন্ত খুন হয়েছেন আটজন ব্লগার, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, অ্যাক্টিভিস্টদের সমর্থক ও সহযোগী। এর মধ্যে সাতজন সরাসরি ব্লগিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে সবাই কোনো না কোনোভাবে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সবার মৃত্যু হয়েছে মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে।

১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৩-তে মতিঝিলে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের আক্রমণ প্রতিহত করতে গিয়ে আহত হন অগ্রণী ব্যাংকের কর্মী জাফর মুন্সি। তাঁর মাথায় মারাত্মক ভাবে আঘাত করা হয়। পরের দিন ঢাকায় একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় খুন হন ব্লগার মামুন হোসেন। ১ মার্চ জামাতের হামলায় খুন হন সিলেটের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী জগৎজ্যোতি তালুকদার। ৯ এপ্রিল বুয়েটের শহীদ নজরুল ইসলাম হলে ওই প্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষার্থী হেফাজতে ইসলামের সমর্থক মেজবাহ উদ্দিনের চাপাতির কোপে গুরুতর আহত হন আরিফ রায়হান দীপ। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে আমবাগান গ্রামের ফ্ল্যাটে কুপিয়ে এবং গলা কেটে হত্যা করা হয় ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও মুক্তচিন্তার সমর্থক আশরাফুল ইসলামকে। ৯ ডিসেম্বর বগুড়া জেলা সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের যুগ্ম-সম্পাদক ও গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক প্রভাষক জিয়াউদ্দিন জাকারিয়া বাবুকে পেছন থেকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে হামলার শিকার হন অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ। চাপাতি ও কুড়ালের কোপে মারাত্মক আহত ড. হুমায়ুন আজাদ চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই বছর ১২ আগস্ট জার্মানির মিউনিখে মারা যান। গত বছরের ১৫ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও মুক্তচিন্তার লেখক শফিউল ইসলাম লিলনকে বাড়ির সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

খুনের ঘটনার বাইরে চাপাতি দিয়ে কোপানোও হয়েছে কয়েকজনকে। তাঁরা ভাগ্যগুণে খুন না হলেও দীর্ঘদিনের চিকিৎসার পর সুস্থ হন। এর মধ্যে দুই দফায় কোপানো হয় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে। তাঁকে ২০১৩ সালের ১৩ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর উত্তরায় নিজ কার্যালয়ের সামনে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করা হয়। ওই বছরের ৭ মার্চ রাতে মিরপুরের পূরবী সিনেমা হলের কাছে কুপিয়ে জখম করা হয় ব্লগার সানিউর রহমানকে। ২০১৩ সালের জুনে এলিফ্যান্ট রোড এলাকায় কোপানো হয় গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার রাকিব আল মামুনকে। এর বাইরে উগ্রপন্থিদের হাতে বিভিন্ন সময় খুন হয়েছেন আরও অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তি।

সম্প্রতি জার্মান প্রবাসী ব্লগার ওমর ফারুক লুক্সকে সেদেশে গিয়েই হত্যার হুমকি দিয়েছেন মোঃ শফিকুল ইসলাম নামের বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক ছাত্র।


একের পর এক ব্লগার ও মুক্তচিন্তার লেখকদের হত্যার পর আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী ও ভাষাতত্ত্ববিদ ড. হুমায়ুন আজাদের ছেলে অনন্য আজাদকে ক্রমাগত হত্যার হুমকি দিচ্ছে মৌলবাদী জঙ্গিরা।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, শুধু ব্লগার নয়, ওদের হিট লিষ্টে সংস্কৃতিকর্ম, প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, লেখক , সাংবাদিকের নামও রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি।

উল্লেখ্য, গত ২৫ মে ২০১৫ তারিখে উগ্র ধর্মীয় সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। আদেশে বলা হয়, ২০১৩ সালের সন্ত্রাস বিরোধী আইনের ১৮(২) ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমকে নিষিদ্ধ করা হলো।


