প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ০৪ মে, ২০২০
করোনার বিপদ ধেয়ে আসার পর থেকে আজ অবধি একটি শ্রেণিকে লক্ষ্য করলাম জনগণকে ক্রমাগত দায়ী করে চলেছে সমুদয় বিপর্যয় ও অব্যবস্থাপনার জন্য। শুধু করোনাভাইরাস কেন, ডেঙ্গি ভাইরাসের জন্য তারা জনগণের দোষ দিয়েছে। বলেছে- পাবলিক বাদামের খোসা, চিপসের প্যাকেট, ডাবের খোসা ফেলে ঢাকার ড্রেনগুলো অকেজো করে দিয়েছে। তাই এ শহরে জলাবদ্ধতা আর সেখানেই ডেঙ্গি মশা বংশ বিস্তার করেছে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের বিরোধিতা করে বলেছে, পাবলিক দেইখা চলেনা; গরু-ছাগলের মতো রাস্তায় চরে বেড়ালে বাস-ট্রাকের নিচে পড়ে তো মরবেই। আর করোনাকালে ভাইরাস সংক্রমণের সব দায় জনগণের। এসময়ে অনেককেই দেখলাম; রীতিমত "হ্যাশট্যাগ এগো ঘুরাইয়া চটকানা দেয়া দরকার" সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ড চালু করেছে।
বিজ্ঞাপন
একটা সুতীব্র সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্ট কাজ করে এদের মধ্যে। দেশটা তাদের পোদ্দাদার; দয়া করে জনগণকে থাকতে দিয়েছে। জনগণ তাদের বসবাসের এলাকাটিকে নোংরা করে ফেলেছে।
ব্রাহ্মণকে দেখেছি এমনটা "ছ্যা ছ্যা" ভাব নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে। সেসময় তাদের নাসিকা প্রায় কুঞ্চিত থাকতো। পাঞ্জাবি "আশরাফ" মুসলমানদের দেখেছি এমন একটা "ছ্যা ছ্যা" ভাব নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে। "এদের গায়ে মাছের গন্ধ" বলে নাসিকা কুঞ্চিত হতো তাদের। দক্ষিণ এশিয়ায় "অন্যকে ছোট করে নিজেকে বড়" করার প্রবণতা আর "মানুষের অপমান দেখিয়া বর্বর আনন্দ লাভের" বিকৃতি সশব্দে সমাজ দাপিয়ে বেড়ায়।
দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ সহজ সরল কৃষক-সমাজের মানুষ। ফসল ফলায়; নিজের অন্ন নিজে জোগাড় করে। অবসরে সবাইকে নিয়ে গল্প করে, গান গায়। আকাশে চাঁদ উঠলে তার মন উচাটন হয়; চাঁদের টানে জোয়ার-ভাটা হয় নদীতে; মানুষের মনও নদীর মতো খেয়ালি। দক্ষিণ এশিয়া বাউল ও সুফি গানের সংস্কৃতিতে এক সহজাত সাম্যভাবনা অনুশীলনের জনপদ। এর সমৃদ্ধ এক আতিথেয়তার সংস্কৃতি আছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এক অদৃশ্য মায়ার বন্ধনে উষ্ণ।
সেইখানে হিন্দু ধর্মের কাস্ট সিস্টেম, ইসলাম ধর্মের আশরাফ-আতরাফ বিভাজনের মাধ্যমে যুগে যুগে একটি অভিজাত সম্প্রদায় মাথাচাড়া দিতে চেষ্টা করেছে। কোন ভাবে ক্ষমতা কাঠামোর সহমত ভাই হতে পারলেই; আভিজাত্যের পৈতে পরা যায়। রাজ-উপাসক হয়ে কিছু ধন-সম্পদের মুখ দেখলেই জনগণকে দলিত বা ইনফেরিয়র ভাবা যায়।
