আজ বুধবার, ১৬ অক্টোবর, ২০২৪

Advertise

বীভৎস অন্ধকারের থাবা

নিখিল নীল  

পাঁচতলা ভবনের বেডরুমে ঢুকে পড়েছে খুনিরা। “নাস্তিক” কোপানোর জন্য! কুপিয়ে খুনিরা হাঁটতে হাঁটতে পালিয়েও গিয়েছে, সরু ও ঘনবসতি গলির চিপা ধরে। দিনের আলাতেও গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত এ-ভূখণ্ড এখন। অনেক দেরি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে; এ-অন্ধকার গলি থেকে ফিরে আসার কোনও সম্ভবনা নেই। সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে না। কোনও প্রচেষ্টা নেই।

গত মাস কয়েকের ব্যবধানে “নাস্তিক/ব্লগার” খুনের বীভৎস ঘটনাগুলো হল: অভিজিৎ রায়, বইমেলা শেষে ঢাবি ক্যাম্পাস এলাকায়, রাত আট বা নয়টার দিকে; ওয়াশিকুর বাবু, ব্যস্ততম রাস্তায়, দিন-দুপুরে; অনন্ত বিজয় দাশ, নিজের বাসার সামনে, সকালে অফিস যাওয়ার পথে। এর আগে, শাহবাগ আন্দোলনের সময়, রাজীব হায়দার, নিজ বাসার সামনে। আর এবার নিলয় নীল, বিকেলে, পরিবারের সদস্যদের সামনে, নিজের বেডরুমে।

এসব হত্যাকাণ্ডের প্রকৃতি, বীভৎসতা নিয়ে ভাবতে গেলে বাংলাদেশকে আধুনিক রাষ্ট্র বলার সবগুলো পথ বন্ধ হয়ে যায়। কোনও আধুনিক অস্ত্রে নয়, এদের সবাইকেই ধারালো চাপাতির নিচে জীবন দিতে হয়েছে। কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে খুনিরা স্লোগান দিতে দিতে পালিয়ে গিয়েছে। খুনের কারণটাও মধ্যযুগীয়। বিজ্ঞান বিষয়ে, নাস্তিকতা বিষয়ে লেখালেখি করতেন এসব নাস্তিক/ব্লগাররা! উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ছাড়া যে-দেশে একই ধরণের ঘটনা একের পর এক ঘটে যায় সে সমাজ ও রাষ্ট্রকে মানুষের সমাজ বলার ভিত্তিও থাকেনা।



প্রগতি ও বিজ্ঞানের সাথে নাস্তিকতার একটা যোগ আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। আইনস্টাইন বা এমনকি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে যদিও নাস্তিক বলা হয় না, তাঁদের ধর্মভাবনাও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সাথে যায় না। মানুষ সৃজনশীল হলে প্রথাগত সবকিছুর সাথেই, বিভিন্ন মাত্রায়, একটা সংঘর্ষ লেগে থাকে। এর প্রকাশটা বিভিন্নজনে বিভিন্নরকম হয়।

বিজ্ঞান, প্রগতিশীলতা বিষয়ে লেখার কথা ছিল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত মানুষদের। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক, শিক্ষকদের। বাংলাদেশে তা নয়। ওসব প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বাংলাদেশ এখন বুদ্ধিবৃ্ত্তিক কোনও উপযোগিতা পায় বলে মনে হয় না। বিপরীতে, আল্লামা সাইদীকে চাঁদে দেখার কিংবা চাঁদে তোলার পরলৌকিক মানুষ ওসব প্রতিষ্ঠানে অপ্রতুল নয়। সে-কারণে বাংলাদেশের কিছু তরুণ নিজেরা লেখাপড়া করে নিজের মতো করে, নিজের পদ্ধতিতে বিজ্ঞানের চর্চা করে যায়। সে-পদ্ধতিতে অসঙ্গতি এবং ভিন্নমত থাকবে,খুব স্বাভাবিক। কিন্তু, ভিন্নমতের কারণে একের পর এক লেখকে কুপিয়ে মেরে ফেলার ঘটনা, তারপর মানুষের প্রতিক্রিয়া, সরকারের উদাসীনতা এগুলো যে প্রশ্নটির জন্ম দেয় তা হল: এসবের শেষ কোথায়?