৩০ মে আবারও খবরে আসে 'আনসার বাংলা ৯'। তারা টুইটারে একটি টুইট বার্তায় লিখে “Next Target is Loading…” এই বার্তায় নির্দিষ্ট কারো নাম উল্লেখ করা না থাকলেও একই টুইটার বার্তায় অফিসিয়াল ঘোষণার জন্যে তাদেরকে ফলো করতে বলা হয়েছে।

গল্প হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর অপরাধটা কি ছিল? কি চেয়েছিলেন তাঁরা? তাঁরা আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। অন্ধকার দূর করে সাধারণ মানুষকে আলোর পথ দেখাতে চেয়েছিলেন। ধর্ম ব্যবসায়িদের মতো ধর্ম বিক্রী করে খেতে চান নি তাঁরা। বরং সেই ব্যবসা একদিন তাঁদের কলমের কারণে হয়তো বন্ধ হয়ে যেত। মৌলবাদীদের মত অন্যের পকেট কেটে নিজেদের জন্য প্রাসাদ নির্মাণ করতে চান নি তাঁরা। বরং নিজেদের জ্ঞান সবার মাঝে বিলিয়ে দিতে এসেছিলেন। সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর করে মানুষকে বিজ্ঞানের আলোর সন্ধান দিতে চেয়েছিলেন। তাঁদের এই নির্লোভ জ্ঞান বিতরণ বন্ধ করে দিচ্ছিলো মৌলবাদীদের ধর্মের নামে ব্যবসা। আর সেই ব্যবসা রক্ষার জন্যই কি মরণ কামড় দিল মৌলবাদিরা?

একটা সময় ছিল যখন কলেজের বারান্দায় বসে "জামাত শিবির নিপাত যাক" বললে সেটা দু'য়ে দু'য়ে চার হয়ে স্লোগানে পরিণত হত। পাড়ায় আড্ডায় বসে মাদ্রাসার ভিতরে তৈরি হওয়া জঙ্গী এবং জঙ্গীবাদ নিয়ে কথা বললে কেউ দ্বিমত করতো না বরং সমর্থন জানাতো।

স্কুলের সামনে রোজ সাঈদ নামের এক শিবির কর্মী আসতো। অষ্টম থেকে দশম শ্রেণীর ছাত্রদের ধরে ধরে ছাত্র শিবিরে যোগ দেয়ার দাওয়াত দিত। অসহ্য হয়ে স্কুলের দেয়াল টপকে অন্য রাস্তায় বের হতাম। একা একদিন উল্টা পাল্টা কিছু কথাও ওদের বলেছিলাম বলে খুব শাসিয়ে ছিল সাঈদ। সেই থেকে একটা চাপা ভয় ছিল মনের মধ্যে। কিন্তু কিছুদিন পরে দেখেছিলাম স্কুলের বাঁদর বলে খ্যাত আমার কিছু সহপাঠী সাঈদের বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। ওরাই শেষ পর্যন্ত এই জানোয়ারদের সেখান থেকে তাড়িয়েছিল। আমি কিছুই করিনি। কিন্তু ওদের সাথে ছিলাম বলেই গর্ব করে গল্পটা অনেকদিন অনেককে বলেছিলাম। সবাই বাহবা দিত। কাজের কাজ করেছি।


বড় ভাইদের কাছে জামাত শিবিরকে পেটানোর গল্প শুনতাম। জামাত মানেই রাজাকার। ওরা রগ কাটে, মানুষ মারে। ওদের এই দেশে টিকে থাকতে না দেয়ার একটা অদ্ভুত জোশ ছিল সবার মধ্যে। সবকিছুই সাজানো গোছানো ছিল স্বপ্নের মত।

