আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

অনিশ্চিত পথে ছুটছে বাংলাদেশ

রণেশ মৈত্র  

মার্চে যেদিন বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত রোগী পাওয়া গেল, সেদিনই যেন জাতির জীবনে অনিশ্চয়তার এক অবিশ্বাস্য দিগন্ত খুলে গেল। কেমন এ রোগটি কেউ জানি না। পরিণতি কি তাও অজানা। সংক্রমণ প্রতিরোধের উপায় বিজ্ঞানসম্মত হলেও (বারবার হাত ধোয়া)। মেঝে ও আঙিনাগুলি প্রতিদিন কয়েকদফা জীবাণুমুক্ত করণ, ঘরবন্দি হয়ে থাকা, মানুষের সাথে দুই গজের মত দূরত্ব বজায় রাখা, জরুরী প্রয়োজনে বাইরে যেতে হলে মাস্ক পিপিই পরিধান করা, বাইরে থেকে ফিরে এসে সকল কাপড়চোপড় সাবান জলে অন্তত: আধ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে রোদে শুকানো, জুতা-স্যান্ডেল জীবাণুমুক্ত করে বাইরে রেখে দেওয়া অত:পর ভালমতো স্নান করে কাপড়-চোপড় পরিধান করে ঘরে আসা।

আর যদি বাড়ীতে কারও আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা যায় তবে তাকে একা এক ঘরে রাখা, তার কোন জিনিষ স্পর্শ না করা, বাইরে থেকে খাবার তাঁর ঘরের সামনে রেখে দেওয়া, পৃথক বাথ ও টয়লেট তার জন্য নির্দিষ্ট রাখা, ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করে স্যাম্পল নিয়ে টেস্টের ব্যবস্থা করা, পজিটিভ পেলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, নেগেটিভ পেলেও দু’সপ্তাহ লক্ষণাক্রান্তের মত পৃথক ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা। সবাই পুষ্টিকর খাবার খাওয়া এবং দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রভৃতি।

রোগটা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে যতগুলি নির্দেশনামা জারি করা হয়েছে, আমি নিশ্চিত, গ্রামে বসবাসকারী দেশের ৯৫ ভাগ মানুষই ওগুলি মানতে অক্ষম এবং তার অন্তত: অর্ধেক মানুষ ওগুলি মেনে চলতে অনিচ্ছুকও। এই যেখানে পরিস্থিতি সেখানে মানুষ কিভাবে সংক্রমণ প্রতিরোধ করবে, চিকিৎসাই বা কি হবে?

আরও বড় ব্যাপার হলো, এখনও অন্তত: ৫৪টি জেলায় করোনা টেস্ট করার কোন ব্যবস্থাই নেই। জেলার সংখ্যা তো ৬৪। তার মধ্যে রাজধানী ঢাকায় এবং চট্টগ্রামে একাধিক স্থানে টেস্ট করার ব্যবস্থা থাকলেও, রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, খুলনা, বরিশাল সিলেট ও ময়মনসিংহে মাত্র একটি করে স্থানে টেস্টিং এর ব্যবস্থা এ যাবত করা হয়েছে। প্রতিদিন মাত্র ১০,০০০/১২,০০০ হাজার করে টেস্ট করা হয় এবং এ যাবত (৩ জুন পর্যন্ত) টেস্ট করা সম্ভব হয়েছে মাত্র তিন লক্ষের কিছু বেশি মানুষের স্যাম্পল।

এহেন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিদিন মধ্যাহ্নে প্রেস ব্রিফিং করে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত রোগীর ও মৃতের যে দৈনন্দিন তথ্য সরবরাহ করে চলেছেন তা কতটা সঠিক তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যেতে পারে। টেস্টিং ব্যবস্থা নেই এমন জেলাগুলিতেও প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছে। তাঁদের কেউই কি করোনা সংক্রমিত ছিলেন না? যেহেতু তাঁর টেস্ট করা হয় নি তাই ধরে নেওয়া হয়, তিনি করোনা রোগী ছিলেন না। কিন্তু এটা তো নেহায়েতই অনুমান। তাই প্রতিটি মৃতেরও অন্তত: মরণোত্তর টেস্ট করা হোক যাতে বুঝা যায় তাঁদের মৃত্যু করোনা আক্রান্ত হয়ে ঘটেছে কি না।

মৃত রোগীর সংখ্যা জানা প্রয়োজন তবে বেশি প্রয়োজন সুচিকিৎসার, যাতে করে কোন রোগীকে মৃত্যু বরণ করতে না হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, করোনা রোগীদের চিকিৎসার কোন সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর ওষুধ আজও পৃথিবীর কোথাও আবিস্কৃত হয় নি। লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যাতে নির্ভরযোগ্য ওষুধ আবিষ্কারের পর পরই যথেষ্ট পরিমাণে বাংলাদেশে তার আমদানি হয় এবং ন্যূনতম মূল্যে তা বিক্রির ব্যবস্থা হয়।

রোগীর চিকিৎসা যখন ওষুধ অভাবে অনিশ্চিত তখন তার সংক্রমণ ঠেকানোই হওয়া প্রয়োজন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু প্রতিরোধের জন্য যা যা প্রয়োজন (তারও কোন ওষুধ আজতক আবিষ্কার না হওয়াতে) তা সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের পক্ষে ব্যয়সাধ্য এবং অনেকে সেগুলি মানছেনও না। এই পরিস্থিতিকে ভয়ানক বললেও সম্ভবত: কম বলা হয়।

কারণ প্রতিমুহূর্তে আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে দেশ-বিদেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর যে সংখ্যা প্রচার করে চলেছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ। আতঙ্কজনকও বটে। এশিয়ার দেশগুলিতে , বাংলাদেশ সহ, ঐ সংখ্যাগুলি যথেষ্ট কম ছিল গোড়ার দিকে। কিন্তু যতই দিন যেতে লাগলো-ততই সংখ্যা হুহু করে বাড়তে থাকলো। এখন বস্তুত:ই সারা এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে, করোনা রীতিমত ভয়ের নাম, ভীতির নাম, আতংকের নাম।

আমরা যেমন নানাভাবে সংকটজনক ও ভীতিজনক এই খবরগুলি পাচ্ছি, সন্দেহ নেই, সরকার তার চাইতে অনেক অনেক বেশি খবর পাচ্ছেন। কিন্তু সার্বিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকার কি এই ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আন্তরিক? তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলি কি তা প্রমাণ করে?

দেশবাসীর অভিজ্ঞতা
সরকার গৃহীত পদক্ষেপগুলি, দুঃখজনক হলেও সত্য, জনগণের অভিজ্ঞাতয়, করোনা নিয়ন্ত্রণের অনুকূলে যায় নি। ডিসেম্বরে রোগটি ধরা পড়ে চীনে। কিন্তু উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে, কড়া নিয়মানুবর্তিতা জারী করে তারা দ্রুতই রোগের ব্যাপ্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনে। বিশাল দেশ ও পৃথিবীর সর্বাধিক জনসংখ্যার এই দেশে অল্প সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হয়-মৃত্যুর সংখ্যাও যথেষ্ট কম। কিন্তু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এ ব্যাপারে করুণ। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দফায় দফায় স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার কথা বললেও তা ব্যাপক মানুষের কাছে পৌঁছায় নি। সংবাদপত্র সারা দেশে সরবরাহ ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত বন্ধ টেলিভিশনের সংখ্যা এবং ব্যবহার সীমিত। শহরগুলিতে প্রধান প্রধান সড়কে মাইকিং করে স্বাস্থ্যবিধি পালনের আহ্বান জানান হয় কিন্তু তা অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়।

অনেকে ঐ নির্দেশনাগুলি মেনে চলেন অনেকে চলেন না। যারা মানছেন না সেই মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত তাঁদেরকে মানানোর কোন সরকারি উদ্যোগ নেই। রাস্তায় কথনও কখনও পুলিশ-মিলিটারি দাঁড় করিয়ে রাখতে দেখা যায় স্বাস্থ্য বিধি মানানোর জন্য আর অহেতুক কেউ যাতে বাড়ীর বাইরে না যান তা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু অমান্যকারীদের প্রতি সম্ভবত: প্রয়োজনেও কঠোর হওয়ার নির্দেশ উপরমহল থেকে না থাকায় তাঁদেরকে লাঠি হাতে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। অবশ্য কখনও কখনও কোথাও কোথাও মোবাইল কোর্ট বসিয়ে কাউকে কাউকে কিছু জরিমানা করতে দেখা গেছে-এই মাত্র।

