আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ঢাকার হানিফ, চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন, সিলেটের ছিলেন কামরান

আলমগীর শাহরিয়ার  

তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আমরা শ খানেক শিক্ষার্থী আনন্দ উল্লাসে গল্প গুজবে মেতে আছি। নৈসর্গিক সৌন্দর্যেভরা ক্যাম্পাসে ছোট্ট একটি টিলার উপরে আইন বিভাগ। পাশেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিসর খেলার মাঠ। দেশের নানা অঞ্চল থেকে আগত ভর্তিচ্ছু বন্ধুদের সঙ্গে নানা প্রসঙ্গে কথা হচ্ছে। বাঙালির আড্ডার অবধারিত বিষয় রাজনীতি প্রসঙ্গও উঠল। চট্টগ্রামের ফয়সাল নামে একজন সদ্য পরিচিত মেধাবী তরুণ দেখলাম দেশের বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করা রাজনীতিবিদদের নাম গড়গড় করে বলছে। কুড়িগ্রাম থেকে চট্টগ্রাম, রংপুর থেকে সুদূর সিলেট, সুনামগঞ্জ থেকে সুন্দরবন অঞ্চলের— কেউ বাদ পড়ছেন না। যাদের সারাদেশের মানুষ এক নামে চেনে এবং সিলেটের প্রসঙ্গ উঠতেই বদর উদ্দিন আহমদ কামরানের নামসহ আরও বিস্তারিত কিছু বলল। আমি কিছুটা কৌতূহল নিয়ে বললাম সারাদেশের রাজনীতিবিদদের এতো ঠিকুজি জানো কিভাবে হে। ও নিয়মিত খুঁটিয়ে পত্রিকা পড়ত। দেশের শিক্ষিত ও রাজনীতি সচেতন মানুষ মাত্রই এভাবে সিলেটের মেয়র কামরানকে এক নামে চিনতেন।

সিলেট শহরের ছড়ারপাড়ে ১ জানুয়ারি ১৯৫৩ সালে কামরানের জন্ম। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক যথাক্রমে দুর্গাকুমার পাঠশালা, সরকারী অগ্রগামী উচ্চ বালক বিদ্যালয় ও মুরারি চাঁদ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে সিলেট মদন মোহন কলেজে ভর্তি হলেও রাজনীতি ও আরও নানা কারণে পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। খুব অল্প বয়সে রাজনীতিতে তাঁর হাতেখড়ি। ঊনসত্তরে ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন গণমানুষের নেতা। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে ৭৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় সিলেট পৌরসভার সর্বকনিষ্ঠ কমিশনার নির্বাচিত হন। রাজনীতিতে তাঁর আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু। ১৫ বছর ছিলেন পৌরসভার কমিশনার। ১৯৯৫ সালে পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে সিলেট সিটি করপোরেশন হলে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পান এবং পরের বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে বিরোধী দলে থেকেও সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েন।
বিএনপি জোট সরকারের আমলে সিলেটের হোটেল গুলশানে গ্রেনেড হামলার শিকার হন। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। ওয়ান ইলেভেনের সময় দুই বার কারাবরণ করেন। ২০০৮ সালে কারাগারে বন্দি অবস্থায় নির্বাচনে লড়ে বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু নিজ দল যখন ক্ষমতায় তখন পরপর দুই বার নির্বাচনে হেরে যান। কামরান নানা সময় সিলেট শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ তিন দশক সিলেটের রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সিলেট নগর আওয়ামী লীগের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেলেও সর্বশেষ দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্মেলনে নির্বাহী সদস্য করা হয় তাকে।

দীর্ঘ এ পথচলায় কামরান চেষ্টা করতেন রাজনীতির কলুষ এড়িয়ে চলার। হজরত শাহজালাল ও শাহ পরানের স্মৃতিধন্য, শ্রী চৈতন্য দেবের পিতৃভূমি সিলেটের মাটি ও মানুষের ভাব ও ভাষা বুঝতেন, হৃদয়ে ধারণ করতেন মানুষে মানুষে সম্প্রীতির মর্মবাণীও। সিলেট শহরের রাজনীতি নানা বলয় ও উপবলয়ে বিভক্ত থাকলেও— গুণ্ডা, মাস্তান আর ত্রাসের রাজনীতি থেকে নিজেকে সযতনে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করতেন। ছিলেন আপাদমস্তক একজন সজ্জন রাজনীতিবিদ। দল মত নির্বিশেষে মানুষ তাকে পছন্দ করত। নির্বাচনে ভোট দিত। নেতাদের কাছে মানুষ ছুটে যায়। কামরান মানুষের কাছে ছুটে যেতেন। সিলেটে যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে আমন্ত্রণ করলেই তিনি অবশ্যই হাজির হতেন। বলা হয়, একজন রিকশাচালক আমন্ত্রণ করলেও নাকি কামরান ছুটে যেতেন।

