Advertise
রণেশ মৈত্র | ০২ মে, ২০২০
মহান মে দিবস-২০২০। শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিক দিন-সংগ্রামের দিন-বিপ্লবী চেতনা বিকাশের মহান দিন। আন্তর্জাতিক সংহতি প্রকাশের দিন দেশ-বিদেশে লাল পতাকা হাতে নিয়ে, লালটুপি মাথায় নিয়ে বিশ্ববাসী শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের বিশাল বিশাল মিছিল, সমাবেশ ও শপথ গ্রহণের অসাধারণ এক উৎসব রাজপথগুলি প্রকম্পিত করে তোলার দিন।
দিনে বা রাতে আট ঘণ্টা শ্রমদান ও উপযুক্ত বেতনের দাবিতে ১৮৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিকাগো নগরীর হে মার্কেটে শ্রমিকদের মিছিলে পুলিশের গুলি চালনার পর এই দিনটি আর চিকাগো বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের মধ্যে সীমিত থাকেনি কালে ক্রমে তা হয়ে উঠেছে যথার্থই এক আন্তর্জাতিক শ্রমিক ও শ্রমজীবী দিবস।
বিজ্ঞাপন
আজ বিশ্বের শ্রমজীবী শ্রেণি সেদিন থেকে হিসেব করলে সুদীর্ঘ ১৩৪ বছর পেরিয়ে এলেও সেদিন আমেরিকার শ্রমিক শ্রেণি, গোটা পৃথিবীর শ্রমিক শ্রেণির পক্ষ থেকে দিনে বা রাতে আট ঘণ্টা শ্রম ও উপযুক্ত মজুরীর যে দাবি উত্থাপন করে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তুলতে ও বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণিকে সচেতন ও একতাবদ্ধ করে ঐ দাবিগুলি আদায়ে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, এতকাল পরেও কি আমরা নিজ নিজ দেশের শ্রমিক শ্রেণির সেই দাবি প্রতিষ্ঠিত হতে দেখছি?
২০২০ সাল বিশ্বময় করোনা রোগের আক্রমণ। আজ ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত দুইল লক্ষ চল্লিশ হাজার মানুষ এই করোনা ভাইরাসে হারিয়ে গেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। অত:পর দ্বিতীয় স্থান দখল করে আছে ইউরোপের দেশগুলি। অত:পর এশিয়া চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইরা, তুরস্ক প্রভৃতি দেশ। মৃত্যুর মিছিল চারিদিকে। বহু এলাকায় লাশের গন্ধও ভেসে আসে।
কারা এই ভয়াবহ আক্রমণের শিকার? সবাই-সব স্তরের মানুষই এর শিকারে পরিণত। কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি বৌদ্ধ, কি খৃষ্টান, কি জৈন, কি আস্তিক, কি নাস্তিক, কি নারী, কি পুরুষ, কি শিশু, কি বৃদ্ধ, কি যুবক, কি যুবতী, কি সাদা, কি কালো-সবাই, যথাই হচ্ছেন আক্রান্ত এবং তার একটি বড় অংশ ঢলে পড়ছেন মৃত্যুর অতল গহ্বরে।
পেশাগতভাবে ধরলে দেখা যায় কি ডাক্তার, কি উকিল, কি ব্যারিস্টার, কি জজ, কি ম্যাজিস্ট্রেট, কি কেরানী, কি পিওন, কি সাংসদ, কি মন্ত্রী, কি ব্যবসায়ী, কি দোকান-কর্মী, কি মিল মালিক, কি শ্রমিক, কি কৃষক, কি খেতমজুর, কি ধনী, কি গরীব-বৈষম্যহীনভাবে সবাই এ রোগের আক্রমণের শিকার।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ইংল্যান্ডের রানী, সৌদি রাজপরিবার পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের শিকার হয়েছেন-ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীসহ অনেককেই হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি হতে হয়েছিল। কিন্তু এঁরা তো ভি.আই.পি হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত তাই আমরা তাঁদের নাম জানতে পারছি। বাদবাকি লক্ষ লক্ষ মানুষ তো গয়রহ। তাদের নাম ঠিকানা কারও জানা নেই।
