আজ বৃহস্পতিবার, ০৯ মে, ২০২৪

Advertise

যে হত্যার দায় সংখ্যাগুরু বাঙালি হিসেবে এড়ানো কি সম্ভব?

ইমতিয়াজ মাহমুদ  

১৯৮৯ সনের মে মাসের চার তারিখে রাঙামাটি জেলার লঙ্গদু উপজেলায় ঘটে যাওয়া গণহত্যার কথা স্মরণ করি। এই ঘটনাটি আমার জন্যে ব্যক্তিগতভাবে একটু বেশিই শোকের, কেননা এই ঘটনার মুল কেন্দ্র তিনটিলা গ্রামের স্বর্গীয় অনিল বিহারী চাকমার বাড়ি। অনিল বিহারী চাকমা ছিলেন লঙ্গদুর একজন জনপ্রিয় নেতা- হেডম্যান ছিলেন, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন, এছাড়াও নানারকম সংস্থা ও সংগঠনের সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন। অনিল বিহারী চাকমার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল লঙ্গদুতেই ১৯৮১ সনে। আমার পিতা লঙ্গদুর সার্কেল অফিসার ছিলেন। পরে যখন থানাগুলিকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় তখন তিনি হয়ে যান সেখানকার প্রথম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।

আমার পিতা লঙ্গদুতে একাই থাকতেন। আমি যখন সেখানে যাই, অনিল বিকাশ চাকমার বাড়িতে আমাদের একদিন দুপুরের খাবারের দাওয়াত ছিল। সেবার ভদ্রলোকের সাথে আমার দেখা হয়। এর পরের বছর রাঙামাটি কলেজে পড়তে আসে অনিল বিকাশ চাকমার কন্যা অজন্তা। ওর ডাকনাম ছিল মুনিঙ্গা। তারও পরে পরিচয় হয়েছিল মুনিঙ্গার বড় ভাইয়ের সাথে। তিনি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। বছর তিনেক আগে পরিচয় হয় মুনিঙ্গার ছোট ভাইয়ের সাথে। সে এখন ওখানকার হেডম্যান এবং নির্বাচিত ইউপি চেয়ারম্যান। এই পরিবারটি এই ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঘটনার শুরু হয় একজন সেটেলারের হত্যা দিয়ে। জিয়াউর রহমান পাহাড়ে আদিবাসীদেরকে নিজভূমে সংখ্যালঘুতে পরিণত করার উদ্দেশ্যে পাহাড়ে কয়েক লক্ষ বাঙালিকে সরকারি উদ্যোগে নিয়ে গিয়ে সেটল করিয়েছিল। এদের একটা বড় অংশকে পাঠানো হয়েছিল লঙ্গদুতে। এদেরই একজন ছিল আব্দুর রশিদ নামে একজন সেটেলার। মে মাসের চার তারিখে কে বা কারা আব্দুর রশিদকে হত্যা করে। এই হত্যার সাথে আদিবাসী কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের কোন সংযোগের কোন প্রমাণ অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি। এই হত্যাকাণ্ডের কোন তদন্ত না করে এই ঘটনাটিকে কাজে লাগানো হয় লঙ্গদুতে আদিবাসীদের উপর এই নৃশংস আক্রমণের অজুহাত হিসাবে।

বিজ্ঞাপন


আব্দুর রশিদের হত্যাকে উপলক্ষ করে লঙ্গদুর গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী আর সেটেলাররা মিলে আদিবাসী গ্রামগুলিতে হামলা শুরু করে। গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী বা ভিডিপি ছিল শুধু সেটেলারদের নিয়ে গড়া অনেকটা আনসার টাইপ একটা বাহিনী। ওদের ইউনিফর্ম ছিল খাকি প্যান্ট লাল শার্ট আর লাল টুপি। টার্গেট করে করে একেকটা গ্রামে ওরা হামলা করতে থাকে। সবচেয়ে বেশি হতাহত হয় তিনটিলা গ্রামে। তিনটিলা হচ্ছে অনিল বাবুর গ্রাম। সেখানে সবচেয়ে জঘন্য হামলাটা হয় অনিল বাবুর বাড়িতেই। ওদের বাড়িটাকে যেন একটা কসাইখানায় রূপান্তর করে ঘাতকের দল।