সেই "রাজতোষণ ও কথিত সুপিরিয়রিটি অর্জনকেই" দক্ষিণ এশিয়ায় সাফল্য বলে চিহ্নিত করা হয়। ১৯২০-এর পশ্চিমা পৃথিবীতেও ক্ষমতা ও কথিত সুপিরিয়রিটি অর্জনকে সাফল্য বলে মনে করা হতো। কিন্তু ২০২০ সালে সেখানে "সুপ্রিমিস্ট" হওয়াকে কট্টরপন্থা ও ঘৃণ্যকাজ বলে মনে করে সেখানকার সামষ্টিক সমাজ। সৌদি আরব, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ "সুপ্রিমিস্ট" হওয়াকে জীবনের স্বপ্ন হিসেবে দেখে। সে কারণে "সরকারের সহমত ভাই" হবার ইঁদুর দৌড় চলে এই ১৯২০ টাইপের সমাজগুলোতে।
খুব আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আগের দিন যে ভিক্ষুক ছিলো; পরের দিন সে বিরাট ধনী হয়ে যেতে পারে; সরকারের সহমত ভাই হয়ে, বালিশ বিক্রি বসন্তের কমিশন বাণিজ্যে। দক্ষিণ এশিয়ার সফল জীবন চক্র হচ্ছে, ফইন্নি থেকে ফড়িয়া হয়ে ফন্ত্রী হওয়া।
এই মধ্যবর্তী ফড়িয়া শ্রেণিটিই রাতারাতি মানসিকভাবে "অভিজাত" হয়ে পড়ে। এরাই জনগণকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। এদেরকে ক্ষমতা কাঠামোর কোলাবরেটর বললে এদের বর্বর আত্মপরিচয় খুঁজে পেতে সহজ হবে।
নাৎসি সুপ্রিমিস্টের দেশ জার্মানি সামাজিক গণতন্ত্র চর্চা করে; মাত্র দুই-তিনটি দশকের মধ্যে সভ্য সাম্য ভাবনার সমাজ গড়তে পেরেছিলো। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো স্বাধীন হবার পর পাঁচ থেকে সাতটি দশকে; আরও বেশি অসাম্য, শোষণ-নিপীড়নের কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই মহাভারতে সরকারের কোলাবরেটরেরা আজ জনগণের মাথার খুলি নিয়ে রীতিমত ফুটবল খেলছে।
ফইন্নি থেকে রাজন্য হয়ে কথায় কথায় জনগণকে "আবাল" বলছে; যেন নিজেরা টিশার্ট-জিনস পরে-এক বাটি কফি খেয়ে; ব্রাহ্মণ বা আশরাফ হয়ে উঠেছে। আর জনগণের বুদ্ধিহীনতা দেখে তাদের "হ্যাশট্যাগ" ঘুরাইয়া চটকানা দিতে ইচ্ছা করে। নিজেরা এক একটি বিরাট স্কলার এয়েচেন; আইকিউ খলবল করছে ছোট্ট খুলিটিতে।
বিজ্ঞাপন
পঞ্চাশ থেকে সত্তর বছরে এটা বুঝতে বাঁকি নেই; সভ্য রাষ্ট্র-ব্যবস্থাপনা করতে পারার মতো যোগ্যতা নেই দক্ষিণ এশিয়দের। এর কারণ উপনিবেশ বিদায় নেবার পর থেকে ব্যবসায়ী -রাজনীতিবিদ-প্রশাসন-সেনা সমন্বয়ে একটা নব্য-অভিজাত সমাজ তৈরি হয়েছে। এদের যোগ্যতা জনগণের সঙ্গে প্রতারণা, তাদের লুণ্ঠন, বন্দুকের নল আর সত্য অস্বীকার বা ডিনাইয়াল। এদের নৃশংসতা ইতিহাসের যে কোন সময়কে হার মানিয়েছে।
দেশ চালানোর যোগ্যতা নেই; অথচ দেশটার রাজা ও রাজন্য হয়ে থাকতে হবে। সুতরাং ডিনাইয়াল আর জাস্টিফিকেশনের জন্য অসংখ্য কোলাবরেটর গ্যাং পুষতে হয়ে তাদের। এরা টিভি টকশোতে লিপ-সার্ভিস দেয়, সোশাল মিডিয়ায় ফিঙ্গার সার্ভিস দেয়, আর ভূমি বাস্তবতায় গুম সার্ভিস দেয়। এদের কথা একটাই, সরকারের কোন দোষ নেই; দেশের সব বিপর্যয়ের জন্য দায়ী সাধারণ জনগণ।
দক্ষিণ এশিয়ার মানুষেরা যেন একটা মৃত্যু ফাঁদে আটকে পড়েছে। ঠগের উপনিবেশে জীবন তো নেই; আছে জীবন্মৃত জনতা। তবে মানুষের ওপর বিশ্বাস হারাতে নেই; এই মানুষই পারে মানুষকে সুদিনের কাছে পৌঁছে দিতে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য