আজ রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫

Advertise

পার্টি পোয়েট র‍্যাপিড টেস্টিং কিট

মাসকাওয়াথ আহসান  

সম্প্রতি আমার খুব প্রিয় একজন কবি নিজেকে 'আওয়ামী লীগের কবি' বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এর আগে আমার প্রিয় আরেকজন কবি জামায়াতের কবি হিসেবে নিন্দিত হয়েছিলেন। কবির একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ হয়তো থাকতে পারে; কিন্তু 'দলীয় কবি' কখনো সমগ্রের কবি নন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেইকালে গান্ধীজীর দেয়া 'কংগ্রেসের কবি' হবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি তার 'ঘরে বাইরে' উপন্যাসে দেশপ্রেমের নামে মানুষ ঠকানোর এই রাজনীতি ব্যবসার স্বরূপ উদঘাটন করেছেন। আজ এতকাল পরে সমসাময়িক চিন্তক ইউভাল নোয়াহ হারারি জাতীয়তাবাদের যে ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করেন; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই কত আগে এ সম্পর্কে আলোচনা করে গেছেন।

ভারতীয় উপমহাদেশে ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়েই রাজ কবি ও অরাজ কবি, রাজ সুফি ও অরাজ সুফির উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই। তারমানে দলীয় কবি ও মানুষের কবি দু'রকম কবির উপস্থিতি এ সমাজে আবহমানকাল ধরেই রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কবি একজন চিন্তক; শয়নে-স্বপনে-জাগরণে সে চিন্তক। একজন চিন্তকের পক্ষে কায়িক পরিশ্রম করা কঠিন। ফলে জীবন নির্বাহের জন্য ন'টা-পাঁচটা কাজ করা কঠিন। কারণ কবিতা নিজেই একটি ফুল টাইম জব।

ভারতীয় উপমহাদেশের বাস্তবতায় রাজকবি আর সামাজিক মাধুকরীতে অরাজ কবির বিকাশ আমরা দেখতে পাই। ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ গভীরভাবে কবির অনুরাগী। ফলে রাজা-বাদশাহ'র পক্ষে প্রচার চালিয়ে বেড়ানো সুফিদের বিপরীতে বিদ্রোহী অরাজ সুফিদের সমাজ লালন করেছে গভীর স্নেহে।

যারা রাজকবি ও রাজসুফি হয়েছেন; তাদের কিছু কবিতা হয়তো সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আজো বেঁচে আছে; কিন্তু আমাদের পাঠ অভিজ্ঞতায় অরাজ কবিদের কবিতাগুলোকেই বেঁচে থাকতে দেখি।

কবি চিন্তার রাজা; ফলে যে কোন রকম চিন্তার দাসত্ব তার জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশ গানের দেশ; কবিতার দেশ; ফলে এখানে কবিতার গুরুত্ব অক্সিজেনের মতো।

বাংলাদেশ রাজনীতিবিদ-ব্যবসায়ী-প্রশাসন-সেনা সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক রাজকীয় গণতন্ত্র। এইখানে ধর্মীয় বিভাজনের অনুরূপ এক রাজনৈতিক বিভাজন রয়েছে। এইখানে হিন্দুধর্মের কুসংস্কার "তুই অস্পৃশ্যকে স্পর্শ করেছিস; তুই অশুদ্ধ হয়ে গিয়েছিস"; কিংবা ইসলাম ধর্মের প্রচলিত কুসংস্কার "তুই মহানবীর বিরুদ্ধাচরণ করেছিস; তুই কাফের হয়ে গেলি"; ঠিক এরকম কট্টর রক্ষণশীলতা কাজ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে। ফলে কবিকে ডেকে পার্টির ক্যাডাররা কলার ঝাঁকিয়ে বলতে পারে, আপনি আপনার রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করুন। হিন্দু বা মুসলমান হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার মতো "দলীয় কবি" হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করে বেড়াতে হয় কবিকে। মুসলমান হিসেবে নিজেকে প্রমাণ দিতে যেমন মসজিদে যেতে হয়; দলীয় কবি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে কবিকে "রাজনীতির মাজারে" যেতে হয়।

রাজনীতির মিডলম্যান হিসেবে যারা "ফইন্নি থেকে ফড়িয়া হয়ে অবশেষে ফন্ত্রী" হয়; তাদের জীবন সাদা অথবা কালো; টাকা আছে অথবা টাকা নাই; এরকম মোটাদাগে পরিচালিত।

কিন্তু কবির জীবন তো সাদা-কালো, টাকা আছে-টাকা নাই; এরকম হিসেবে চলেনা; কবির জীবনে আসল কথা, কবিতা আছে কিনা!

বাংলাদেশের কবিতা সাহিত্যের সবচেয়ে বিকশিত শাখা। ষাটের ও সত্তরের দশকে বাংলাদেশে কবিতার নবজাগরণ ঘটে। বাংলাদেশের কবিতা মানুষের মুক্তির সোপান রচনা করে। সেই সময়ের দীর্ঘকায় কবিদের খর্বকায় বানানোর যে দ্বি-দলীয় প্রক্রিয়া চলেছে; আল-মাহমুদ ও নির্মলেন্দু গুণ সেই অকাব্যিক কবি হত্যার দুটো ট্র্যাজিক উদাহরণ মাত্র।

কবি সে রাজকবি হোক কিংবা অরাজকবি হোক; পাঠকের কাছে বিবেচ্য তার কবিতা। যেসব সাদা-কালো দলীয় কীটেরা "পার্টি পোয়েট র‍্যাপিড টেস্টিং কিট" হাতে নিয়ে ঘুরে; তারা মিডলম্যান বা ফড়িয়া। এরা পঙ্গপাল হিসেবে কবিতার শস্যক্ষেত্রটি তছনছ করার চেষ্টা করে অবশেষে বঙ্গপাল হিসেবে বিদায় নেবে।

কিন্তু কবিতার শস্যক্ষেত্রে আল-মাহমুদ ও নির্মলেন্দু গুণ যে ফসল ফলিয়েছেন; তা নিঃশেষ করার ক্ষমতা যে রাজনীতি ও ধর্ম-ব্যবসার ফড়িয়াদের নেই।

বিজ্ঞাপন

বিদ্যমান বাস্তবতায় যে তরুণেরা কবিতা বা শিল্পের অন্যান্য শাখায় বিচরণে আগ্রহী; তাদেরকে দলীয় রাজনীতির প্রতি "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের" সুস্পষ্ট প্রত্যাখ্যানটিকে আমলে নিতে হবে বলে মনে হয়। নিরাপোষ কবি জীবনানন্দ দাশ, আবুল হাসান, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ কবিতাকে মৃত্যুপথের যাত্রী করেছেন; কিন্তু ভুল করে একবারও রাজকবি হবার কথা ভাবেননি। পদ-পদবী-পদকের প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহবোধ তারা করেননি।

"উদিত দুঃখের দেশ"-এর কবি আবুল হাসান কবিতাকে ভালোবেসে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন; বলেছেন, "মিলনই মৌলিক"। আবুল হাসান মৃত্যুকে মিলন বলেছেন; অথচ আবুল হাসানের কবিতার মৃত্যু হয়নি। কবিতা তৃষ্ণা নিয়ে ছুটে আসা পাঠকের সম্মিলনী হয়ে উঠেছে যেন।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৫ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৮ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১১০ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪৫ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৪ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২৭ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন