আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বিলেতে বাংলা নাট্য আন্দোলনের ছয় দশক

অসীম চক্রবর্তী  

বিলেতে বাঙালিদের পদচারণা উনিশশত শতকের শেষের দিকে শুরু হলেও বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তা বৃদ্ধিপায় চোখে পড়ার মতো। এই সময়ে নানা ধরণের উপায়ে দেশ ছেড়ে বিলেতে পাড়ি জমান এক দল সাহসী বাঙালি। “একটু ভালো করে বাঁচবো বলে আর একটু ভালো রোজগার, ছাড়লাম ঘর আমি ছাড়লাম ভালোবাসা আমার নীলচে পাহাড় …” অঞ্জন দত্তের এই গানের মতোই একটু ভালো রোজগার আর একটু ভালো করে বাঁচার জন্য বাংলাদেশ ছেড়ে সাত সমুদ্র নোনাজল আর তেরোনদী পেরিয়ে মহামান্য রানীর দেশে এসেছিলেন নানা শ্রেণির মানুষ। তাদের অনেকেই ছিলেন শ্রমিক, ছিলেন পরিচারিকা, ছিলেন উচ্চশিক্ষা লাভের আশায় আসা একদল তরুণ। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট বিহিত ওই দুর্গম সময়ে ভিনদেশে ভিনভাষী মানুষের ভিড়ে সঠিক তথ্য পাওয়া এবং আদান প্রদান করাই ছিলো এক মহাযুদ্ধ। সঙ্গত কারণে সংগ্রামটাও ছিলো ভিন্ন। তবুও সেই বন্ধ্যা সময়ে নানা প্রতিকূলতার সাথে সাথে সংগ্রাম করে ভিন দেশে অগ্রজ বাঙালিরা তৈরি করেছে নিজেদের ভিত্তি। যে ভিত তৈরির পেছনে আছে হাজারো দুঃসাহসী অভিযানের গল্প, আছে কষ্টের উপাখ্যান আছে ত্যাগ তিতীক্ষার ট্রাডেজি। সেই গল্প করবো অন্য কোনো একদিন অন্য কোনো স্থানে। আজকে কেবলই বিলেতে বাংলা নাট্যচর্চার গল্প।

বিলেতে বাংলা নাট্যচর্চার গোড়াপত্তন পঞ্চাশ সালের শেষের দিক থেকেই। কালের পরিক্রমায় বাংলা নাটক পরিভ্রমণ করেছে গ্লোব থিয়েটার, ফ্রিঞ্জ ফ্যাস্টিভ্যাল, বিবিসি, চ্যানেল ফোর সহ বিলেতের আনাচে কানাচে। পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার এবং সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের গ্লোব থিয়েটারে বাংলা ভাষায় নাটক মঞ্চায়ন অথবা বিশ্বের অন্যতম নাট্য উৎসব এডিনবরা ফ্রিঞ্জ ফেস্টিভ্যালে বাংলা নাটক যেন সোনায় সোহাগা। সেই সোনার মুকুটে গত ২০০৩ সাল থেকে মাস ব্যাপী সিজন অফ বাংলা ড্রামা প্রতি বছর একটি করে পালক সংযুক্ত করে চলেছে। হাজারো বাঁধা, ব্যস্ত নাগরিক জীবন আর প্রতিদিনের গৎবাঁধা কর্মজীবনের ফাঁকে হাজার বছরের পুরাতন এই ইট পাথরের শহরে আজ বাংলা নাটকের মহড়া প্রায় নিয়মিতই বলা চলে। বিশ্ব নাট্যাঙ্গনে বাংলা নাটকের এই দীপ্ত পদচারণা একদিনে অর্জিত হয়নি। এর পেছনে রয়েছে যুগ যুগ ধরে শত শত বিলেত প্রবাসী বাংলাদেশী নাট্যকর্মীদের নিরলস শ্রম, সাধনা এবং ভালোবাসা।

‘আব্রাহাম মাসলো’ তাঁর ‘হায়ারাকি অফ নিডস’ থিয়োরিতে মানুষের চাহিদা এবং প্রয়োজনীয়তাকে পাঁচটি স্তরে ভাগ করেছেন। তাঁর ভাষ্যমতে মানুষের প্রথম চাহিদা হলো খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র এবং আশ্রয়, তার পরেই নিরাপত্তা এবং পরিচিতি। মাসেলো যদি বাঙালিদের নিয়ে গবেষণা করতেন তবে হয়তো বলতেন বাঙালিদের প্রথম চাহিদা খাদ্য এবং দ্বিতীয় চাহিদা বাংলার লোকায়ত সংস্কৃতি। নানা ধরণের অব্যবস্থাপনা এবং দারিদ্র্য থাকলেও বাংলাদেশের আনাচে কানাচে প্রায় প্রতিটি মানুষের রয়েছে গলায় গলায় গান, গ্রামে গ্রামে নাটক, যাত্রা পালা। উৎসব প্রিয় বাঙালিরা বাংলা সংস্কৃতিকে ধারণ করে প্রাণের গভীর থেকে। সুতরাং বাঙালিরা যেখানেই যাক, সেখানে নিয়ে যায় বাংলার দোআঁশ মাটির ঘ্রাণ, কণ্ঠ ভরা গান আর বুক ভরা বাঙালি সংস্কৃতি। বিলেতের প্রারম্ভিক সময়ের বৈরিতাকে মোকাবেলা করে বাঙালিরা ধীরে ধীরে বিলেতের বুকে শুরু করে বাংলা সংস্কৃতি চর্চা। পঞ্চাশের দশকে বিভিন্নজনের বাড়িতে অথবা রেস্টুরেন্টে বাউল গানের আয়োজন হতো। তবে যেহেতু নাটক করতে লোকবল এবং টেকনিক্যাল সাপোর্টের প্রয়োজন হয় তাই বিলেতে বাংলা নাট্যচর্চা শুরু হয় তারও খানিক পরে। জানা যায় ষাটের দশকে বিলেতে বাংলাদেশী বাঙালিরা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে এবং সেই সাথে শুরু হয় সাংস্কৃতিক চর্চা।