অনিল বাবুর স্ত্রী মিসেস অমিতা চাকমাকে প্রথমে গুলি করা হয়। তারপর সেটেলাররা তাকে বর্শা বল্লম এইসব দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে। সেই বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া সবাইকেই ওরা আক্রমণ করে। কেউ কেউ প্রাণে বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হয়। কিন্তু আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়নি কেউই। ফ্যামিলি প্লানিং অফিসের একজন কেরানি মুরাতি মোহন চাকমা, তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়, তারপর তাকে কেটে কয়েক টুকরা করা হয়। ওর নয় বছরের শিশু পুত্র সজল চাকমাকে হত্যা করা হয় বেয়নেট বা ধারালো কিছু দিয়ে। জাগরণ চাকমা নামে এগারো বছরের একটি বাচ্চা- কয়জনের নাম বলবো!

তিনটিলা ট্রামে সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়। এছাড়া মানিকজোড় ছড়া, বাত্যা পাড়া, বড়আদাম, মহাজন পাড়া, সোনাই, আতারক পাড়া, করালিয়া ছড়া এইসব গ্রামে হামলা হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় কয়েকশ ঘরবাড়ি। বাড়িঘর লুটপাট করা হয়। বৌদ্ধ মন্দিরগুলিতে হামলা হয়। পাঁচটা কি ছয়টা বৌদ্ধ বিহারে হামলা হয়। বিহারগুলি ভাঙচুর হয়। কয়েকটা বিহারে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। প্রত্যেকটা বিহারে বুদ্ধের মূর্তি ভাঙচুর করা হয়। একটা বিহার থেকে তামার বুদ্ধ মূর্তি আর হাতির দাঁতের বুদ্ধ মূর্তি চুরি করে নিয়ে যায় ওরা। আর তিনটিলা বন বিহারে ঠাই সরকারের উপহার দেওয়া বিশাল বুদ্ধ মূর্তিটিকে নিতান্ত অবমাননার জন্যে সেটেলাররা ওটার উপরে উঠে লাফালাফি করে মূর্তিটার কান ভেঙে দেয়।


টানা তিনদিন ধরে চলে এই নৃশংস হামলা- মে মাসের চার পাঁচ ও ছয় তারিখ। মুল হামলাটা হয় চার তারিখেই। পাঁচ তারিখ চট্টগ্রাম থেকে সিনিয়র সেনা কর্মকর্তারা যান সেখানে, সাথে করে গৌতম দেওয়ানসহ কয়েকজন আদিবাসী নেতাকেও নিয়ে যান। সেখানে ওরা সেটেলারদেরকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। সেটেলারদেরকে ডেকে সভা করেন। কিন্তু মিলিটারির জেনারেলরা ওখানে থাকা অবস্থায়ও ছয় তারিখ পর্যন্ত কয়েকটা গ্রামে হামলা হয়।

কতজন মারা গিয়েছিল এই হামলায়? কয়েকটা রিপোর্টে পঞ্চাশ জনের বা বায়ান্ন জন্মের মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সঠিক সংখ্যা নিশ্চিত করে বলার উপায় নাই। গুরুতর আহত হয়েছিল অনেকে। বাড়িঘর পুড়েছে অসংখ্য। মাঠের পাকা ধান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলজ গাছ ধ্বংস করা হয়েছে। এলাকার বেশিরভাগ আদিবাসীরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। কেউ কেউ গিয়ে ওঠে আরও ভিতরে গভীর জঙ্গলে আর একটা অংশ পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় ভারতের মিজোরামে। আর আদিবাসীরা যখন এইরকম পালাতে থাকে, সেই সময় আদিবাসীদের ফসলি জমি আর ভিটামাটি সরকার বরাদ্দ দিয়ে দেয় সেটেলারদের মধ্যে।

