আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ক্যানিবালদের শিল্প-সাহিত্যের ম্যানেজারি

মাসকাওয়াথ আহসান  

I have no problem with god - it's his fan club that scares me. ― A.B. Potts

এই উদ্ধৃতিটি আমাদের যাপিত জীবনে প্রায়ই মনে পড়ে। সবুজ গাছপালা ছায়া ঢাকা মসজিদে গিয়ে প্রার্থনা করার মাঝে আনন্দ আছে। আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার; কিংবা এই আমার সঙ্গে আমার গভীরে ঘুমিয়ে থাকা সত্য-সুন্দর কল্যাণের যোগাযোগ তৈরির আদর্শ জায়গা হলো মসজিদ। আল্লাহর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়ার এই প্রার্থনার মাঝে; তৃতীয় পক্ষের অনধিকার চর্চাটি আমার ভালো লাগে না। কেউ উপযাচক হয়ে আল্লাহর ম্যানেজার হিসেবে উপস্থিত হয়ে কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক; আমার কী করা উচিত; কী করলে আমি বেহেশতে যেতে পারবো; এসব জ্ঞান কেউ দিতে এলে তাকে আমার ভয় লাগে।

বিজ্ঞাপন

ধর্মের এই ম্যানেজার ভীতির মতোই রাজনীতির ও দেশপ্রেমের ম্যানেজারদের দেশপ্রেম পরীক্ষা; কী করলে "আসল" দেশপ্রেমিক হওয়া যাবে; এইসব অনধিকার চর্চাকে ভীষণ অপছন্দ করি।

প্রেমিকার সঙ্গে প্রেম করার জন্য; প্রেমিকার মায়ের কাছে "বাণী চিরন্তনী" শোনা যেমন বিরক্তিকর। আসল কথা হচ্ছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে যে কোন হস্তক্ষেপই ভীতিপ্রদ।

আবার আমি কোন কবির কবিতা পড়ার কালে সাহিত্যের ম্যানেজার যখন বলেন, উনি অমুক পার্টির সমর্থক; আপনি তার কবিতা পড়বেন না; পড়লে ঐ পার্টির লোক হিসেবে পরিগণিত হবেন।

আমার কাছে নির্মলেন্দু গুণের কবিতার টেক্সট জরুরি; বিবেচ্য আল-মাহমুদের কবিতা; উনারা কী লিখেছেন; তা আমার চর্চার জায়গা। উনারা কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক; তা আমি দেখতে যাবো কোন দুঃখে! শেক্সপীয়ার বা টি এস এলিয়ট কোন রাজনৈতিক দল সমর্থন করতেন; তাতে আমার কী! আমি পড়ি শিখি তাদের রেখে যাওয়া সৃষ্টিকর্ম থেকে।

বাংলাদেশে শিল্প-সাহিত্যের জগতে যারা কাজ করেন; তারা সমাজের কাছে শিশুকাল থেকেই শোনেন, এসব ছাইপাঁশ লিখে কী হবে! বই লিখে পেটের ভাত জোটাতে পেরেছে কে কবে?

সমাজের এ তিক্ত মনোভাবের কারণ রয়েছে; তারা অনেক শিল্পীকে না খেয়ে বা বিনা চিকিৎসায় মরতে দেখেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো প্রবাদপ্রতিম লেখক হুঁশিয়ার করে গেছেন, আগে পেটের ভাতের বন্দোবস্ত করে তারপর সাহিত্য করতে এসো।

উপমহাদেশের এই বোধহীন সমাজে বিদ্রোহী কবি নজরুল কিংবা বিদ্রোহী গল্পকার সাদাত হাসান মান্টোর ট্র্যাজেডি দেখার পরেও তরুণেরা কবিতা লেখে আজো; আজো তারা শিল্প-সাহিত্য নিয়ে স্বপ্ন দেখে।

এর কারণ হচ্ছে; যাপিত জীবনের সবচেয়ে আনন্দের জায়গা এই কবিতা ও গান আর গল্প। বাকিটা একটা রুটিন ব্যাপার।

বাংলাদেশ গানের দেশ-কবিতার দেশ বলে, কৃষক-মাঝি থেকে শহুরে ব্যাংকার-রসায়নবিদ কবিতা লিখতে পারেন; গান গাইতে পারেন।

বাংলাদেশের ষাটের ও সত্তরের দশক দুটি ফ্রান্সের রেনেসাঁ-র সময়ের মতো শিল্প-সাহিত্যে নবজাগরণের সময়। এই সময়ে কবিতা-গল্প-গান-চলচ্চিত্র-চিত্রকলা; শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায় ফুল ফুটেছে। সংস্কৃতির এই বসন্তে বিউটি বোর্ডিং-এ একদল সৃজনশীল মানুষ বাংলাদেশ মনীষার স্বরূপ সন্ধান করেছেন।

শিল্প-সাহিত্যের জগত এক ঘোর লাগা আনন্দের জগত। সে কারণে প্যারিসে কিংবা ঢাকায় নব্বুই দশক পর্যন্ত বোহেমিয়ান তরুণদের জীবনের "ঘুড্ডি" ওড়াতে দেখা যায়। ১৯৬০-১৯৯০ এই হচ্ছে বাংলাদেশের সোনালী যুগ। এসময়ে বাংলাদেশের কবিতা পৌঁছে গেছে এর হিরণ্ময় গন্তব্যে।

বিজ্ঞাপন

এরপর বোহেমিয়ান তরুণরা নিষিদ্ধ হয় এ শহরে। শার্ট ইন করে কোমরে বেল্ট বেঁধে স্যু শাইনার দিকে ঝকঝকে করে তোলা জুতা পরে মচ মচ করে হেঁটে যাওয়া কালচার শুরু হয়। শিল্প-সাহিত্য ভয় পেয়ে এ শহর ছেড়ে পালায়।

যেহেতু ষাটের-সত্তরের দশকের কবিতার মিনারটি অতিক্রম করার শক্তি নাই; তাই শুরু হয় কবিতার মিনার ভাঙা। আইকন ভাঙার খেলা। ষাটের-সত্তরের দশকের কোন শিল্প-সাহিত্যের গুণী মানুষের মৃত্যু হলেই; লিলিপুটিয়ান আর ব্লেফুসকুডিয়ানরা কেউ মৃত ব্যক্তিকে দেবতা বানিয়ে পূজা করে; কেউ তাকে দানব বানাতে উঠে পড়ে লেগে যায়।

লিলিপুটিয়ান আর ব্লেফুসকুডিয়ানরা ধর্মীয় ও দলীয় অনুভূতির লোক। লোকটা কী লিখেছেন; কী গেয়েছেন; সে নিয়ে কথা নেই; লোকটা কোন দলকে সমর্থন করেছিলেন সেটাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়।

সোনালি যুগের মানুষের চলে যাওয়ায় তাকে যে নিভৃতে একটু স্মরণ করবেন; সে সুযোগ নেই। ক্যানিবালদের নর-মাংস ভক্ষণের কৃত্যটি আজকাল আরও বেশি দেখা যায়; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে।

ক্যানিবাল নিজে সৃষ্টিশীল মানুষ নয়; সৃষ্টির চেষ্টা করে ব্যর্থ অনেকেই। তাই তারা এখন শিল্প-সাহিত্যের ম্যানেজার। সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে আমার কোন সমস্যা নেই। সমস্যা স্বঘোষিত ম্যানেজারদের নিয়ে; তাদের নৃশংসতা আর কর্কশতাকে ভয় পাই।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