পরিণতিতে যারা আইন মেনে চলেন ও চলছেন তাঁরা হন আতংকিত। একেই তো গোড়ার দিকে (মার্চ) স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিদেশ থেকে আগত যাত্রীদেরকে টেস্টিং বা কোয়ারেন্টিনে না রেখে এদেশে করোনা আমদানি করা হলো-মানুষ সংক্রমিত হলো ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে (ভয়াবহভাবে) “সাধারণ ছুটি” ,লক ডাউন নয় চলাকালে। চিকিৎসার সুব্যবস্থা নেই ডাক্তার-নার্স-হাসপাতাল-বেড অপরাপর সরঞ্জাম যথা আই.সি.ইউ, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর প্রভৃতির নিদারুণ অভাব। কিন্তু ক্রমান্বয়ে রোগীর সংখ্যা বাড়তে লাগল।

মানুষের আতংকও বাড়তে থাকলো
এই আতংক, এই অব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সংক্রমণের ক্রম-বৃদ্ধি, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়-বাড়ন্ত, ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ বেশ বড় সংখ্যায় আক্রান্ত হওয়া এবং অনেকের মৃত্যুবরণ করা, বহুক্ষেত্রে রোগী হাসপাতালের পর হাসপাতাল ঘুরেও কোথাও ভর্তি হতে না পেরে পথেই মৃত্যু বরণ করা, সক্রিয় এবং সাহসী ডাক্তার কোথাও আই সি ইউ বা ভেন্টিলেটর না পেয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করা, ইত্যাকার ঘটনা দেশবাসীকে শঙ্কিত করে তুলেছে। এসকল কারণে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধিকে উপেক্ষা করে ১০ মে থেকে হঠাৎ করেই সব কিছু অর্থাৎ দোকান-পাট, কলকারখানা “সীমিত” আকারে খুলে দিয়ে নতুন আতংকেরও সৃষ্টি করা হয়।

এক ভয়াবহ নাটকও দেশবাসী প্রত্যক্ষ করলেন এপ্রিলে। গার্মেন্টস শিল্প মালিকেরা ঘোষণা দিলেন, তাঁদের রফতানি চাহিদা রক্ষা না করতে পারলে গার্মেন্টসের বিদেশি বাজার হারানোর আশংকা। এই যুক্তিতে কারখানাগুলি খোলার ঘোষণা দিলে লাখে লাখে শ্রমিক পরিবহন বন্ধ থাকা সত্বেও গ্রাম থেকে ছুটে আসেন সামান্যতম স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে। কারখানাতেও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা বা অন্যান্য বিধি মানার কোন আয়োজনও না থাকায় প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় উঠলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে তাদের আবার গ্রামে ফেরত চলে যেতে হয়। এই আসা-যাওয়ার মাধ্যমে করোনা-ভাইরাস আরও ছড়িয়ে পড়ে।

১০ মে দোকানপাট ‘সীমিত’ আকারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনা কাটার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ব্যবসায়ী তেমন আয়োজন না রাখায় আবারও সমালোচনার ঝড় ওঠে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে কিছু ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়। এই করতে করতে এসে পড়ে ঈদ। বলা হলো ঢাকার লোক ঢাকাতেই ঈদ করবেন। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হলো। কিন্তু বাধা কোথায়? ঢাকা থেকে হাজারে হাজারে মানুষ ছুটলো নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে নিজ নিজ জেলা বা গ্রামের উদ্দেশ্যে ঈদ করতে। ছুটতে দেখা গেল বাস, ট্রেন, লঞ্চ-ষ্টীমার (দক্ষিণবঙ্গগামী) বাদে ফেরী, নৌকা, রিকসা, স্কুটারে করে। হঠাৎ ঘোষণা করা হলো ব্যক্তিগত কার চলবে। ব্যস অমনি কার, মাউক্রোবাস ছুটতে থাকলো যার যার এলাকায়। এনিয়ে ব্যবসাও কম হলো না। ঈদ শেষে আবার তাঁরা ফিরলেন ঢাকার মুখে। ইতোমধ্যে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর থেকে বাড়ী আসার পর করোনা ভাইরাস কি পরিমাণ ছড়িয়েছে তা সঠিকভাবে জানতে হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে মনে হয় প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে ইতোমধ্যেই।