এমনই একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে কেউই বলতে পারবে না কোন দেশে কতজন ডাক্তার, কতজন নার্স, কতজন স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্ন কর্মী, কতজন উকিল, ব্যারিস্টার, কতজন নারী, কতজন পুরুষ, কতজন সাংবাদিক, কতজন চাকরিজীবী, কতজন বেকার, কতজন কৃষক, কতজন ক্ষেত মজুর, কতজন দিনমজুর, কতজন ধনী, কতজন গরীব, কতজন শিল্প মালিক, কতজন শ্রমিক, কতজন মধ্যবিত্ত, কতজন নিম্ন মধ্যবিত্ত, কতজন নিম্নবিত্ত, কতজন বিত্তহীন, কতজন নারী বা কতজন পুরুষ এ যাবত আক্রান্ত হয়েছেন বা মৃত্যুবরণ করেছেন। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে ২০২০ এর মে দিবস কী বার্তা দিয়ে যাবে? পরিস্থিতি এমনই যে পৃথিবীর সকল দেশেই এবং গোটা পৃথিবী লক ডাউন থাকায় এবারে বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণিকে ভিন্ন স্বাদের এক মে দিবসের সম্মুখীন হতে হলো।
বাংলাদেশে ব্যাপক কর্মহীনতা। কলকারখানা বন্ধ। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক নিজ নিজ বাড়িতে গ্রামে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছেন। গার্মেন্টস মালিকেরা সরকারি আদেশ মানবেন বললেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মার্চের বেতনই আজ পর্যন্ত শোধ হয় নি। পরিবহন খাতে কর্মরত লক্ষাধিক শ্রমিক কর্মজীবী আজ পুরোদস্তুর ঘরে বসা। তাঁদেরও বেতন নেই। বেসরকারি খাতের কলকারখানা যেমন পাটকল, চিনিকল প্রভৃতিও বন্ধ আজ অনেকদিন যাবত। এখানে কর্মরত লক্ষাধিক শ্রমিক তাঁদের পরিবারের পাঁচ লক্ষাধিক নির্ভরশীল মানুষ নিয়ে অবর্ণনীয় দুর্দশার সম্মুখীন। কটন মিলগুলির ক্ষেত্রেও একই দুরবস্থা।
বিজ্ঞাপন
সরকার অবশ্য কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা গার্মেন্টস সেক্টরের শ্রমিকদের বেতন নিয়মিত পরিশোধ করার জন্য স্বল্পসুদে বরাদ্দ করেছেন। কিন্তু পুরো টাকাটাই মালিকরা পকেটস্থ করতে এবং পুরোপুরি সুদমুক্ত ও অফেরতযোগ্য ঘোষণার আবদার নিয়ে শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার কথা বলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। মে মাস চলছে কিন্তু আজও অনেকেই মার্চ মাসের বেতনই পান নি। এই শ্রমিকদের পেটের ভাত পান নি। এই শ্রমিকদের পেটের ভাত জোটানোর সমস্যা মারাত্মক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তদুপরি অঘোষিত ছাঁটাই এর পাল্লায় পড়েছেন বিভিন্ন কলকাখানার অধিকাংশ শ্রমিক। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের বেশির ভাগই নারী। সংসার তাঁদের উপর নির্ভর করে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তাঁদের বসবাস। পুষ্টিকর খাবার দিবাস্বপ্ন মাত্র।তদুপরি অসৎ ব্যবসায়ীরা পরিবহন সেক্টর বন্ধ থাকার এবং পবিত্র রমজানের অজুহাতে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যাপক হারে। সরকার মৃদুস্বরে কারখানা মালিকদেরকে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করতে এবং ব্যবসায়ীদেরকে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি না করতে আহ্বান জানালেও উভয় পক্ষেই সে ক্ষেত্রে সরকারকে দিব্যি বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বহাল তবিয়তে তাদের গণ-বিরোধী কাজ তারা করেই যাচ্ছে।
