আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ধর্মীয় মৌলবাদ স্থান করেই নিলো

রণেশ মৈত্র  

সেই বাংলা ভাই এর ঘটনার আগে কদাপি “ধর্মীয় মৌলবাদ” শব্দ দুটির সাথে পরিচয়ই ঘটেনি। জানতাম না শব্দ দুটিকে-জানতাম না তার অর্থ ও কার্যকলাপ সম্পর্কেও। কিন্তু বাহবা দিতেই হয় বাংলা ভাইকে কারণ তিনি রাজশাহী জেলায় অবস্থিত তাঁর এলাকায় ভীতিকর এক সন্ত্রাসী রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পেরেছিলেন এলাকার বহু নিরপরাধ ধর্মবিশ্বাসী মুসলিম তরুণকে জঙ্গিবাদী ক্যাডার হিসেবে তৈরি করতে। আরও বিস্ময়কর কিন্তু সত্য যে, রাজশাহী জেলার সর্বোচ্চ পুলিশ কর্মকর্তা-অর্থাৎ পুলিশ সুপারকে করে তুলতে পেরেছিলেন বাংলা ভাইয়ের এবং তাঁর অজস্র খুনি ও সন্ত্রাসী বাহিনীর কর্মকাণ্ডে একজন বিশ্বস্ত সহযোগী হিসেবে।

সরকারি প্রশ্রয় না থাকলে কোথাও সন্ত্রাস মাথা চাঁড়া দিতে পারে না। তাই শুধু পুলিশ সুপার নন-তৎকালীন সরকারও, বিএনপি জামায়াত জোট সরকার, ঐ ধর্মের নামে পরিচালিত সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের সহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এমন নরহত্যার ভয়াবহ কাহিনী বহুদিন রীতিমত গোপন থেকেছে, দেশবাসীর নজরে আসে নি। কিন্তু নজরে এলো যখন রাজশাহীর সাংবাদিকেরা দেখলেন, বাংলা ভাই এর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা ভীতিকর শ্লোগান দিতে দিতে রাজশাহী শহরে অস্ত্র হাতে এসে মিছিল করছে, ভীতিকর শ্লোগান দিয়ে শহরবাসীকে আতংকিত করে তুলছে এবং সব শেষে বাংলা ভাই স্বয়ং তার জনাকয়েক সাগরদেরকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ সুপারের অফিসে বসে রীতিমত মধ্যাহ্নভোজনে আপ্যায়িত হলেন। খবরটি ঢাকার পত্রিকাগুলিতে বিশাল কভারেজ দিয়ে দেশবাসীর নজরে আনে। দেশব্যাপী বিপুল প্রতিক্রিয়া হয়। আরও বিস্ময়কর ঘটনা মনে পড়ে গেল-ঐ খবর অসত্য বলে সরকার বারবার দাবী করতে থাকলো। এক পর্যায়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলে ওঠেন এমন কোন বাহিনীর আদৌ কোন অস্তিত্ব নেই রাজশাহী জেলায় এমন কোন মিছিলও রাজশাহী শহর প্রদক্ষিণ করেনি। কিন্তু খবরের ফলো আপ প্রকাশিত হতে থাকলো। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাংবাদিকেরা ঘটনাস্থলে গিয়ে সরেজমিন সচিত্র খবর পাঠাতে থাকেন। এতে বিব্রত বোধ করে তৎকালীন সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী জামায়াতে ইসলামের আমীর মওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলে উঠলেন, “বাংলাভাই নামে কোন সন্ত্রাসীর অস্তিত্ব নেই-বাংলাভাই মিডিয়ার সৃষ্টি”। অগ্নিতে ঘৃতাহুতি হলো। ফুঁসে উঠলেন সাংবাদিক ও তাবৎ সুধী সমাজ। উদার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলিও পিছিয়ে থাকেন নি। সকলের কণ্ঠ থেকেই প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে থাকলো।

শেষ পর্যন্ত ঐ বি.এন.পি জামায়াত জোট সরকারের আমলেই বাংলাভাই এর বিরুদ্ধে মামলা, চার্জশীট দাখিল, বিচার ও দলে বলে ফাঁসিও হলো। তখন ভাবা গিয়েছিল মৌলবাদী-জঙ্গিবাদের থাবা হয়তো চিরতরে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো এবং আর কদাপি তারা বাংলার মাটিতে মাথা তুলতে পারবে না। কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা। সমাজের গভীরে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মননে যে অতি সংগোপনে মৌলবাদ ঠাঁই করে নিয়েছে সম্ভবত: আজও তা আমরা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছি না বা করতে পারলেও তাকে গুরুত্ব দিতে রাজী হচ্ছি না।