বিলেতে বাংলাদেশী বাঙালিদের বাংলা নাট্যচর্চা ষাটের দশকে শুরু হলেও বিলেতে ওপার বাংলার সবচেয়ে পুরনো সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বেঙ্গলি ইন্সটিটিউট ১৯৫৮ সালে বিজন দাশগুপ্তের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “চিরকুমার সভা” নাটকটি মঞ্চায়িত করে। পরিবর্তিতে বেঙ্গলি ইন্সটিটিউট সেই সময়ে আরও অনেকগুলো নাটক মঞ্চস্থ করে। নাটকগুলোতে কাজ করেন অসিত রায় চৌধুরী, নির্মল ঘোষ, বিনাধ বোস, মঞ্জু মিত্র, দীপক কর, দিলীপ চক্রবর্তী, উজ্জ্বল গুহ, শিশির দত্ত প্রমুখ।

পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে বিলেত প্রবাসী এপার বাংলার বাঙালিরা বিক্ষিপ্ত ভাবে নিজেদের মধ্যে গান বাজনা এবং সংস্কৃতি চর্চা করলেও তেমন কোনো সাংস্কৃতিক সংগঠন তৈরি হয়নি। ওই সময়ে পূর্ব লন্ডনের শ্রমজীবী মানুষের সাথে সম্পৃক্ততা তৈরি এবং সবাইকে নিয়ে সাংগঠনিক ভাবে নাট্যচর্চা করার লক্ষ্যে বিশিষ্ট সমাজকর্মী আব্দুল মালেক একটি নাটক মঞ্চায়নের চিন্তা করেন। অবশেষে ওপার বাংলার বাঙালিদের গড়া সংগঠন বেঙ্গলি ইন্সটিটিউটের সহায়তায় শুরু হয় নাটক সিরাজোদৌল্লা’র মহড়া এবং প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্টার্ন কালচার সোসাইটি।সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও অর্গানাইজার নির্বাচিত হন যথাক্রমে কাজি নুরুস সোবহান, অমল বোস ও আব্দুল মালেক। প্রায় নয় মাস মহড়ার পরে অমল বোসের পরিচালনায় অবশেষে বিলেতের মাটিতে মঞ্চস্থ হয় বাংলাদেশী বাঙ্গালিদের প্রথম নাটক “সিরাজোদৌল্লা”, শুরু হয় বিলেতে বাংলা নাটকের ইতিহাস।

ব্যাপক দর্শক চাহিদা এবং জনপ্রিয়তার ফলে ১৯৬২ সালে আবারো বর্তমান কমার্শিয়াল স্ট্রিটের টয়নবি হলের কার্টেন থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় নাটক সিরাজোদৌল্লা। অভিনয় করেন পরিচালক অমল বোস নিজে এবং অন্যান্য তিন তিনটি চরিত্রে অভিনয় করেন ছাত্রনেতা সুবিদ আলী টিপু। নাটকে আমন্ত্রিত হয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন স্থানীয় মেয়র জন অলওয়েল, পিটার শোর এমপি, ইয়ান মিকার্ডো এমপি ও বিল হিলটন এমপি।নাটকটি দেখে তৎকালীন এমপি পিটার শোর ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং সবসময় বাঙালিদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তী সময়ে বাঙালিরা মূলধারার রাজনীতিতেও যুক্ত হন।

আগেই বলেছিলাম তৎকালীন সময়ে ব্রিটেনে পড়াশোনা করার জন্য অনেকেই এসেছিলেন যারা পড়াশোনা শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করে নানা ক্ষেত্রে এখনো নেতৃত্বদান করে চলেছেন। এদের মধ্যে একজন হলেন বর্তমান বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদ। ষাটের দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশ জুড়ে ছিলো এক উত্তাল অবস্থা বিরাজমান ছিলো। প্রাক মুক্তিসংগ্রাম সময়ের সেই উত্তাল হাওয়া আন্দোলিত করেছিল বিলেত প্রবাসী বাংলাদেশীদের। ফলশ্রুতিতে ১৯৬৬ সালে বাংলার মুক্তিকামী জনগণের সাথে সংহতি জানাতে বিলেত প্রবাসী ছাত্রদের সংগঠন “শিল্পী সংঘ” মওদুদ আহমেদের লেখা নাটক”নবজন্ম” মঞ্চস্থ করে লন্ডনের সেইন্ট জর্জেস হলে।

