আজ শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

কামাল লোহানী: বিরলপ্রজ আইকন

মাসকাওয়াথ আহসান  

কামাল লোহানী সেই বিরল বাতিঘরদের একজন; যিনি মানুষের মুক্তির জন্য সতত সাংস্কৃতিক সংগ্রাম করেছেন। একাত্তরের আগে; একাত্তরে, একাত্তরের পরে; কামাল লোহানী মুক্তির লড়াইয়ের রণক্ষেত্র ত্যাগ করেননি; পতাকা-মানচিত্র-ভৌগলিক স্বাধীনতাকে মানুষের যাপিত জীবনে পৌঁছে দিতে আমৃত্যু সক্রিয় ছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনে।

তিনি সেই বিরলপ্রজ আইকনদের একজন; যিনি কোন দলীয় উত্তরীয় পরে বিশ্রামে চলে যাননি। পাকিস্তান সরকারের তাণ্ডবের বিরুদ্ধে; সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিপরীতে সাংস্কৃতিক সংগঠনের দুর্গ গড়েছেন। বাংলাদেশ কালেও প্রমিথিউসের মতো আলোর আগুন নিয়ে সংস্কৃতি অঞ্চলে সতত সক্রিয় থেকেছেন। ষাটের দশকের তরুণদের তিনি যেমন প্রাণিত করেছেন; একই ভাবে একবিংশের তরুণদের উদ্দীপিত করেছেন।

নব্বুই দশকে শাহবাগের মুক্তাঞ্চলে, পাবলিক লাইব্রেরি-জাতীয় জাদুঘর-বাংলা একাডেমির মানুষের ভিড়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা একজন দীর্ঘদেহী মানুষকে দেখা যেতো; বাংলাদেশ চেতনার আলোর মশাল নিয়ে ঘুরছেন।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রর শব্দসৈনিক সাজাহান ফারুক, আবদুল্লাহ আল ফারুক বন্ধুদ্বয়ের কাছ থেকে কামাল ভাইয়ের নামটি শোনা যায়; যিনি হাত ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই ছাত্রকে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনে যুক্ত করেছিলেন। সি এস পি পরীক্ষায় না বসে মানুষের মুক্তির সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে ও সতত সক্রিয় থাকতে এই দু'জনকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তিনি। তাইতো তারা পরিবারের সদস্যদের ঝুঁকিতে রেখে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলেন; মিডিয়া যে মুক্তির সংগ্রামে দৃঢ় ভূমিকা রাখতে পারে; সাংস্কৃতিক আন্দোলন যে সশস্ত্র আন্দোলনের চেয়েও দীর্ঘস্থায়ী; আর সততা যে জীবনানন্দের জ্বালানি; এটা কামাল লোহানী সে সময়ের তরুণদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন; নিজের যাপিত জীবনে তা সতত চর্চার মাঝ দিয়ে।

কামাল লোহানীর খদ্দরের পাঞ্জাবি তার স্বদেশ চেতনা, "কখনো বদলে না যাওয়া মানুষে'-র ঋজু চিহ্ন। ক্ষমতা কাঠামোর "বুলবুলি আখড়াই"-এর চেয়ে তারুণ্যের অক্সিজেন ভরা পথ নাটক কিংবা সড়কদ্বীপের সাংস্কৃতিক আয়োজন টেনেছে তাকে বেশি। তাইতো কবি ও কথা সাহিত্যিক মুজতবা আহমেদ মুরশেদের বর্ণনায়, চোখের তারায় ঝিলিক দেয়া স্বপ্ন দ্যোতনার মাঝে আবার কামাল ভাইয়ের গল্প শুনতে পাই। তাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রমিথিউসও কামাল ভাই। এইভাবে কামাল ভাই পাকিস্তানকাল ও বাংলাদেশকালে; একই যুদ্ধের প্রান্তরে থেকে যান। তিনিই সেই অনির্বাণ; যাকে একাকী করে সহযোদ্ধারা ক্ষমতার রঙ্গভবনে রুলিং এলিট সেজে পিঠেপুলি খেতে গিয়েছেন।

কিন্তু কামাল লোহানীর মেরুদণ্ড অনমনীয় ঋজুতায় চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত হ্যাভস-নটদের পাশে সটান দাঁড়িয়ে থাকে। নাগরিক সমাজের আইকন কেমন হওয়া উচিত; এই প্রশ্নের উত্তর কামাল লোহানী।