হ্যাঁ,কথাগুলো আজ স্বপ্নই মনে হয়। কারণ জামাত শিবির তো দূরের কথা, মৌলবাদ নিপাত যাক বললেও এখন আর দু'য়ে দু'য়ে চার হয়ে কেউ স্লোগান ধরে না। বরং নাস্তিক বলে দূরে সরে যেতে যেতে চার থেকে শূন্য হয়ে যায়। রাস্তায় হাঁটার সময় অপরাধীর মত চোখ কান খোলা রাখতে হয় চাপাতির ভয়ে। বন্ধুরা এখন আর বাহবা বা সমর্থন দেয় না। বরং কবে কোপ খাচ্ছি সেটা জিজ্ঞেস করে মজা করে। বাসায় এখন আর কেউ আমাকে নিয়ে গর্ব করার সাহস পায় না। যদি হারিয়ে ফেলেন কোন চৌরাস্তার মোড়ে !!! হাজার বার ফোন করে উপদেশ শোনানো হয়। এক কথায় ওসব নিয়ে কথা বলতে গেলে পরিবারের অযথা দুশ্চিন্তার কারণ হতে হয়।

এদের সবাইকেই নাস্তিক ট্যাগ লাগিয়ে হত্যা করা হচ্ছে বা হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছে। অথচ 'নাস্তিক' শব্দটার সাথে বাংলাদেশের ঠিক কতোজন মানুষ পরিচিত ছিল সেটাও একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। নাস্তিকতা কি সেটাও কতোজন সঠিক ভাবে বলতে পারবে সেই বিষয়েও আমার সন্দেহ আছে। রাজাকারের বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামার পরে অনেক ভাবেই বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হয়েছে আমাদের। শেষ পর্যন্ত কিছুই টিকে নি। কিন্তু এই একটা শব্দ 'নাস্তিক', সব কিছুই পালটে দিয়েছে। ধর্ম নিয়ে কটুক্তি করেছে বলে গুজব ছড়ানো আর পরে এই গুজবকে বাতাসের সাথে মিশিয়ে সমগ্র বাংলাদেশে মহামারির মতো ছড়িয়ে দেয়ার কাজটা জামাত খুব ভাল করেই করতে পেরেছে। এই দেশে মানুষ আর কিছু নিয়ে এক হতে পারুক আর না পারুক, ধর্মীয় ইস্যু নিয়ে ঠিকই এক হয়ে যায়। সেই আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে হেফাজতের আমির শফি হুজুর। নাস্তিক মারাকে জায়েজ বলে প্রচার করে সে একটি মহল থেকে বেশ বাহবা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু এই দেশের সাধারণ মানুষদের ঠেলে দিয়েছে এক অন্ধকার যুগের দিকে। যেখানে মানুষ মানুষকে হত্যা করে এক পৈশাচিক আনন্দ পায়। মানুষ মেরে তারা বেহেস্ত পাবার স্বপ্ন দেখে। যেমন পৈশাচিকতা করেছিল জামাত সেই ১৯৭১ সালে, যেভাবে মানুষকে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বানিয়েছিল দেশের শত্রু, ঠিক তেমনি ভাবেই বর্তমান সময়ে এই শফি হুজুরেরা জামাতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে সাধারণ মানুষকে লেলিয়ে দিয়েছে দেশের ভবিষ্যত সূর্য সন্তানদের পিছনে।