প্রশ্ন জাগে, এমনটি কেন ঘটছে? মিল-কারখানার মালিকেরা ও অসৎ ব্যবসায়ীরা বে-আইনি কাজ করছে দেখেও সরকার নীরব ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে কোন সাহসে? বিষয়টি আসলে শ্রেণিগত। ঐকারখানা মালিক, ব্যবসায়ী, ব্যাংক লুটপাটকারী ধনিকশ্রেণি (যাদের মধ্যে দেশপ্রেম বলতে কিছু নেই)। অধিক থেকে অধিকতর মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে তারাই সর্বত্র বিচরণ করে শোষক হিসেবে। শ্রেণি বৈষম্যের কারণেই শ্রমিকেরা অতীতের মতই হয়তো বা তার চাইতেও বেশি শোষণ নির্যাতনের শিকারে পরিণত এবং এর বিরুদ্ধে শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা নিয়মিত আদায়ের জন্যে, বাসযোগ্য বাসস্থানের জন্য, কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য, মাতৃত্বের বাবদ কমপক্ষে ছয় মাসের বেতন ছুটির জন্য, বাসস্থান থেকে কর্মস্থলে, যাতায়াতের জন্য পরিবহন ভাতার জন্য, চিকিৎসা ভাতার জন্য ইত্যাদি।
সরকার মুখে এর প্রতিটি দাবির সমর্থক হলেও মালিকদের প্রতিচাপ দিয়ে তা আদায় করে দিতে পুঁজিবাদী শোষণ ভিত্তিক সমাজ নারাজ কারণ ঐ ধনিক শ্রেণি যেমন মালিক সরকারও ধনিক শ্রেণিরই সাংসদেরাও তাই। এক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক, নির্বাচিত-অনির্বাচিত সকল সরকারই একই স্বার্থের রক্ষক। পুঁজিবাদ বিরোধী সচেতন সংগঠিত সংগ্রামে সকল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি। কিন্তু আজও পৃথিবীতে পুঁজিবাদী দেশগুলির সংখ্যা বিপুল। তারাই কোথাও নির্বাচিত সরকারের নামে, কোথাও অনির্বাচিত সামরিক-বেসামরিক সরকারের নামে শ্রমিক শ্রেণির উপর নির্মম শোষণ নির্বিবাদে চালিয়ে যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
আজ ২০২০ সালে করোনা সম্পূর্ণভাবে নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। পৃথিবীর সকল দেশের শ্রমিক শ্রেণি জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে করোনায় ভয়াবহভাবে আক্রান্ত। অসংখ্য শ্রমিকের মৃত্যু নিশ্চিতভাবেই ঘটেছে এবং আজও ঘটে চলেছে পৃথিবীর সকল দেশেই। এই মৃত্যুর এই আক্রান্তের মধ্যে কতজন শ্রমিক কোন দেশে করোনা আক্রমণ ও মৃত্যুর শিকার কতজন শ্রমিক নিজেদের স্ত্রী-সন্তানদেরকে, কতজন তাঁদের স্ত্রী সন্তানকে হারিয়েছে নিঃস্ব হয়েছেন, কতজন পরিবারের সকল সদস্যসহ আক্রান্ত হয়ে প্রাণে বেঁচে থাকার জন্য বাড়িতে বা হাসপাতালে লড়াই করছেন তা সবই আজও অজানা থাকলেও সামগ্রিক চিত্রটি যে অত্যন্ত ভয়াবহ তা সকলেই উপলব্ধি করি।
তাই এবারের মে দিবসে প্রত্যয় হোক-
এক. জীবন, জীবিকা ও অর্থবহ জীবনের জন্য বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণির ঐক্য প্রতিষ্ঠা;
দুই. করোনায় আক্রান্ত বা মৃতদের পরিবারের জন্য বিশেষ প্রণোদনা আগামী তিনবছর ধরে দেওয়ার স্বীকৃতি আদায়;
তিন. দ্রব্যমূল্য সর্বত্র বৃদ্ধি পাওয়ায় বেতন আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি;
চার. সকল কারখানা ও অপরাপর শ্রমিকের হাল-বকেয়া বেতন অবলম্বে পরিশোধ;
পাঁচ. আদৌ কোন কারখানা বন্ধ বা কোন শ্রমিক ছাঁটাই চলবে না;
ছয়. করোনা আক্রান্ত মৃত শ্রমিকদের পরিবারের সদস্য, সদস্যদেরকেই মৃতের শূন্য পদে অবিলম্বে নিয়োগ দান এবং
সাত. পুঁজিবাদী শোষণ ব্যবস্থার উচ্ছেদ করে শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের জন্য বিশ্বের শ্রমিক-কৃষক, খেত মজুর, নিম্ন ও মধ্যবিত্তের বিপ্লবী ঐ এক প্রতিষ্ঠা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য