একদিনে মৃত ৪০ সংক্রমিত ২,৫০০
আজ মে ২ জুন তারিখে সরকারি তথ্যমতে বিগত ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৩,০০০ এর কিছু বেশি সংক্রমিত এবং ৩৭ জনের মৃত্যুর খবর দেওয়া হয়েছে। এর দু’দিন আগে মৃতের সংখ্যা গতকাল ৪০ এ পৌঁছেছিল। ক্ষনৈ: ক্ষনৈ: মৃতের ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মানুষ গৃহবন্দী থাকবে, ২৪ ঘণ্টা টিভিতে এই খবরগুলি দেখবে। শঙ্কিত, আতংকিত হবেন না কেন।

সর্বশেষ পদক্ষেপ
৩১ মে “সীমিতভাবে” সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস, বাজার-বিপণী দেশব্যাপী খুলে দেওয়া হয়েছে শুরু করা হয়েছে রেল, ষ্টীমার চলাচল। ১ জুন থেকে বাস। সকলেই অর্ধেক যাত্রী বহন করবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবে বলে কথা ছিল। বাস বেসরকারি। তারা ভাড়া বৃদ্ধি দাবী করলে ৬০% বাস ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয় যাত্রীদের তীব্র বিরোধিতা সত্বেও। টেলিভিশনে লাইভে দেখা গেল বিভিন্ন ফেরিঘাটের ছবি । স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই-শারীরিক দূরত্ব কোন ছার।
এগুলি কেন করা হলো ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ ও মৃত্যু সত্বেও। জীবিকার স্বার্থে? বলা হচ্ছে জীবিকা ছাড়া জীবন বাঁচবে কি করে? আপাত সত্য বটে। কিন্তু যদি পালটা প্রশ্ন করা যায়, জীবন না থাকলে জীবিকা কার স্বার্থে? উত্তর নেই-কিন্তু প্রশ্নটা ১৭ কোটি মানুষের মাথায় ঘুরছে।

কেরালা মডেল: আমাদের শিক্ষণীয়
আমরা খুঁজেই পাচ্ছি না-কিভাবে এই সংকট মোকাবিলা করবো। অথচ সামনে আছে বেশ কয়েকটি মডেল। যেমন কিউবা। তারা নিজ দেশে করোনায় কাউকে মরতে দেয় নি-সময়োপযোগী এবং সুশৃঙ্খল ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে। ভিয়েতনামেও ঠিক তাই। একই ঘটনা নেপালেও সেখানে অনুল্লেখযোগ্য সংক্রমণ ও মৃত্যু। এখন বলি ঘরের কাছের কেরালার কথা। ৩১ মার্চের প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিবন্ধটি। তাতে বলা হয়েছে; কেরালা সরকার এপ্রিলের শুরুতেই পথে ঘাটে কিওস্ক বসিয়ে সাধারণ মানুষের করোনা পরীক্ষা শুরু করে। ১৪ মে ডেইলি স্টার ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শশী থারুরের “কেরালা মডেল” শিরোনামে প্রকাশিত কলামে সেখানে কীভাবে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ভারতের মধ্যে সবচেয়ে সফল রাজ্য হিসেবে সারা বিশ্বের মনোযোগের কেন্দ্রে এসেছে। ভারতের প্রথম করোনা সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছিল কেরালা রাজ্যেই। চীনের উহান ফেরত একজন মেডিক্যাল ছাত্র সবার আগে ভারতে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন ১৮ জানুয়ারি যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২৪ মার্চ ভারতে লক ডাউন ঘোষণা করেন, তখন ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত রোগী ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ভারতের মধ্যে সবার আগে করোনা সংক্রমিত রোগী সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসায় সফল হয়েছে এই কেরালা। চার মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও কেরালায় করোনা আক্রান্তের সংখ্যা খুবই কম এবং মৃত্যুহার মাত্র ০.৫৩ শতাংশ যা সারা বিশ্বে সাড়া ফেলেছে।

কেরালার এই অবিশ্বাস্য সাফল্যের মূলমন্ত্র কি? রাজ্যজুড়ে অতি দ্রুত করোনা টেস্টিং, ট্রেসিং অব কন্টাক্টস এবং ট্রিটমেন্টকে (ট্রিপল টি) সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আক্রান্ত পরিবারকে ২৮ দিনের কোয়ারেন্টিনে নিয়ে আসার বাধ্যবাধকতা কঠোরভাবে পালন করে চলেছে কেরালা-যেখানে ভারতের অন্য রাজ্যগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন চালু করেছে।