নিজের জীবনে "সংখ্যা-লঘু"-র বেদনা উপলব্ধির যে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিলো; তা কখনো ভোলেননি তিনি। তাই দক্ষিণ এশিয়া বিভাজনের পরে; বাংলাদেশের "সংখ্যালঘু"-র নিরাপত্তা হতে চেয়েছেন জীবনব্যাপী। অন্যধর্মের মানুষ কর্তৃক একটি ভৌগলিক সীমানায় নির্যাতিত হয়ে; তিনি তাদের প্রতি কোন বিদ্বেষ পোষণ করেননি। বরং অন্য একটি ভূগোলে তাদের আঁকড়ে ধরেছেন আত্মীয়ের মতো। তিনি যে ভালোবাসার মানুষ; বিদ্বেষের কথাকলির আসরের প্রতিশোধ প্রবণ গড়পড়তা চিন্তার মানুষ যে তিনি নন। ঘৃণা নয় ভালোবাসার শক্তি যে অপরিমেয়; কামাল লোহানী একটি পুরো জীবন মানুষকে ভালোবেসে তা দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।

কামাল লোহানী রাজ বিদূষক হবার জন্য জন্মাননি; তিনি সোনালি প্রান্তরের "ক্রান্তি"-কালের লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা। নয়মাসে তার যুদ্ধ ফুরায়না; নবজাগরণের স্বপ্নহানা এই মানুষের মুক্তির সেনাকে তাই কখনোই গার্হস্থ্য খাঁচায় কিংবা সুফল কুড়ানোর সোনার খাঁচার আশেপাশে দেখা যায়নি।

এরকম একজন শিক্ষিত ও যোগ্য মানুষ; যিনি সাংবাদিকতার সোনালি যুগের নক্ষত্র; তিনি স্পন্সরের কাছে নতজানু সম্পাদকীয় নীতির মিডিয়া; কিংবা সরকারি বাতাবি লেবু মিডিয়ার কর্তাব্যক্তি হয়ে জনগণকে ঠকানোর গণযোগাযোগে যাননি; তিনি বরং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মুক্ত যোগাযোগে বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে ঘুরেছেন।

আশির দশকের শেষদিকে রাজশাহী থেকে কোচে করে আসার সময় আমার সামনের সিটে দেখি কামাল লোহানী। অনেকটা পথ; মাঝে ফেরি পারাপার; তাই অনেক গল্পের সুযোগ। আপাত দৃষ্টিতে রাশগম্ভীর এই মানুষটির সঙ্গে নিজে থেকে কথা বলতে যাবার সাহস ছিলো না। এ রকম চেহারার মানুষেরা লেখাপড়ার প্রোগ্রেস রিপোর্ট নিয়ে বসে যান। এইচ এস সি পরীক্ষায় রসায়নে খুব খারাপ নম্বর আসায় আমার মন তখন খারাপ। সঙ্গে নম্বরপত্র আছে; উনি যদি পরিচয় হবার পরেই ওটা দেখতে চান; এই অমূলক ভয়ে কুঁকড়ে ছিলাম আমি।

পরে উনি নিজে থেকেই কথা বললেন। প্রতিটি বাক্য; তার মধ্যে সাজানো শব্দ; খুব সাধারণ কথা; কিন্তু অভিনব তার প্রক্ষেপণ। এতো দীর্ঘ এই রাজশাহী থেকে ঢাকা যাত্রা; এ যেন এক ম্যারাথন ক্লাস লেকচার শোনার উপলক্ষ হয়ে দাঁড়ালো। না তিনি এইচ এস সি-র রেজাল্ট নিয়ে বিচলিত করেননি। বরং ফেরির ওপরে বসে কোচ ড্রাইভারকে বললেন, মান্না দে'র গান তো অনেক শোনা হলো; এ ছেলেটি বোধ হয় হিন্দি গান শোনার জন্য অস্থির; একটু তা-ও বাজান।

এরপর কেয়ামত সে কেয়ামত তাক ছবির তুম ভি আকেলে হামভি আকেলে মজা আ রাহা হ্যায় গানটি শুরু হলে উনি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, না-ও দিলাম তোমার পছন্দের গান বাজিয়ে।

আজ উনি যখন চলে গেলেন, তখন আমার জন্য রেখে গেলেন কামাল লোহানীর সঙ্গে একদিনের স্নেহ ভরা রসায়নের স্মৃতি। আলো এমনই হয়; সহস্র মাইলের দূরত্বেও তা পৌঁছে দিতে পারে; হারানোর বেদনা; প্রাপ্তির আনন্দ, মিডিয়া মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণা।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