ঢাকার মেয়র হানিফ, বীর চট্টলার মহিউদ্দিন, সিলেটের ছিলেন কামরান। আজ তিনজনই নেই। এরা তিনজনই ছিলেন আওয়ামী লীগের দুঃসময়ের কাণ্ডারি। নিজ নিজ নগরীর জননন্দিত মেয়র। কামরান বিরোধী দলে বৈরী পরিস্থিতিতে মেয়র হলেন কিন্তু দল যখন ক্ষমতায় তখন কেন হেরে গেলেন? তখনই তো নগরবাসীকে তাঁর সবচেয়ে বেশি দেবার ছিল। এই প্রশ্নের উত্তর রাজনীতির নয়া মেরুকরণের ইঙ্গিত দেয়। ইঙ্গিত দেয় রাজনীতি তার আপন কক্ষচ্যুত হয়েছে। রাজনীতি রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে ক্রমাগত সরছে।

কামরান অনেকবার সিলেটের মর্যাদাপূর্ণ এক আসনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চেয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দলের এবং নেত্রীর সিদ্ধান্তে শুধু আস্থা রাখেননি— যিনি মনোনয়ন পেয়েছেন তাঁর পক্ষে সর্বোচ্চ সাংগঠনিক সক্ষমতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। দলের সঙ্গে সিলেটেরই শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা কর্মীর আদর্শচ্যুত হয়ে কাজ করার অভিযোগ থাকলেও কামরান তাঁর দলীয় আদর্শ ও আনুগত্যে অটুট থেকেছেন সবসময়। দলীয় স্বার্থ ও আনুগত্যের প্রশ্নে কামরান নেতা এবং কর্মী হিসেব এখানেই ব্যতিক্রম এবং উজ্জ্বল। ভাবীকালের নেতা কর্মীদের কাছে অনুসরণীয় হয়ে থাকবেন।

কামরান সিলেট নগরবাসীর কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। দল ক্ষমতায় থাকার পরও তিনি কেন হারলেন? নাকি তাকে হারানো হয়েছিল— এ নিয়ে ঢের আলোচনা হয়েছে, আরও হবে। ভবিষ্যতই হয়ত এসব প্রশ্নের সদুত্তর দেবে। তবে বুঝা যায় নির্বাচনে হেরে কষ্ট ও অভিমান জমেছিল তাঁর। কিন্তু হতোদ্যম হননি। ভেতরে ভেতরে হয়ত ভেঙ্গে পড়েছিলেন। করোনাকালে দেশের রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে যখন মানুষের পাশে না থাকার অভিযোগ তীব্র— কামরান তখনও সিলেট নগরবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছেন, ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে থেকেছেন এবং এরই ফাঁকে করোনায় আক্রান্ত হয়েই বড় অকালে বিদায় নিলেন।

তাঁর মৃত্যুতে সিলেটের রাজনীতিতে এক বিরাট শূন্যতা তৈরি হলো। বিএনপির ছিলেন সাইফুর রহমান, ইলিয়াস আলী; আওয়ামী লীগে জাতীয় নেতা আবদুস সামাদ আজাদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, স্পীকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, শাহ এম এস কিবরিয়া, দেওয়ান ফরিদ গাজী— এঁদের প্রয়াণের পর জাতীয় পর্যায়ে রাজনীতিতে কামরানের একটা পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তিনিও করোনাকালে রাজনৈতিক জীবনের অনেক অপূর্ণতা নিয়ে অকালে চলে গেলেন। সিলেটের রাজনীতিতে এ শূন্যতা সহজে পূরণ হবার নয়।

 

আলমগীর শাহরিয়ার, কবি ও প্রাবন্ধিক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