এর প্রকৃষ্টতম উদাহরণ, ফেসবুকের কোন একাউন্ট থেকে হযরত মোহাম্মদের বা ইসলামের অবমাননাকর একটি পোষ্ট দিয়েছে অমুক হিন্দু ছেলে-মাইকে কেউ উদ্দেশ্য মূলকভাবেও যদি এমন প্রচার করেন মসজিদ থেকে, আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে ইসলাম রক্ষার নামে হাজার হাজার মুসুল্লি দিব্যি তৎক্ষণাৎ জড়ো হয়ে ঐ মালাউনটির বাড়ী আক্রমণ থেকে শুরু করে ভাংচুর, লুটপাট, নারী ধর্ষণ-অপহরণ, তাদের ক্ষেতে ফসল ও দোকান পাট লুটপাট প্রকাশ্য দিবালোকেই দিব্যি চলতে থাকে। এবং তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত “ধর্মনিরপেক্ষ” বাংলার মাটিতে। এভাবে আক্রমণের আগে কেউ একজনও যাচাই করে দেখেন না যে ঐ হিন্দু বা অমুসলিম ছেলেটি প্রকৃতই তেমন কোন পোষ্ট দিয়েছিল কি না।

প্রশ্ন আইনের শাসনেরও। কারণ অপরাধ যদি কেউ করেও থাকে এবং যদি তা যথাযথভাবে প্রমাণিতও হয়, তবু আইনকে হাতে তুলে নিয়ে অপরাধীকে মারধর, বাড়িঘর, দোকান-পাট ভাংচুর, ধর্ষণ-অপহরণ করার অধিকার কাউকেই দেওয়া হয় নি। অপরাধ করে থাকলে তা পুলিশকে জানাতে হবে, পুলিশ মামলা রেকর্ড করবে, তদন্ত করে মোটামুটি অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে অপরাধীদের বিরুদ্ধে চার্জশিট আদালতে দাখিল করবেন। অত:পর আদালত উভয় পক্ষের সাক্ষ্য প্রমাণ রেকর্ড করবেন-উভয়পক্ষের বক্তব্য শুনে যদি অপরাধীর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সন্দেহাতীত ভাবে সত্য বলে প্রমাণিত হয়, বিচারক তার বা তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি প্রদান করবেন। এই বাধ্যতামূলক আইনি বিধানটি উপেক্ষিত এবং শুধু তাই নয়, “ইসলামের” তথাকথিত হেফাজতকারীরা ধর্মের “মর্যাদা” রক্ষার নামে গোটা হিন্দু পাড়াই আক্রমণ করে অনুরূপ অত্যাচার করে থাকে বহালতবিয়তে।

পুলিশ? বিস্ময়কর হলেও সত্য, ঐ এলাকায় পুলিশ থাকলেও বা থানাকে কেউ অবহিত করলেও সবাই অর্থপূর্ণ নীরবতা পালনের পথটাকেই বেছে নেন। তার জন্য কদাপি কোন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে কোন মামলা দায়ের করতে দেখা যায় নি শাস্তি হওয়াতো দূরের কথা। ক্বচিৎ কদাচিৎ সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁকে বড় জোর বদলি করে সাময়িকভাবে ও এস ডি করা হয়েছে বা “ক্লোজড” করা হয়েছে। সব কিছু ঠা-া হয়ে এলে যথারীতি প্রমোশন দিয়ে তাদেরকে “পুরস্কৃত” করার নজিরও আছে।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবেশীরা? প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা এটা অপছন্দ করেন, তাঁরাও দরজা-জানালা বন্ধ করে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে থাকেন দু’একটি ক্ষুদ্র ব্যতিক্রম বাদে। আর শিক্ষিত সমাজ? তাঁরা পালন করেন নীরবতা। কি জানি কি বিপদ আসে এই কথা ভেবে। বুদ্ধিজীবী সমাজ? তাঁরা বড় জোর ঘটনার বিরোধিতা ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করে একটি বিবৃতি প্রদান বা ঐ দাবিতে একটি সংবাদ সম্মেলন করেই তাঁদের কর্তব্য সমাপ্ত করেন। এভাবেই চলছে দেশটা-অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ বলে দাবি করে।