নানা সময়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা বিলেতে বাংলা নাটককে আজকের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ১৯৬৮ সালে জনাব আব্দুল মালিকের প্রচেষ্টায় টাওয়ার হ্যামলেট গার্লস স্কুলে বাঙালিদের জন্য শুরু হওয়া ইংরেজি শিক্ষা এবং নাট্যাভিনয়ের ক্লাস। যেখানে অমল বোস শিখাতেন নাটকের কলা কৌশল আর লুৎফুর রহমান শেখাতেন ইংরেজি ভাষা। কর্মক্লান্ত দিন শেষে বাঙালিরা বিনোদনের জন্য উপস্থিত হতেন নাট্যাভিনয় ক্লাসে। চলতো মহড়া। ক্ষুদ্র পরিসরে মঞ্চস্থ হতো ছোট ছোট নাটক। যা ছিলো বিলেতের বুকে আজকের ব্যাপক নাট্যচর্চার বপনকাল।

সত্তরের দশকের দিকে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি বিলেতে বাংলা সংস্কৃতি চর্চা ধীরে ধীরে বেগবান হচ্ছিলো। যার নেতৃত্বে ছিলেন তাসাদ্দুক আহমেদ, আব্দুল মালিক, শিশির দত্ত, সবিতা দত্ত সহ বিলেতে পড়তে আসা তরুণ ছাত্ররা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯৬৯ সালে গঠিত হলো “বাঙালি জাতীয় সাংস্কৃতিক সংসদ” এবং ১৯৭০ সালে গঠিত হলো “বেঙ্গলি কালচারাল এসোসিয়েশন”। একদিকে বিলেতের বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন এবং অন্যদিকে বাংলাদেশে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের থমথমে সময়ে বিলেতের বাঙালিদের আরও উদ্দীপ্ত করলো নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধারণ করে বিশ্বের দরবারে বাংলাকে পরিচিত করবার। দেশপ্রেম আর মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামের প্রতি সংহতি স্বরূপ অমল বোসের পরিচালনায় ১৯৭০ সালে আবারো মঞ্চায়িত হলো বিলেতের প্রথম বাংলা নাটক “নবাব সিরাজুদৌল্লা”।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশে বেজে গেছে যুদ্ধের দামামা। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিয়েছেন এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। সেই আগুনের আঁচ সাত সমুদ্র পেরিয়ে থেমসের কূলে এসে লাগলো। এখানেও শুরু হলো সংগ্রাম। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রাম। বিলাতের উত্তাল দিনগুলোতে ভিন্ন মাত্রা যোগ করলো বিলেতে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে আসা বাংলাদেশী ছাত্রদের একটি সাংস্কৃতিক উদ্যোগ যার নাম বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ। বিলেতের বুকে ঠিক যেন আরও একটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। ১৯৭১ সালের মে মাসে লন্ডন ডব্লিউসি-১ এলাকার টেভিস্টক প্লেসের ৫৯ নং সেমুর হাউসে মিসেস মুন্নী রহমানের বাসায় প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। আর সেই সভাতেই সংগঠনের নামকরণ, উল্লেখিত ঠিকানায় অফিস পরিচালনার পাশাপাশি এনামুল হককে সভাপতি ও মুন্নী রহমানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে ২১ সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। কমিটির অন্যান্য কর্মীরা ছিলেন— সহসভাপতি যথাক্রমে শফিকুর রহমান, ফজলে লোহানী (নন্দিত টিভিব্যক্তিত্ব) ও শাহিদুদ দাহার, সহ-সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ হাসান ও জাকিউদ্দিন আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক বুলবুল আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ আনিস আহমদ (সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক); সদস্যবৃন্দ— নারীনেত্রী লুলু বিলকিস বানু, জেবুন্নেসা খায়ের, আহম্মদ হোসেন জোয়ারদার, শিল্পী আবদুর রউফ, এম এ রউফ, মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ, এ এফ এম নজরুল ইসলাম, এ রাজ্জাক সৈয়দ, জিয়াউর রহমান খান ও ড. হুজুত আলী প্রামাণিক।

১৮-১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। রেড লায়ন স্কোয়ারের কনওয়ে হ্যলে গণসংস্কৃতি সংসদ আয়োজিত দু’দিনব্যাপী উৎসবে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় সংগঠনের সভাপতি এনামুল হকের রচনা ও সুরারোপে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বিপ্লবী গীতিআলেখ্য ‘অস্ত্র হাতে তুলে নাও’ নৃত্যনাট্য ও গীতিবিচিত্রা। সাড়া-জাগানো সেই সাংস্কৃতিক উৎসবের উদ্বোধক ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। বিশেষ অতিথি ছিলেন সদ্য বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাগত ব্রিটিশ রাজনীতিক পিটার শোর এমপি ও চিত্রপরিচালক জহির রায়হান। অনুষ্ঠানের প্রবেশমূল্য ছিল ০১ পাউন্ড। লন্ডন সাংস্কৃতিক উৎসবের একদিন আগে ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন’ (ল্যাঙ্কাশায়ার ও পার্শ্ববর্তী এলাকা) ম্যানচেস্টার-এর আমন্ত্রণে ১৬ অক্টোবর দুপুর দেড়-ঘটিকায় স্থানীয় ফ্রি-ট্রেড মিলনায়তনে ‘অস্ত্র হাতে তুলে নাও’ নৃত্যনাট্যটি পরিবেশন করে গণসংস্কৃতি সংসদ। নৃত্যনাট্যের প্রধান দুই চরিত্র কিষাণ (মাহমুদ এ. রউফ) ও কিষাণী (মঞ্জু হাফিজ)।

বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বিলেতে নানা কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সত্তরের দশকে বিলেতে বাংলা নাট্যকর্মীদের একটি পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছিলো। যা বিলেতে বাংলা নাট্যচর্চাকে বেগবান করে। সেই সাথে এই সময়ে অনেকগুলো ইয়ুথ সংগঠন তৈরি হয় যার মধ্যে বাংলাদেশ ইয়ুথ ফ্রন্ট, প্রোগ্রেসিভ ইয়ুথ অর্গানাইজেশন, বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগ অন্যতম। এসব সংগঠন ও বাংলা নাট্যচর্চার সাথে সম্পৃক্ত হয়। ১৯৭৩ সালে কুইন মেরি কলেজ, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে, মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘উল্কা’। অভিনয় করেন আসাব আহমদ, জ্যোতি হাসান, অবই খান, মিফতার আলী, রোজি বেগম, খালেদা বেগম, ফৌজিয়া বেগম প্রমুখ। অমল বোস ১৯৭৪ সালে পরিচালনা করেন “মিলন সেতু” নাটক। এতে অভিনয় করেন জাহাঙ্গীর খান, মিফতার আলী, গোলাম এহিয়া, মানিকুর রহমান, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, আব্দুর রউফ, এখলাস উদ্দিন, ফয়জুর রহমান, মুজিবুল হক, গোলাম সরোয়ার, আব্দুল জব্বার, মি. মজুমদার, শফিকুর রহমান, ফাতেমা মোশাররফ, সেলিনা মোল্লা, লুৎফা বেগম। ১৯৭৪ সালের সাতই ডিসেম্বর শনিবার বিজয় দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে বেথনালগ্রিন এডাল্ট এডুকেশন ইন্সটিটিউটের বাঙালি ছাত্রদের অভিনয়ে বেথনালগ্রিন ডেনফোর্ড স্কুলের হলে মঞ্চস্থ হয় নাটক ডাকবাক্স। এর ঠিক পরের বছর অমল বোস পরিচালনা করেন আরও দুটি সফল নাটক “টিপু সুলতান” এবং “ভাড়াটে চাই”।

নাট্যামোদী এবং অভিনেতা অভিনেত্রী পাওয়া গেলেও তৎকালীন সময়ে নাট্য পরিচালকের অভাব ছিলো প্রকট। ১৯৭৬ সালে কুতুব উদ্দিন অমল বোসের সহায়তায় নাট্য নির্দেশনা শুরু করেন। ১৯৭৭ সালে কুতুব উদ্দিনের নির্দেশনায়, নুরুল হকের সংগীত পরিচালনায় এবং বেঙ্গলি আর্টিস্ট এসোসিয়েশনের আয়োজনে প্রথম নাটক কমলা সুন্দরীর সফল মঞ্চায়ন হয়। প্রচুর দর্শক সমাগম হওয়া সেই শো তে দর্শকরা নাটকের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

সত্তর দশকের গোড়ার দিকে ব্রিটেনে বর্ণবাদের আগ্রাসন চরমে। ১৯৮৩ সালে কুতুব উদ্দিন আবারো ‘এ পৃথিবী টাকার গোলামী’ নামের এর একটি নাটক নির্দেশনা দেন। ১৯৭৮ সালে পূর্ব লন্ডনের এডলার স্ট্রিটে তৎকালীন সেইন্ট ম্যারি পার্কের পাশে এক বর্ণবাদী হামলায় নিহত হলেন প্রতিবাদী টগবগে বাঙালি যুবক আলতাব আলী। আলতাব আলীর রক্তের ধারা ঐক্যের ডাক দিলো পূর্ব লন্ডনের সকল মুক্তমনা মানুষদের। সম্মিলিত সংগ্রামের মুখে পরাজিত হলো বর্ণবাদ। সেইন্ট ম্যারি পার্কের নাম হলো আলতাব আলী পার্ক। যে পার্কে নব্বইয়ের দশকে তৈরি হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে একটি শহীদ মিনার। যা আজ বিলেতে বাঙালিদের সকল আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার।

১৯৭৮ সালের সেই উত্তাল সময়ে বাংলাদেশ ইয়ুথ মুভমেন্ট’র আয়োজনে অমল বোস আবারো পরিচালনা করলেন নাটক “এক মুঠো অন্ন চাই” যা বিলেতের বাঙালি কমিউটিনিতে সাড়া ফেলে দিলো। এই সাফল্যের পরে দর্শকের চাহিদার কারণে পরে এটি হাফমুন থিয়েটারেও মঞ্চস্থ হয়। জানা যায়, তখন ‘প্রাচ্যবাণী ইন্টারন্যাশনাল’ নামক সংগঠন থেকে এটি চার চারটি পুরস্কারও লাভ করে। এই দশকের শেষভাগের সবচেয়ে অন্যতম অর্জন হলো “বাংলাদেশ ড্রামা সোসাইটি” নামের একটি নাট্য সংগঠন । আব্দুল লতিফ খানের (অবই খান) নেতৃত্বে গঠিত এই সংগঠন ধারাবাহিক ভাবে নাটক মঞ্চস্থ করা শুরু করে। তাদের প্রযোজনার মধ্যে অন্যতম হলো শান্তি, চাঁদ কুমারী, চাষার ছেলে, সাগর ভাসা, বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না ইত্যাদি। সত্তরের দশকের শেষ ভাগে ১৯৭৮ সালে বিখ্যাত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানীর রচনা ও নির্দেশনায় এবং ইয়ুথ ফ্রন্টের প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হয় নাটক “মীর কাশিম”, অভিনয়ে ছিলেন সিরাজুল হোক সিরাজ রফিকুল্লাহ এবং আশরাফ মাহমুদ নেসওয়ার প্রমুখ।