এটা নিয়ে ঢাকায় তখন সেরকম কোন প্রতিবাদ হয়নি। দেশের রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা তখন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ব্যস্ত। স্থানীয়ভাবে লঙ্গদুর লোকেরা প্রেসিডেন্টের কাছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে দরখাস্ত স্মারকলিপি এইসব পাঠিয়েছিল। কোন কাজ হয়নি। মে মাসের দশ তারিখে রাজা দেবাশিষ রায় একটা স্মারকলিপি পাঠিয়েছিলেন রাঙামাটি জেলা প্রশাসকের কাছে। উল্টা ওরা রাজাবাবুকে গৃহবন্দি করে রাখেন কয়েকদিন, তিনি যেন এইসব কথা অন্যদের কাছে জানাতে না পারেন।

তারও বেশ পরে, এরশাদের পতনের পর যখন বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বেগম জিয়ার কাছে একটা রিপোর্ট পেশ করে এই ঘটনার তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের বিচার চেয়েছিল।

বিজ্ঞাপন


অনিল বিকাশ বাবু সে বার ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। ৪ তারিখ সন্ধ্যায় হামলা শুরু হয়। নিহত স্ত্রীর মৃতদেহ নিয়ে তিনি সারারাত লুকিয়ে ছিলেন জঙ্গলে। আজ তিনি আর আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার ছেলেমেয়েরা আছে। ওরা সবাই এই ঘটনা জানে। এলাকার আরও ভুক্তভোগীরা আছে, যারা এই ঘটনার সাক্ষী। ইচ্ছে করলে এখনো এই ঘটনার তদন্ত ও বিচার করা সম্ভব। কিন্তু আমি জানি এই ঘটনার তখনো কোন তদন্ত হয়নি, বিচার হয়নি এখনো কোন তদন্ত হবে না বা বিচার হবে না।

আপনি যদি সেই সময়কার লোকজনকে জিজ্ঞাসা করেন, তাইলে শুনতে পারবেন ঘটনার ভয়াবহতা। লোকে এই ঘটনার জন্যে সেটেলার নেতৃবৃন্দ ও সেনা কর্মকর্তাদের নাম ধরে অভিযোগ করে। আমি সেইসব নাম বা সেনা কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা কিছু বললাম না- কেননা এইসব অভিযোগ যতয়ই কিনা সেকথা নিশ্চিত করে সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়ে বলা সম্ভব না। কিন্তু যদি আনুষ্ঠানিক তদন্ত হয় তাইলে দায়ী ব্যক্তিদেরকে এখনো চিহ্নিত করা সম্ভব।

অনিল বিকাশ চাকমার কন্যা মুনিঙ্গা রাঙামাটি কলেজে আমার এক বছরে জুনিয়র ছিল। আমার কপাল ভাল মুনিঙ্গার সাথে বা ওর বোনদের সাথে আমার আর কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। ওর ছোটভাই যে এখন হেডম্যান, ওর সাথে বছর দুই তিন আগে একবার ঢাকায় দেখা হয়ে গিয়েছিল। লজ্জায় গ্লানিতে আমি ওর সাথে ঠিক করে কোথাও বলতে পারিনি। কীসের লজ্জা? কীসের গ্লানি? এই ঘটনায় ওরা ওদের মাকে হারিয়েছে। এই ঘটনার দায় বাঙালি হিসাবে আমারও একটু নাই? আছে তো। আছে। দেশের বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের একজন হিসাবে এই মর্মান্তিক নৃশংস অন্যায়ের দায় আমি কী করে এড়িয়ে যাব? সে কি সম্ভব?

ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০৪ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৮ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