মৌলবাদী-জঙ্গিরা একের পর এক জ্ঞানী-গুণী, উচ্চ শিক্ষিত বিজ্ঞান মনস্ক ব্যক্তিকে কখনও প্রকাশ্য দিবালোকে আবার কখনও বা সন্ধ্যা বা রাতের অন্ধকারে হত্যা করলেও শাস্তি তেমন একটা কারও হয়নি। কারণ সন্ত্রাসী খুনিরা দাবি করে ওঁরা নাস্তিক আর ঐ খুনিরা নিজেরা ধার্মিক। সমাজে প্রতিবাদ নেই বললেই চলে।

২০০১ সালের কেচ্ছা
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে সংখ্যালঘু নির্যাতনের হাজার হাজার ঘটনা ঘটে। আজকের সরকারিদল সহ নানা অসাম্প্রদায়িক মহল তার প্রতিবাদে মুখর হন। অনেক নমস্য ব্যক্তি ঘটনাস্থলগুলি ঘুরে এসে সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠান করে ঘটনাসমূহের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি দাবী করেন। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এ সাম্প্রদায়িক সংঘাতের বিরুদ্ধে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনেরও আয়োজন করা হয়।

এত কিছুর পরও বিএনপি সরকার সাম্প্রদায়িক সংঘাতে দায়ী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি। ইতোমধ্যে কয়েকটি বছর চলে যায়। হাইকোর্টে তাদের অপরাধ নির্ণয় ও অপরাধীদের শাস্তিদানে সরকারকে নির্দেশ দানের আবেদন জানিয়ে রিট দায়ের করলে হাইকোর্ট সরকারকে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে ঘটনাবলীর তদন্ত এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন।

ক্ষমতায় এলো আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে। হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক অবসর প্রাপ্ত জেলা জজ শাহাবুদ্দিন চুপ্পুর নেতৃত্বে সরকার এক সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন করেন। কমিশন একটি বছর ধরে সারা দেশ ঘুরে বিশাল তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর দাখিল করেন। রিপোর্টে তিনি উল্লেখ করেন উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ সহ ৩/৪ হাজার মোকদ্দমা দায়ের করা সম্ভব এবং তা অবিলম্বে করা হোক।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, রিপোর্টটি পেয়েছি। অত্যন্ত বড়। পড়তে সময় লাগবে। তবে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের অবশ্যই করা হবে। তিনি করলেন না। অত:পর আর একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলেন, তিনিও মামলা অবশ্যই দায়ের করা হবে বললেন কিন্তু তাঁর মেয়াদেও কোন মোকদ্দমা দায়ের করা হলো না। অত:পর আরও দু’তিন জন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলেন কিন্তু ঐ প্রশ্নে আর কোন কথাই নেই। তদন্ত রিপোর্টটি হারিয়ে গেছে কিনা কে জানে? অথবা সকল অপরাধীরা দল বেঁধে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ইমিউনিটির আওতায় চলে এসে চেয়ারম্যান, মেম্বর, মেয়র বা এম.পি প্রভৃতি হয়েছেন কিনা নৌকা মার্কা থেকে কে জানে? শুধু জানা যায় কোন মামলা হয় নি-হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনাও নেই।

অত:পর প্রতি বছর প্রতি সপ্তাহেই দেশের নানা জেলা-উপজেলায়, শহরে বন্দরে মন্দির প্রতিমা ভাংচুর, বাড়িঘর-দোকানপাট লুটপাট, ধর্ষণ-অপহরণের ঘটনা বেমালুম ঘটে চলেছে। এখন আর এগুলির কোন প্রতিবাদ নেই যেন সবই গা-সহা হয়ে গেছে। অপরাধীরাও রীতিমত লাইসেন্স পেয়ে গেছে। মাভৈ:। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা, ধর্মনিরপেক্ষতা সব কিছুই অসহায়ের মত কাঁদে।