সত্তরের দশকে একজন নারী নাট্যকর্মীর কথা না বললে অপূর্ণতা থেকেই যায়। যার নাম সাহারা মোশারফ। যিনি তৎকালীন সময়ের রক্ষণশীল পরিবেশেও নাটকঅন্ত প্রাণ ছিলেন। অভিনয় করেছেন বহু নাটকে। এই দশকে বাংলা নাট্যচর্চা যাদের হাত ধরে গিয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অমল বোস, এম এ রউফ, অবই খান, মিফতার আলী, আব্দুল মালিক,কুতুব উদ্দিন, আসাব উদ্দিন,রাজন উদ্দিন জালাল, জাফরী জোবায়ের এবং আশরাফ মাহমুদ নেসওয়ার।

ইতিহাসের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বুঝা গেলো আশির দশক ছিলো বিলেতে বাংলা সংস্কৃতি চর্চার বিপ্লবের দশক। সেই দশকে ১৯৮২ সালের ২৩শে অক্টোবর ব্রিকলেনের অদূরে হ্যানবেরি স্ট্রিটে “বেঙ্গলি একশন গ্রুপ” এবং স্থানীয় কাউন্সিলের সহায়তায় ‘কবি নজরুল সেন্টার’ নামের একটি কমিউনিটি হল তৈরি হয়। একেবারেই নিজেদের একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। যা বিলেতের সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।

আশির দশকের শেষের দিকে আরেকটি অর্জন হলো ১৯৮৮ সালে বিলেতে ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী যুক্তরাজ্য সংসদ’ গঠন। লুসি রহমান এবং সৈয়দ বেলালের নেতৃত্বে গঠিত নতুন কমিটি নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি বিস্তারের লক্ষ্যে বিলেতের প্রবাসী সাংস্কৃতিক কর্মীদের সংগঠিত করে। কবি নজরুল সেন্টারের ঐতিহাসিক উদ্বোধনী দিনে মঞ্চস্থ হয় খালেদ মাহমুদের লেখা নাটক ‘বীর বাঙালি’। বিলেতে প্রারম্ভিক সময়ের নাট্যকর্মী কুতুব উদ্দিনের সাথে কথা বলে জানা যায় আশির দশকের প্রথম দিকে ‘কবরের কান্না’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়, যে নাটক প্রযোজনার সাথে তৎকালীন যুব সংগঠন বাংলাদেশ ইয়ুথ লীগের সংগঠক এবং বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল হক ও ভীষণ ভাবে যুক্ত ছিলেন। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে আশরাফ মাহমুদ নেসওয়ারের নির্দেশনায় মঞ্চে আসে বিলেতে প্রথম দ্বিভাষিক (বাংলা এবং ইংরেজি মিশ্রণে) নাটক ‘হোয়াট এবাউট মি’, মঞ্চস্থ হয় প্রোগ্রেসিভ ইয়ুথ অর্গানাইজেশনের প্রযোজনায় নাটক ‘লোনা জলে সাঁতার’, যে সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন আব্দুল মুকিত চুন্নু, হেলাল রহমান। নাটকটি হাফমুন থিয়েটার মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকে দেশের বাহিরের কোনো প্রযোজনায় প্রথম অভিনয় করেন জয়শ্রী কবির। নাটকটি কমিউনিটিতে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তিন পাউন্ড দর্শনীর বিনিময়ে নাটকটি উপভোগ করেন প্রায় হাজার খানেক দর্শক। প্রবাসীদের জীবন এবং জীবিকাকে উপজীব্য করে গড়ে উঠা এই নাটক দেখে অশ্রু সিক্ত হয়েছেন হলভর্তি দর্শক। পরে দর্শকদের আগ্রহের কারণে নাটকটির আরও কয়েকটি মঞ্চায়ন হয়। সমসাময়িক সময়ে ‘বাপা'(বাংলাদেশ পারফর্মিং আর্টস) নামের সংগঠন অনেক গুলো নাটক বিলেতের বাংলা মঞ্চে আনে, যার মধ্যে অন্যতম একটি নাটক ছিলো ‘অরক্ষিত মতিঝিল’।

আশির দশকের শেষভাগে এশিয়ান স্টাডিস সেন্টারের সৌজন্যে জনাব রহমান জিলানী টয়নবি হলে একটি নাট্য উৎসবের আয়োজন করেন। যতদূর জানা যায় এটাই ছিলো বিলেতে প্রথম নাট্য উৎসব। আশির দশকে বাংলা নাটকের পূর্ণতা আসে বিশ্বের অন্যতম টিভি চ্যানেল বিবিসি এবং চ্যানেল ফোর এ নাট্যকর্মী এবং নির্দেশক রুহুল আমিনের নির্দেশনায় বাংলা নাটক, শর্ট ফিল্ম এবং ডকু ফিল্ম প্রদর্শনীর মাধ্যমে।