শেষ তো আপনা আপনি হবে না। উদ্যোগ নিতে হবে। সমাধানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ উদ্যোগ। এ-সমস্যার শুরুও আপনা আপনি হয়নি। এসব হত্যাকাণ্ড রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি, ও সমাজনীতির ফসল। নামে ও প্রকরণে ভিন্ন হলেও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির চর্চা মূলধারার সবগুলো রাজনৈতিক দলই করে এসেছে। ব্রিটিশপ্রস্থানের সময় থেকে চলে আসা রাজনীতির উত্তরাধিকার এসব। পাকিস্তানের আদর্শ একাত্তরে পরাস্ত হয়েছে যদিও। খুব অল্পদিন সে সাফল্য বাংলাদেশ ধরে রাখতে পেরেছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পুণরুত্থান ঘটেছে। খোলস পাল্টে, বিএনপি এনেছে সে চেতনা, আওয়ামীলীগও সুযোগ বুঝে সেটার ব্যবহার করেছে। সংবিধান কাটাছেড়া করা হয়েছে।



শিক্ষার উদ্দেশ্য বদলে ফেলা হয়েছে— ধর্মীয় শিক্ষার নাম করে তৈরি করা হয়েছে বিপুল এক জনগোষ্টী, যাদের কোনও চাকুরীর বাজার নেই। আধুনিক সমাজে তাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতাও নেই। প্রয়োজন হলে ওদেরকে শাপলা চত্বরে জড়ো করা যাবে। সেটার প্রমাণ দেখা গেছে। শাপলা চত্বরে আসা মানুষগুলো রাষ্ট্র ও শিক্ষাব্যবস্থার সরাসরি উৎপাত। সহজ সমাধান নেই এ সমস্যার। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ছাড়া এ-সমস্যা সমাধানের কোনও বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। এমন সংস্কারের আশা বাংলাদেশে আজ সুদূরপরাহত। কিন্তু, কোনও ধরণের সমাধানের চেষ্টাই তো দেখা যাচ্ছে না। বিশেষ টাস্কফোর্স তৈরি করে দ্রুত সমাধান করা যাবে। সে-ইচ্ছা সরকারের আছে বলে মনে হয় না। এমনকি প্রচলিত আইন প্রয়োগের চেষ্টাও সরকার করছে বলে মনে হচ্ছে না।



রাজীব হায়দারের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমবেদনা নিয়ে নিহতের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ত্বরিৎ পদক্ষেপ নিয়ে খুনিদের গ্রেফতারও করে ফেলা হয়েছে। সেটা গণজাগরণের সময়। হয় তো শিক্ষিত, নাগরিক মধ্যবিত্তের ভোটের হিসাব সরকারকে সহানুভূতিশীল করেছিল। দুঃখজনক, এরপরে অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে অভিজিৎ রায়ের থেতলে যাওয়া মস্তিষ্ক দেখে পুরো পৃথিবী যখন ধিক্কার জানিয়েছে, বড় অদ্ভূত কারণে তখন প্রধানমন্ত্রী নিহতের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো থেকে বিরত থাকলেন। ওয়াশিকুর বাবুর খুনিদের ধরেছে সাধারণ মানুষ। ধরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করলেও এসবের কোনও ফলোআপ কেউ জানে না। অথচ, এসব খুনিদের থেকে খুব সহজেই মূল চক্রের কাছে পৌঁছে যেতে পারে নিরাপত্তাবাহিনী।



বোঝা যাচ্ছে, সরকার এসব হত্যাকাণ্ডকে কোনও গুরুত্বই দিচ্ছে না। কোন গণতন্ত্র তাহলে আওয়ামীলীগের সরকার বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে? ভয়াবহতা বিবেচনায় এসব হত্যাকাণ্ড কতটা বর্বর আর মধ্যযুগীয় সেটা কি তারা উপলব্দি করতে পারছে না? হয় তো সাময়িক সুবিধালাভের প্রেক্ষিতে সরকার এসবকে কোনও এজেণ্ডা হিসেবেই নিচ্ছে না। সরকারের এ-মনোভাব ও অকার্যকারিতা খুবই অপরিণামদর্শী; আত্মঘাতিও। এ-অন্ধকারের কোনও শেষ নেই, এ-থাবা থেকে কেউ রেহাই পাবে না।



মানুষ জেগে ওঠার স্বপ্নটা তবে শেষ ভরসা? সেটাও ইউটোপিয়া ঠেকছে আজকের বাংলাদেশে।

নিখিল নীল, শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, শাবিপ্রবি, সিলেট। বর্তমানে আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব টেনেসিতে সমাজবিজ্ঞানে পিএইডি করছেন। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৪ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০৯ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪২ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৩ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২১ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন