আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বিদ্যানন্দ ও আমাদের ধর্মানুভূতি

আলমগীর শাহরিয়ার  

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাশ সংগঠনের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে চেয়েছিলেন। অভিযোগ হিসেবে সংগঠনের ভেরিফাইড পেজের এক পোস্টে বলেছেন তাঁর ধর্ম পরিচয়ের জন্য সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারের শিকার হচ্ছেন, এতে সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 'বিদ্যানন্দ'— এর মতো সুন্দর একটি নামের সঙ্গে যেদিন প্রথম পরিচয় হয়েছিল সেদিনই মনে একটা কু ডেকেছিল। প্রবল অনুভূতিশীলদের টার্গেট হতে পারে। হলোও তাই। অথচ এ নামটির মধ্যে হিন্দুয়ানির কিছু নাই। এটা কোন দেব দেবী বা পূজা আরাধনার অনুষঙ্গ না। কিন্তু মগজে আছে জীবনানন্দ, অতুলানন্দ, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ মানে তো বিধর্মী। সুতরাং বিদ্যানন্দও বিধর্মী না হয়ে যায় না। কর্ণধার হিসেবে কিশোর কুমার দাশ তো আছেই।

বিজ্ঞাপন

যে দেশে সন্তান জন্মের পর বাবা মা ঘোষণা দেন খাঁটি আরবি, ফার্সি, উর্দু নাম চাই— সেখানে বিদ্যানন্দ নাম দেখে কেউ বিভ্রান্ত হতেই পারে। এলার্জি শুরু হওয়ারই কথা। অথচ এই দেশটি সৃষ্টি হয়েছিল মাতৃভাষার অপমান প্রতিরোধে ভাষা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। রাজপথে তারুণ্যের নতুন দিনের শপথমাখা রক্ত ও জীবন দিয়ে। ধর্মান্ধরা ভুলে যায় "যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ/ সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন।" ঈশ্বর, আল্লাহ তো তাদের মতো নির্বোধ নন, তিনি সকলের ভাষা বুঝেন। বুঝে না শুধু অবোধেরা।

বিদ্যানন্দ— নামটি একজন মুসলিম ব্র্যান্ড এক্সপার্টের দেয়া(হিন্দু বা খ্রিস্টান কেউ দিলেও তো সমস্যার কিছু দেখি না)। যার মূল প্রতিপাদ্য আনন্দের মাধ্যমে বিদ্যা অর্জন। 'বিদ্যানন্দ' একটা অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বিদ্যানন্দের সঙ্গে জড়িত স্বেচ্ছাসেবীদের সংখ্যাগরিষ্ঠরাই মুসলমান। বিদ্যানন্দের ফান্ডে দানকারী সংখ্যাগরিষ্ঠরাই মুসলিম(সংখ্যাগরিষ্ঠ ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলেও তো আপত্তির কিছু নেই। উদ্দেশ্য মহৎ ও মানবিক কিনা সেটাই বিবেচ্য হওয়া উচিত)। খুব ছোটবেলা থেকেই কেন জানি একটা স্বতঃস্ফূর্ত শিক্ষা পেয়েছিলাম কারো নাম দেখে ধর্ম পরিচয় সম্পর্কে কৌতূহলী না হওয়ার। এজন্য নিজ ধর্ম পরিচয় সমুন্নত রেখেও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বন্ধুদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতায় ধর্ম পরিচয়, কারোর নাম কখনোই মুখ্য হয়ে ওঠেনি। গৌণই থেকেছে।

যা হোক, সেই ব্রিটিশ ভারতে বিশেষত সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে, প্রবল পাকিস্তান আন্দোলনে, দেশভাগের পর চব্বিশ বছরের শোষণের কাল থেকেই আমরা একটা ধর্মান্ধ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তুলেছি। একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম ছিল এই অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসার রাষ্ট্র ঘোষিত সচেতন প্রচেষ্টা। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর সময়ে ক্ষমতালোভী চরিত্রহীন বুট ও বন্দুকওয়ালা রাষ্ট্রপ্রধানরা আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে শতাব্দ কালব্যাপী গভীর অন্ধকারে। গণতান্ত্রিক শাসনামলেও এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না আমাদের শাসকেরা। আঁতাত করছেন, জোট করছেন মৌলবাদী শক্তির সঙ্গে। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য দিচ্ছেন। যারা সমাজ ও সভ্যতার প্রগতিতে বিশ্বাস করে না। স্বাধীনতার এতো বছর পরও নিজ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আলোকে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মননের সুন্দর একটি ক্ষেত্রও আমরা তৈরি করতে পারলাম না। তাই আর্ত মানবতার কাজে নিয়োজিত স্বচ্ছ একটি সংগঠন নিয়েও নষ্টদের সংঘবদ্ধ ঘৃণা বিদ্বেষ, অপপ্রচার চালানো দেখে অবাক হই না।

পৃথিবী যখন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত তখনও আমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করছি। এ থেকে সহজে নিস্তার নেই। ধীরে ধীরে এভাবেই সেক্যুলার রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিবর্তে একটা সাম্প্রদায়িক অমানুষের সমাজ আমরা গড়ে তুলেছি। যেখানে মানুষের কর্ম নয়, ধর্ম পরিচয় বড়ো হয়ে ওঠে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া উচ্চশিক্ষিত একটি তরুণও মৌলবাদের মোহন মিছিলে যোগ দেয় অবলীলায়। অথচ এদেশে বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদের মতো, পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার, জোড়বাংলার মন্দির বেদি, আউল-বাউল আর মাটির দেউলও সত্য। সত্য, সুন্দর ও মানবিক ঘোষণা দিয়েছেন মধ্যযুগে বাংলার কবি, "সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।"

বিজ্ঞাপন

বিদ্যানন্দ সংগঠনটি করোনা দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি বিপদগ্রস্ত মানুষকে ত্রাণ সহযোগিতা দিয়েছে। তবু ঘৃণার চাষবাসে বেড়ে ওঠা ধর্মান্ধরা সংগঠন ও ব্যক্তি কিশোরের বিপক্ষে অপপ্রচার চালাচ্ছেই। এদেশে কিশোর কুমারের মতো উদ্যমী স্বাপ্নিক তরুণেরা অন্ধকারে আলো ও আশা জাগাচ্ছেন। মনে রাখা দরকার, দেশটা রহিম, করিমের যেমন তেমনি কিশোর দাশেরও। অসাম্প্রদায়িক মানবিক একটি রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য সকলের পূর্বপুরুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একদিন যুদ্ধ করেছিলেন। তারপরও নিজ ভাষা ও পরিচয় সম্পর্কে শত শত বছর ধরে কুণ্ঠিত ঘৃণাজীবীদের উদ্দেশ্যে সতেরো শতকের কবি আবদুল হাকিম তো বলেই গেছেন — "যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।... দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়/ নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়।"

আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