গোটা আশি এবং নব্বই দশকের প্রথমাংশ জুড়ে “লিংক প্রমোশন” নামে একটি সংগঠন লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি নবাব উদ্দিনের নেতৃত্বে কমার্শিয়াল থিয়েটারে মননিবেশ করে এবং ব্যাপক সফলতা অর্জন করেন। লিংক প্রোমোশনের নাটক গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বরেণ্য নাট্যকার আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘ক্রস রোডে ক্রস ফায়ার, ‘সুবচন নির্বাসনে’ এবং খ্যাতিমান লেখক শক্তিপদ রাজগুরু’র ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এবং নবাব উদ্দিনের নিজের লেখা নাটক ‘তোমাদের ভালোবাসা চাই’, বাই ল্যাঙ্গুয়াল নাটক ‘স্কিন’ ‘রেসিস্ট’ উল্লেখ যোগ্য। যা সেন্ট্রাল লন্ডনের ক্যামডেন টাউনের বিভিন্ন হল সহ বিখ্যাত ‘লগন’ হলে মঞ্চস্থ হয়। পরবর্তীতে লিংক প্রমোশন আরও ব্যাপক আকারে এবং বাণিজ্যিক ভাবে নাটকনাটক মঞ্চায়ন শুরু করে এর মধ্যে অন্যতম হলো নবাব উদ্দিনের কাহিনী এবং বরেণ্য সাংবাদিক আব্দুল গাফফারের নাট্যরূপে নাটক ‘নিউ হোম’, ‘জীবন যেখানে’, ‘মরীচিকা’, ‘তারপর’, ‘পায়রা’। যে নাটক গুলোতে নির্দেশনা দিয়েছেন নবাব উদ্দিন, তৌকির আহমেদ (বিখ্যাত টিভি অভিনেতা এবং নির্দেশক) এবং ক্যামডেন কাউন্সিলের সাবেক মেয়র নুরুল ইসলাম পুতুল প্রমুখ। নবাব উদ্দিনের লেখা একটি নাটক ‘জীবন যেমন এখানে’ নাটকে নির্দেশনা দেন বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। লিংক প্রমোশনের এইসব বাণিজ্যিক নাটকে অভিনয় করেছেন দেশ বরেণ্য অভিনেতা অভিনেত্রীরা এর মধ্যেমধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলেন শমী কায়সার , তৌকির আহমেদ, আফসানা মিমি, শহীদুজ্জামান সেলিম, জাহিদ হাসান, আবুল হায়াৎ, বিপাশা হায়াৎ । সেই সাথে বিলেতের স্থানীয় অভিনেতাদের মধ্যে অভিনয় করেন স্বাধীন খসরু, কিবরিয়া, সুমন, বাহার, সেতু চৌধুরী, তসলিম আহমেদ, উদয় শংকর দাস, উর্মি মাজহার, শেফালী হক, গুলনাহার খান, রিতা খান, সানি হোসাইন, গৈরিকা গুপ্তা, আফতাব মিয়া ।

তৎকালীন সময়ের নাট্যকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায় আশির দশকে বিলেতে নাট্যচর্চার উত্তরণ ঘটেছে ঠিকই তবে আশানুরূপ উত্তরণ হয়নি। যার প্রধান কারণ সমূহ হলো নাট্যকর্মীদের মধ্যে সৃষ্ট বিভাজন, সত্তরের দশকের তুখোড় নাট্যকর্মীদের মূল ধারার রাজনীতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়া। বর্তমান টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের অফিসার, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে নানা পদে আসীন বহু মানুষই সত্তর এবং আশির দশকের তুখোড় নাট্যকর্মী ছিলেন। তবে অন্য আরেকটি গুরুত্ব পূর্ণ কারণ ও ছিলো অভীষ্ট লক্ষ্যে না পৌঁছানোর কারণ, তা হলো ধীরে ধীরে পূর্ব লন্ডনের বাঙালি কমিউনিটিতে মৌলবাদী শক্তির প্রসার ঘটা। যা আজকের বাস্তবতায় এক বিষবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়েছে

নব্বই দশকে পশ্চিমা বিশ্বের ব্যস্ততম শহর লন্ডনের কেন্দ্রস্থল আলতাব আলী পার্কে বাংলাদেশের শহীদ মিনারের আদলে তৈরি হয় শহীদ মিনার। ভিন দেশে রচিত হয় বাঙালির আরও একটি গৌরব উপাখ্যান। আশির দশকের শেষের দিকে মুক্তিযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে রচিত আশরাফ মাহমুদ নেসওয়ারের লেখা এবং নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় নাটক “রক্ত রবির আহবান” যা নব্বই দশকে বহুবার মঞ্চস্থ হয়। নব্বই দশকের প্রথম দিকে এই নাটকের অন্যতম মঞ্চায়ন ছিলো ইয়র্ক হলের বাংলাদেশ মেলায়। ১৯৯৪ সালে মঞ্চে আসে নাটক “বিপন্ন জীবন” যার প্রথম মঞ্চায়ন হয় ব্রিকলেনের স্পিটফিল্ড মার্কেটে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ট্রেড মেলায়।

১৯৯৬ সালে ঢাকা বিমানবন্দরে নিহত বিলেত প্রবাসী সুরত মিয়াকে নিয়ে আশরাফ মাহমুদ নেসওয়ার লেখেন নাটক ‘নিহত বিমানবন্দর’। তা পরবর্তীতে তাঁর নিজের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয় টয়নবি হলের কার্টেন থিয়েটারে। নব্বই দশকে গঠিত হওয়া সংগঠন গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি নাট্য সংগঠন হলো ‘মিতালি আর্টস’। সংগঠনটি এখনো তাঁদের নাট্যচর্চা অব্যাহত রেখেছে। মিতালি আর্টস গঠিত হওয়ার পরেই সংগঠনটি ” করিম আল রাওয়াই নামের এক ইজিপশিয়ান লেখকের লেখা নাটক ‘ম্যারিং পিন্টু’ নাটকটি মঞ্চস্থ করে। নাটকটিতে নির্দেশনা দেন ব্রিটেনের মূলধারার নাট্য নির্দেশক ফিলিপ কার এবং অভিনয় করেন বিখ্যাত টিভি শো ইস্ট এন্ডার খ্যাত ভাস্কর প্যাটেল এবং আশরাফ মাহমুদ নেসওয়ার প্রমুখ। এই দশকের শেষের দিকে বিলেতের বাংলা নাটকের মঞ্চে আসে জাগরণ আর্টসের প্রযোজনায় কুইনমেরি কলেজ, ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের থিয়েটার হলে মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘নাতীন জামাই’। দর্শনী মূল্য দশ পাউন্ড হওয়া সত্বেও প্রায় এক হাজার দর্শকের সমাগম হয়েছিলো সেদিনের শো তে । জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বহু দর্শক বিফল মনোরথে ফিরে যেতে বাধ্য হন।