নাস্তিকতার ধোঁয়া তুলে যাদের হত্যা করা হচ্ছে বা যাদের উপর হামলা করা হয়েছে তারা সবাই কি নাস্তিক ছিলেন ? নাস্তিকতাই কি তাদের মূল জ্ঞান ছিল ? নিশ্চই না। তাহলে কেন তাঁদের হত্যার কারণ হিসেবে এই শব্দটাকে ব্যবহার করা ? একটু ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখবেন এরা প্রত্যেকেই কিন্তু রাজাকারের বিচারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করেছেন। অনেকেই ছিলেন রাজপথের সাহসী যোদ্ধা। যাদের কলমকে জামাত তথা সকল রাজাকারের দোসররা ভয় পেত। যাদের চিন্তাশক্তিকে ভয় পেত জামাত সহ সকল মৌলবাদি চক্র। রাজাকারের বিচারের দাবিতে গণ আন্দোলন সৃষ্টিতে একটা বিরাট অবদান ছিল যে সকল ব্লগারদের, তাঁদেরই একে একে টার্গেট করেছে এইসব জঙ্গীরা। ধর্মকে ঢাল বানিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে এই আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রেখে রাজাকার বিরোধী একটা গণ আন্দোলনের কোমর ভেঙ্গে দেয়াই ছিল জামাত তথা এইসব জঙ্গী সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য। কারণ গণ আন্দোলনের জোয়ার ওদের সকল বড় বড় নেতাদের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলছিল। রাজাকার হিসেবে চিহ্নিত করে বিচার দাবি করছিল। এই আন্দোলন বেশিদিন চলতে থাকলে এই সোনার বাংলাকে জামাত এবং তাদের দোসররা পাকিস্তান বানাতে পারবে না, বরং এই দেশ ছেড়েই তাদের পালাতে হবে। তাই এই আন্দোলন থামাতে তারা সাধারণ মানুষকে ধর্মের নামে বিভ্রান্ত করে সাজিয়েছিল নতুন নাটক।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে এই সব হত্যার পিছনে কেন শুধু জামাতের কথা বলছি। একটু লক্ষ্য করে দেখুন, প্রায় প্রতিটি হত্যাকান্ডের পরেই পুলিশের তদন্তে কোন না কোন ভাবে বারবার একটি নামই আসছে। সেটা হচ্ছে রেদোয়ানুল আজাদ রানা। কে এই রানা ? রানা জামাত শিবিরের একজন সক্রিয় নেতা। সেরকমই পুলিশের তদন্তে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিটি হত্যাকান্ডের পরে এবং আগে খুনিরা বারবার রানার কথাই বলেছে। আরেকটা সন্দেহভাজন নাম হচ্ছে হিজবুত তাহেরির নেতা শাফিউর রহমান ফারাবী। বিভিন্ন জঙ্গী তৎপরতায় তার জড়িত থাকার প্রমাণ আছে পুলিশের কাছে। এই ফারাবী রাজাকারদের রক্ষার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বক্তব্য দিয়ে জল ঘোলা করার, সাধারণ মানুষকে বিভক্ত করার অপচেষ্টা করেছে বহুবার। ঘুরে ফিরে রাজাকার তথা জামাতি নেতাদের রক্ষার চেষ্টায় এরা দু'জনেই লিপ্ত। তাই জামাতের নাম আসাটা এখানে অবস্যই প্রাসঙ্গিক। তাছাড়া বাবু হত্যা মামলায় ধরা পরা দুই খুনি হেফাজতের দখলে থাকা দুটি মাদ্রাসার ছাত্র। তাদের ভাষ্য মতে মাদ্রাসার হুজুরের কথাতেই তারা বাবুকে হত্যা করেছিল। আর পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার মতে, সবগুলো খুনই একই সূত্রে গাঁথা। তাই বুঝতে বাকি থাকে এইসব হত্যাকান্ডের পিছনে মূল ইন্ধন দাতা কারা।

জামাত তথা কোন মৌলবাদি গোষ্ঠিই এই দেশে জ্ঞানের আলো চায় না। জাতিকে মেধা শূন্য করতে মেধাবি লেখকদের হত্যা করা হচ্ছে। এরা মানুষকে শিক্ষিত দেখতে চায় না। ওরা সাধারণ মানুষকে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হবার কথা বললেও নিজেদের সন্তানদের কোনদিন মাদ্রাসায় পাঠায় নি। গোলাম আজম, নিজামী, সাঈদী সহ জামাতের সকল বড় বড় নেতাই নিজেদের সন্তানদের দেশের বাইরে রেখে পড়ালেখা করিয়েছে নয়তো বড় বড় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়িয়ে পরে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। তারা চায়না মাদ্রাসাগুলোতে কাউকে জঙ্গিবাদ ছাড়া অন্য কোন শিক্ষা দেয়া হোক। তাই তারা দেশের সকল বড় বড় মাদ্রাসাগুলোকে তাদের দখলে নিয়ে কোমলমতি বাচ্চাদের ভিতরে মানুষ হত্যার বীজ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কারণ এটাই তাদের টিকে থাকার একমাত্র পুঁজি। দেশ এবং জাতি যতোদিন ওদের সৃষ্টি করা ধুম্রজালে বন্দী হয়ে থাকবে ততোদিনই এরা নিজেদের ছবি চাঁদে দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে ধর্ম ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু যদি মানুষ বিজ্ঞান বুঝতে শিখে, অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবন ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার রাস্তা খুঁজে পায়, ওদের সৃষ্টি করা ধুম্রজাল ছিড়ে বের হয়ে আসে তাহলে এইসব ধান্দাবাজ মৌলবাদিদের মুখোশ খুলে যাবে, এদের ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাবে, এদের না খেয়ে মরতে হবে, সাধারণ মানুষ এদের জুতা পেটা করে সমাজ ছাড়া করবে। তাই এরা বিজ্ঞান পছন্দ করে না। তাই এরা বিজ্ঞান মনস্ক লেখক পছন্দ করে না। তাই এরা এইসব সূর্য সন্তানদের শত্রু মনে করে।