রাজনৈতিক অঙ্গন? সেটাকে কি বলা যাবে সাম্প্রদায়িকতার কলুষমুক্ত? প্রকৃতই কথাটা ছিল তা হওয়ার। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সশস্ত্র নিরস্ত্র লড়াই এর মূল দাবীও ছিল গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সংবিধানও লিখিত হলো সেভাবেই। রাষ্ট্রীয় চারটি মৌলনীতি স্পষ্টাক্ষরে লিখিত হয়েছিল। সভ্যতার আলো জ্বলতে শুরু করেছিল। কিন্তু সে আলো নিভতে বা নিষ্প্রভ হতে সময় নেয় নি মোটেও। তাৎক্ষণিক কোন প্রতিবাদ বিশাল দল হওয়া সত্বেও আওয়ামী লীগ করে নি। নেতা-নেত্রীদের কোন খোঁজও পাওয়া যায়নি।

১৯৭৫। ১৫ আগস্ট। সপরিবারে হত্যা করা হলো জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ক্ষমতায় এলেন জিয়া মুশতাক। রাষ্ট্রীয় বেতার টেলিভিশনে ঘোষিত হলো শেখ মুজিবুর “ইসলাম-বিরোধী” কাজে লিপ্ত ছিলেন সূর্য সন্তানেরা (খুনিরা) দেশকে ধর্মদ্রোহিতার হাত থেকেই রক্ষা করেছে।

দিব্যি বিনা প্রতিরোধে মেদিনী বিজয়। পরিণতি সংবিধানের চার মৌল রাষ্ট্রনীতি উধাও। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রবর্জিত হলো। আর যুক্ত হলো “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” সংবিধানের শুরুতে। ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল ছিল নিষিদ্ধ ৭২ এর সংবিধানে। কিন্তু যথাযোগ্য মর্যাদায় জামায়াতে ইসলামী সহ সকল ধর্মাশ্রয়ী দল গঠনকে সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান করা হলো। কার্যকর দূরে থাক, আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ ও এলো না কোন মহল থেকে। বিষয়টা পাকাপাকি হয়ে গেল।

হঠাৎ একটি রিট দায়ের হলো হাইকোর্টে মুন সিনেমা হলকে নিয়ে। এ রিটের রায়ে হাইকোর্ট জিয়ার পঞ্চম ও এরশাদের অষ্টম সংশোধনী বাতিল করে সংবিধানে বিসমিল্লাহর অন্তর্ভুক্তি, ধর্মাশ্রয়ী দলগুলির বৈধতা এবং এরশাদ প্রণীত রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বে-আইনি ঘোষণা করে বলেন-ঐ দুই সামরিক শাসক জনতার ভোটে নয়,অস্ত্রের জোরে বে-আইনিভাবে ক্ষমতা দখল করায় তাদের কৃত সংশোধনী সংবিধান বহির্ভূত ও বে-আইনি। সুপ্রিম কোর্টে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে উভয় পক্ষের শুনানি অন্তে হাই কোর্টের রায় বহাল রাখা হয়।

ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ সরকার। দলটি পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনী বাতিল করে বাহাত্তরের মূল সংবিধান পুনরুজ্জীবনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও সই প্রতিশ্রুতি উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর ও মুক্তিযুদ্ধের চার রাষ্ট্রীয় মৌলনীতি পুনরুজ্জীবন না করে সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে জিয়া এরশাদের পঞ্চম ও অষ্টম সংশোধনীর উপরোক্ত বিষয়গুলি সন্নিবেশিত করায় সংবিধানের ইসলামীকরণকে স্থায়ী রূপ দেওয়া হয়।

যে লক্ষ লক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে নয় মাসব্যাপী সশস্ত্র লড়াই এর মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সংবিধান বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরে প্রণয়ন করলেন তা কলুষিত হওয়ার বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে আজও প্রতিবাদ ধ্বনিত না হওয়া বিস্ময়কর।