শুরু হলো নতুন শতাব্দী। যে শতাব্দীতে বিলেতের নাট্য আন্দোলন পেলো ভিন্ন মাত্রা। ২০০২ সালে শাহ এনামের নির্দেশনায় ইস্টার্ন থিয়েটার মঞ্চে আনে বাংলাদেশের কালজয়ী নাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। স্থানীয় কাউন্সিলের সহায়তায় ২০০৩ সালে শুরু হলো মাস ব্যাপী এ সিজন অফ বাংলা ড্রামা যা এখন বিলেতের মূলধারায় ও একটি অন্যতম নাট্য উৎসব হিসাবে স্থান পেয়েছে। কবি নজরুল সেন্টারের মঞ্চে শুরু হওয়া এই নাট্য উৎসবের নেতৃত্বে ছিলেন আশরাফ মাহমুদ নেসোয়ার। বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের বাহিরে এই প্রথম কোনো শহরে শুরু হলো মাস ব্যাপী বাংলা নাট্য উৎসব। মাস ব্যাপী এই মেলা বিলেতের বাংলা নাট্য আন্দোলনকে অদ্যাবধি সমৃদ্ধ করে চলেছে । পশ্চিমা বিশ্বের ব্যস্ততম কর্মব্যস্ত দিনে সবাই জীবন জীবিকার তাগিদে ব্যস্ত। তাই ঠিক করা হলো সপ্তাহের দুটি ছুটির দিনে দুটি করে নাটক প্রদর্শিত হবে। অর্থাৎ মাস ব্যাপী নাট্য উৎসবে আটটি গ্রুপের নাটক প্রদর্শনী হবে। আজকে পনেরো বছর পরে মাস ব্যাপী নাট্য উৎসবে অংশ গ্রহণ করছে প্রায় বারোটি দল। বিগত কয়েক বছর ধরেই আমন্ত্রিত হয়ে আসছেন বাংলাদেশের প্রথিতযশা নাট্যদল। উৎসবের মঞ্চ আলোকিত করেছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত নাটক। বাংলাদেশ থেকে আগত প্রযোজনার মধ্যে অন্যতম সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় নাটক মহাজনের নাও, ম্যাড থেটারের নদ্দিউ নতিম, স্বপ্ন দলের ত্রিংশ শতাব্দী উল্লেখ যোগ্য। এই দশকে বিলেতের বাংলা নাটক সমৃদ্ধ করেছে আরও কিছু দেশীয় প্রযোজনা তার মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো নাগরিক থিয়েটারের ‘দ্য টেম্পেস্ট’, বাংলা থিয়েটারের ‘দ্য ডিসটেন্ট নিয়ার’ শূন্যন থিয়েটারের ‘লাল জমিন’ এবং থিয়েট্রেক্স এর ‘দক্ষিণা সুন্দরী’। এর মধ্যে দ্য টেম্পেস্ট মঞ্চায়িত হয় শেক্সপিয়ারের গ্লোব থিয়েটারে, দখিনা সুন্দরী এবং দ্য ডিসটেন্ট নিয়ার নাটক দুটি স্থান পায় এডিনবরার বিশ্ব বিখ্যাত উৎসব ফ্রিঞ্জ ফ্যাস্টিভ্যালে।

বিলেতের মাটিতে বাঙালি কমিউনিটিতে বৈষম্যহীন সমাজ তৈরি, মৌলবাদী বিরোধী সংগ্রাম, এবং বিলেতে বাংলা কমিউনিটির নানা সংকট এবং অর্জনে নাটক, গান সহ নানা ধরণের কর্মসূচিতে সরব ছিলো যুক্তরাজ্য উদীচী। এখনো সংগঠনটি নিয়মিত নাটকের মহড়া এবং মঞ্চায়ন করে যাচ্ছে। এযাবৎ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য উদীচী প্রযোজনা করেছে সর্বোচ্চ চৌদ্দটি নাটক। এর মধ্যে জয়েন ঊদ্দীনের এক দিন, উনিশ শ একাত্তর, ইঁদারা একটি কালো সুটকেস অন্যতম।