একটি দেশে, দেশের সাধারণ মানুষ এবং তাদের সাধারণ কিছু স্বপ্ন থাকাটা কি অপরাধ ? একটি চিহ্নিত জঙ্গী গোষ্ঠি একের পর মেধাবি লেখককে হত্যা করে যাচ্ছে। কিন্তু তারা ঠিকই আইনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। সরকারও নির্বিকার। রাষ্ট্র কি বর্তমানে একটি নিথর মাটির দলা ছাড়া আর কিছুই না ? একটি স্বাধীন দেশের মুক্তমনা মানুষ শুকরের আঘাতে নিহত হয়। রাষ্ট্র যন্ত্র হাত পা গুটিয়ে বসে থাকে। বিচার করে না। তাদের কাছে বিচার ভিক্ষা চাইতে হয়। তবুও রাষ্ট্র যন্ত্র চুপ থাকে। বিচার চাইতে হয় কেন ? বিচার পাওয়া আমার নাগরিক অধিকার। তবুও কেন ভিক্ষুকের মত বিচার প্রত্যাশি হতে হয় ?

আমাদের চোখে স্বপ্ন দেয়া মানুষগুলো আজ নিজেরাই একেকটা স্বপ্ন হয়ে গেছেন। স্বপ্ন দেখা মানুষগুলো আজ চাঁদের শহরে ঘর বেঁধেছেন। তাঁদের নিয়ে গল্প হবে, শোকসভা হবে,মিছিল মিটিং সবই হবে। কিন্তু তাঁরা কি আর ফিরে আসবেন ? তাঁদের নামে কি আর কোন লেখা বাজারে আসবে ? তাঁদের বুনে যাওয়া বীজ কি কোনদিন বটবৃক্ষে রূপ নিবে ? সময়টা কি সত্যি সত্যি আজ নষ্টদের দখলে চলে যাচ্ছে ? এভাবেই কি জঙ্গীদের হাতে জিম্মি হয়ে থাকবে দেশ ? স্বপ্নেরা কি আর ডানা মেলে উড়বে না আকাশে ? আমরা কি তাহলে নষ্ট সময়ে বসে শুধুই কষ্টের মালা বানিয়ে গল্প রচনা করবো ? ঘরে বসে থেকে শুকরের চাপাতির কোপে মরে যাওয়ার চেয়ে নিজের গলায় নিজেই চাকু চালান, নতুবা প্রতিরোধ করুন শুকরদের। যেকোন একটি রাস্তা বেছে নিন। চুপ থাকলে বেঁচে যাবেন মনে করলে ভুল করবেন। একদিন আপনার নাম্বারও আসবে।

পরিশেষে অভিজিৎ রায়ের লিখে যাওয়া দুইটা লাইন উল্লেখ করতে চাই- ‘‘যারা ভাবেন বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের মতো জিনিস নিয়ে যখন থেকে আমরা লেখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লেখালেখি করছি।’’

 

দেবজ্যোতি দেবু, সংস্কৃতি কর্মি, অনলাইন এক্টিভিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