প্রতিবাদ নেই সমাজের অপরাপর মহল থেকেও
উগ্র সাম্প্রদায়িক ধর্মাশ্রয়ী ও স্বাধীনতা বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী সেই জিয়ার আমলে যে বৈধতা পেল (বাহাত্তরের সংবিধানকে উপেক্ষা করে) তারা তো বৈধভাবে বাংলার মাটিতে সক্রিয় রইলোই, মাঝখানে সরকার উৎখাতের ধ্বনি তুলে ঢাকা অবরোধ ও বিশাল সমাবেশ নিয়ে বহু কোটি টাকা খরচ করে উদয় হলো আর এক কট্টর ধর্মাশ্রয়ী দল হেফাজতে ইসলামী কট্টর ইসলামী মতবাদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে। সকালে শুরু হওয়া ঐ সমাবেশ থেকে সরকারের শিক্ষা নীতি ও নারী অধিকার সংক্রান্ত নীতি বাতিল অন্যথায় সরকার উৎখাতের দাবী তুললো। গভীর রাতে কঠোর পুলিশি ব্যবস্থায় ঐ সমাবেশ ভেঙ্গে দেওয়া হয় বটে কিন্তু মাত্র কয়েকমাসের ব্যবধানে ঐ হেফাজতের আমীর আহমেদ শফি ( তেঁতুল হুজুর) সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হলেন তাঁর ঘোষিত ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নীতি অক্ষুণ্ণ রেখেই। পরিণতিতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ন্যায় বিচারের প্রতীক “জাস্টিসিয়া” নামক ভাস্কর্যটি “উলঙ্গ নারী মূর্তি” বলে আখ্যায়িত করে তাৎক্ষণিকভাবে তেঁতুল হুজুর খোদ প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোনে ভাস্কর্যটি ভেঙ্গে দেওয়ার অনুরোধ করার সাথে সাথে তা কার্যকর করা হয়, পাঠ্য বই থেকে অসাম্প্রদায়িক লেখকদের প্রবন্ধ, গল্প, ভ্রমণ কাহিনী, কবিতা বাদ দিয়ে সাম্প্রদায়িক শিক্ষকদের লেখা সন্নিবেশিত করা হয় ঐ একই মহলের দাবীর প্রেক্ষিতে। এ সবই আমরা দেখছি, দেখছেন মুক্তিযোদ্ধারা-দেখছেন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী সমাজ ও দেশবাসী। কিন্তু সবাই নিশ্চুপ। যেন কিছুই ঘটে নি। এতে দেশের কোন ক্ষতি হয় নি। এমন কি এমন মন্তব্যও কখনও কখনও শুনতে হয়, “দেশটা তো মুসলমানদের। ক্ষতিটা কি হলো?”

ক্ষতিটা কি হলো তা আদর্শনিষ্ঠরাই বুঝবেন। যদি ক্ষতি না হয়ে থাকে তবে পাকিস্তান আমলে যখন দেশটাকে “ইসলামী রাষ্ট্র” (Islamice Republic of Pakistan) ঘোষণা করা হয় তখন কেন তার বিরোধিতা করে হাজারে হাজারে জেলে গিয়েছিলাম? কেন বঙ্গবন্ধু, মওলানা ভাষানীসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ সেদিন বলেছিলেন, ইসলামিক রিপাবলিক নয়-ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান চাই? গৃহীত এই আদর্শগুলি যে পাকিস্তানের আদর্শ ছিল এবং তা দূর করতেই যে বাঙালি পৃথক একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চেয়েছিল সে ইতিহাস কি ভুলে যেতে হবে?

নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে বা বানীতে রাষ্ট্র নায়কেরা বরাবরের মত দিব্যি বলে থাকেন, “বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক নজিরবিহীন দেশ।” হ্যাঁ, নজিরবিহীন নজিরই বটে। বস্তুত: বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মননে যে মৌলবাদ নীরবে নিভৃতে দিব্যি ঠাঁই করে নিয়েছে তার আর একটি প্রমাণ দিয়ে নিবন্ধটির সমাপ্তি টানছি।

ধর্ম যার যার-রাষ্ট্র সবার
রাষ্ট্র সবার। বাস্তবে কি তাই? কোটি টাকা ব্যয়ে যখন মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে তোলা হয়, তখনও কি তা বলা যায়? বলা যায় কি মসজিদ মাদ্রাসা বা মন্দির গির্জা নির্মাণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব? এবং তার পরও রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ এবং আমরা মুক্তিযুদ্ধের ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে নিবেদিত? সকল মুক্তিযোদ্ধার-সকল দেশপ্রেমিকের বিবেক জাগ্রত হোক।

রণেশ মৈত্র, লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