নাট্যকর্মী লিসা গাজীর নেতৃত্বে সাম্প্রতিক সময়ে একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কমলা কালেকটিভস নামের একটি সংগঠন গবেষণাধর্মী করে চলেছে। এর মধ্যে তাঁদের ইংরেজি ভাষায় একটি নাটক “বীরাঙ্গনা দ্য উইম্যান অফ ওয়ার” অশ্রুসিক্ত করেছে হলভর্তি দর্শকদের। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য বিভাগের শিক্ষক এবং কমনওয়েলথ স্কলার সুদীপ চক্রবর্তীর নির্দেশনায় নাট্যদল পূর্বানাট মঞ্চে আনে ১৯৭৮ সালের বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে মুরাদ খানের লেখা ইংরেজি ভাষায় নাটক “ব্রিকলেন ৭৮”। যা বিলেতে বাংলা নাট্যচর্চার ইতিহাসে মাইলফলক হয়ে থাকবে । শিল্পীদের অভিনয় দক্ষতা, কোরিওগ্রাফি এবং নাটকের বক্তব্য হলভর্তি দর্শকদের নিয়ে যায় ১৯৭৮ সালের উত্তাল দিনগুলোতে। পূর্বনাটের অন্যান্য প্রযোজনার মধ্যে অন্যতম নাটক হলো সল্টি ওয়াটার এন্ড আস, জাহাজি অন্যতম। এই দশকে নাট্য নির্দেশক মুকিদ চৌধুরীর রচনা ও নির্দেশনায় মঞ্চে আসে নাটক কত রঙ্গ, অপ্রাকৃতিক প্রকৃতি ইত্যাদি ।

ভিনদেশে বাংলা নাটকের প্রায় ছয় দশকের গৌরবময় ইতিহাস। যা যুগে যুগে বিলেতে বাংলা সংস্কৃতি প্রসারের কাজ করে চলেছে। শত শত নাট্যকর্মী নতুন প্রজন্মের মধ্যে বাংলা সংস্কৃতি বিস্তারে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে যে সকল নাট্য গ্রুপ নিয়মিত মহড়া এবং নতুন প্রযোজনা মঞ্চে আনছে এর মধ্যে যুক্তরাজ্য উদীচী, মঞ্চ শৈলী, পূর্বানাট, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, দক্ষিণায়ন,আলপনা একাডেমি, সৌল ফায়ার থিয়েটার, এসেক্স ইন্ডিয়ান, উল্লেখযোগ্য। বিগত এক যুগ ধরে বিলেতে বাংলা নাট্যচর্চা এবং বাংলা নাটককে মূলধারার প্লাটফর্মে নিয়ে যাওয়ার জন্য সংগঠন গুলোকে নানা ভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন যিনি, তিনি হলেন টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের আর্টস অফিসার কাজী রুখসানা বেগম। যার আপ্রাণ চেষ্টায় প্রতি বছর এ সিজন অফ বাংলা ড্রামা উৎসবে আসছে বৈচিত্র্য।উৎসব আয়োজনের পাশাপাশি নানা ধরনের কর্মশালা আয়োজন করে বিলেতে বাংলা নাটকের দল গুলোর মান উন্নয়নের চেষ্টা করে যাচ্ছেন নিরলস ভাবে। সেই সাথে প্রণোদনার মাধ্যমে নাটকের দলগুলোর প্রোডাকশন ব্যয় সংকুলানের জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন যা বিলেতে বাংলা নাটকের ইতিহাসে অন্যতম স্বাক্ষর বহন করবে।

বিলেতে বাংলাভাষী মানুষের সংগ্রাম দেশের থেকে একেবারেই ভিন্ন। এইখানে ভিন্ন পরিবেশে জন্ম নেওয়া নতুন প্রজন্মকে নিজেদের শেকড়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সংগ্রামই হলো সবচেয়ে কঠিন সংগ্রাম। ইংল্যান্ড হলো পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, বহু সংস্কৃতির দেশ। এখানে বিশ্বের নানা দেশের নানা প্রান্তের মানুষের আনাগোনা। সেই সুযোগে বিশ্বজোড়া উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ এবং প্রোপাগান্ডার অংশ হিসাবে এখানেও নানা কৌশলে মগজ ধোলাইয়ের মাধ্যমে বাঙালি নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে। এহেনো বৈরী সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বিলেতে জন্ম নেওয়া প্রজন্মকে শিকড়ের সন্ধান দেওয়া। আমাদের গৌরবের গল্প গাঁথা তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই কাজটি রাজনৈতিক সচেতন সাংস্কৃতিক কর্মীদেরকেই করতে হবে। এক্ষেত্রে নাটক হতে পারে প্রধান উপজীব্য। তবে সবচেয়ে হতাশার বিষয় হলো বিগত ছয় দশকে বিলেতে বাংলা নাটকের ইতিহাসে নানা অর্জনের হয়েছে ঠিকই কিন্তু এখনো আমাদের নাট্যকর্মীরা বিলেতের মূলধারার নাট্যচর্চার সাথে তেমনভাবে নিজেদের সম্পৃক্ততা অর্জন করতে পারেন নি, ঠিক তেমনি নতুন প্রজন্মের সাথেও হয়নি আশানুরূপ সেতু বন্ধন। তবে সেদিন হয়তো খুব দূরে নয় যেদিন আমাদের নাট্যদল গুলো নিয়মিত মূলধারার থিয়েটারের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করবে।

নোনাজল সাঁতরে ভিন দেশের হাজারো বাঁধা বিপত্তিকে দুপায়ে দলে আমাদের অগ্রজ পূর্ব পুরুষরা পশ্চিমা অক্লান্ত পরিশ্রমে ব্রিটেনে নিজেদের যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভীত রচনা করেছেন। তাঁদের উত্তরসূরির বিলেতের মূলধারার পেশাদারি থিয়েটারের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলা নাটকের শৈল্পিক উপস্থাপনা দিয়ে বহুভাষী দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেবে।

অসীম চক্রবর্তী, যুক্তরাজ্য প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