ঐ ১৮ জানুয়ারি কেরালায় করোনা এলার্ট জারী করে রাজ্যের চারটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসা সব যাত্রীকে বাধ্যতামূলক চেক-আপের আওতায় নিয়ে এসেছে এবং সন্দেহজনক কেসগুলো হাসপাতালে অথবা কোয়ারেন্টিনে নিয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখে কেরালা রাজ্যকে ‘কোভিড-১৯ ডিজাস্টার এলাকা’ ঘোষণা করা হয়।

সারা ভারতে যখন ২৪ মার্চ লকডাউন ঘোষণা করা হয় তার আগেই কেরালায় ৩০,০০০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর অংশগ্রহণে হাজার হাজার মানুষ কোয়ারেন্টিনের আওতায় চলে এসেছিল। এই টোটাল মবিলাইজেশন কেরালায় সম্ভব হয়েছিল বহু বছর ধরে যথোপযুক্ত অর্থায়ন সহকারে প্রধান অগ্রাধিকার দিয়ে গড়ে তোলা কেরালায় পাবলিক হেলথ ব্যবস্থা কারণে।

শতভাগ জনগণের অভিগম্য আধুনিক জনস্বাস্থ্য কাঠামো গড়ে তুলেছে কেরালা। কেরালার লক ডাউন বা কোয়ারেন্টিনের বাধ্যবাধকতা অনেক বেশি মানবিক এবং সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে।

কুদুমবাশ্রি নামের এক এলাকার তৃণমূল সংগঠন ও নারী সমিতির সদস্যরা মহামারি সংক্রমণের প্রথম পর্যায়েই ২০ লাখ মাস্ক এবং ৫,০০০ লিটার হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করে সরকারি স্বাস্থ্য দপ্তরকে সরবরাহ করেন। উপরন্তু তাঁরা ১২০০ কমিউনিস্ট কিচেন তৈরি করে প্রতিদিন তিন লাখ মানুষকে রান্না করা খাদ্য সরবরাহ করছেন। কেরালা রাজ্যের সবচেয়ে বেশি অভিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চল। অতএব কোন অভিবাসী পরিবার বিপদে পড়লে তাদের সহায়তা প্রদানেও জন প্রতিনিধি এবং প্রশাসন খুবই সক্রিয়।

ভারতের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্য হলো কেরালা। তাই মহামারি ও কমিউনিটি সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি হলেও কেরালা কমিউনিটি সংক্রমণ এবং এ সংক্রান্ত মৃত্যুকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখায় সফল হয়েছে। কেরালার জনগণের ৯৪ শতাংশ শিক্ষিত এবং শতভাগ মৌল স্বাস্থ্য সুবিধা ও উন্নত চিকিৎসা সুবিধার আওতায় চলে এসেছে। ধনীদের জন্য ব্যয়বহুল হাসপাতাল গড়ে তোলার চেয়ে সকলের জন্য উন্নত ও আধুনিক চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করেছে।

কেরালায় সব প্রবীণ কৃষক পেনশন পান। ন্যায় বিচার সমুন্নতকারী প্রবৃদ্ধি মডেলের এক অনন্য নজির কেরালা। আয় ও সম্পদ বৈষম্যকে নিয়ন্ত্রণে রেখে জনগণের মাথাপিছু জিডিপির প্রবৃদ্ধি দ্রুত বাড়িয়ে চলেছে রাজ্যটি। কেরালায় পরমত সহিষ্ণুতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট বাংলাদেশে?

স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র শুরুর দিকে উল্লেখ করেছি।
১৪ মে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছে, মহামারির মোকাবিলায় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ‘মুখ থুবড়ে’ পড়েছে। তাই কেরালা মডেল এখনও আমাদের রুগ্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর অনুকরণীয় মডেল হতে পারে। তেমনি কিউবা, ভিয়েতনাম, নেপাল প্রভৃতি সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র থেকেও শিক্ষা নিতে পারি যদি সত্যই বাংলাদেশটাকে আধুনিক গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত দেশে পরিণত করতে চাই। কিন্তু যে পথে বাংলাদেশ হাঁটছে তা আত্মঘাতী ও অনিশ্চয়তার পথ।

রণেশ মৈত্র, লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