প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ৩০ জুন, ২০২০
সম্প্রতি "দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকিনা" শিরোনামে একটি রম্য কবিতা জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কারণ এই রম্য কবিতায় আমরা বাংলা ভাষীরা আমাদের আপোষের চেহারাটি দেখতে পাই। এই সেই আত্মকেন্দ্রিকতা; এই সেই শুধু নিজে ভালো থাকার ফুল-লতা-পাতা-দাদা যে শাসককে বারান্দা থেকে বন্দনা করেছে; কিন্তুর চোখের সামনে শাসকদলের সহমত ভাইয়ের হাতে মানুষ খুন হতে দেখে; যুবতীকে খুন হতে দেখে তবু বারান্দা থেকে নামেনি।
এই দাদা খুব ঠগি বান্ধব দাদা; সবার কাছে বড্ড ভালো থাকতে চান; প্লট-পদবী-পদক যদি জুটে যায়; তাই শত অন্যায় দেখেও চুপ করে থেকেছেন। পাড়ার মোড়ের পানের দোকানদার বারান্দার নীচ থেকে দাঁড়িয়ে আর্তনাদ করেছে; পার্টির ক্যাডাররা আমার কাছ থেকে চাঁদার নামে আমার সন্তানের মুখের খাবার তুলে দেবার টাকাগুলো নিয়ে গেলো; আপনি বারান্দায় বসে রবীন্দ্র রচনাবলী পড়ার ফাঁকে ফাঁকে দেখলেন; এই ঠগিতন্ত্রের নির্যাতন; তবু কিছুই বললেন না দাদা!
দাদা তখন মুখের মধ্যে বাতাস পুরে আকাশ বাণীর খবর পাঠকের মতো বলেন, দাদা আমি সাথে পাঁচে থাকিনা।
নিজেরটুকু বুঝে নেয়া এই দাদার স্ত্রী, শীর্ষেন্দুর "নামতে নামতে" উপাখ্যানে ক্ষমতাসীন দলের পাড়ার পাণ্ডার হাতে ধর্ষিতা হলে; সিঁড়িতে বসে কেঁদেছে; তবু প্রতিবাদ করেনি; ফলে রুলিং এলিটের শত বছরের কমফর্ট উইমেন হয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে হতভাগ্য নারীদের।
তবু দাদা চুপ করে থেকেছেন; নিজের টুকু বুঝে নিয়েছেন; ব্রিটিশ বন্দনা, কংগ্রেস বন্দনা, বাম ফ্রন্ট বন্দনা হয়ে তৃণমূল বন্দনাটুকু করে আজ বিজেপি ও শিবসেনা বন্দনায় কপালে "লাল টিপ" দিয়ে "এসো এসো সুরে করুণ মিনতি মাখা" লাস্যে বারান্দায় দাঁড়িয়ে মোদি বন্দনা করছেন। দাদা যে কারো সাথে পাঁচে থাকেন না। এই দাদা স্বদেশীর ছেলেদের, নকশালপন্থীদের ইশারা দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছেন; তবু উনি বারান্দা থেকে নামেননি।
এই ফুল ফল লতা পাতা দাদার নিষ্ক্রিয়তায় শয়তান জিতে গেছে; মানুষ হেরেছে বার বার।
এই দাদা কিন্তু আমাদেরও আছে। আপনার মনে পড়ে; একটি গান, এক লোক আর্তস্বরে বলে, ও মানুষ একটা মুখতো একটু কম কথা কবা।
এই "একটা মুখের কম কথা কবা" দাদাটি কিন্তু "সাথে পাঁচে থাকিনা দাদা"র চেয়েও বড় ঘুঘু। এই মালটি কিন্তু একটা অসহায় ফকিরের ভং ধরলেও; এ আসলে শাসকের বাতাবি লেবুর বাউল। স্বৈরশাসক এলিট ফোর্স দিয়ে গুম-হত্যা করে ভীতি সঞ্চার করে সবাইকে চুপ করিয়ে রাখতে গেলে; জাতিসংঘ জেনে যায়; ঐ ভূ-খণ্ডে এক নতুন হিটলারের পুনর্জন্ম হয়েছে। অথচ "একটা মুখ তো, কথা কম কবা" দাদাটিকে ডেকে বিরিয়ানি খাইয়ে; পকেটে কিছু টেকাটুকা গুঁজে দিলে; সে পরাজিত মানুষের ছদ্মবেশে চায়ের দোকানে বসে, বেশ একটু করুণ চেহারা করে গান ধরবে, "ও মানুষ তোমার দুইডে চোখে দেখে যাবা, দুইডো কানে শোনবা" কিন্তু "একটা মুখতো; কথা কম কবা।" এই লোক হচ্ছে সহমত ভাইদের গুরু।
এই "একটা মুখ তো কথা কম কবা" ভাইডি ব্রিটিশ-পাকিস্তানি উপনিবেশ হয়ে এরপর আওয়ামী লীগ-বিএনপি-জাতীয় পার্টি-জামাতের ক্রসফায়ার; ধর্ষণ, লুণ্ঠন দুই চোখে দেখে; দুই কানে শুনে; একটা মুখতো তাই চুপ থেকেছে। শুধুই চুপ থাকেনি; ককিয়ে ককিয়ে গান করে অন্যদের কৌশলে চুপ করিয়ে দিয়েছে।
পাকিস্তানি খুনেরা যখন নারীদের হিড় হিড় করে টেনে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করেছে; তখন একটা মুখতো তাই চুপ থেকেছে। বাংলাদেশ আমলে পূর্ণিমা-তনু-বাউফলের মা-মেয়েকে ক্ষমতাসীনের পাণ্ডার রিরংসার শিকার হতে দেখেও চুপ করে থেকেছে। ঐ যে একটা মুখতো।
চুপ করে সব কিছু মেনে নেবার কারণে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ; দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রতিবাদহীন এলাকা। সব কিছু মুখ বুজে মেনে নেবার অমানবিক ক্ষমতা এদের। এরা যে কোন পরিবর্তনকে ভয় পায়। "সাথে পাঁচে থাকিনা দাদু"-টি যেমন আম্পান ঝড়ের পরে কিছু বিরতি দিয়ে ইলেক্ট্রিসিটি এলেই খুশি।
এই সাথে পাঁচে থাকিনা দাদারা করোনাকালে গৃহকর্মীদের বিদায় করে দিয়েছে; বলেছে, করোনার পরে এসো। মাঝে গৃহকর্মী এসে সামান্য সাহায্য চাইলে, দাদা এবার মহাভারত কিংবা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিংবা বেহেশতের মেওয়া পড়তে পড়তে, তাকে শূন্য হাতে বিদায় করেছে; তবু বারান্দা থেকে নামেনি।
আর "একটা মুখ তো, কথা কম বলা" সহমত ভাইটির মেয়েটিকে ঢাকায় পড়তে পাঠালে; সে রাজনীতির বাবুদের জুড়ি গাড়িতে চড়ে পাপিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে; ছেলেটি ক্ষমতাসীনের ফুটসোলজার হয়ে, ফেনসিডিল খেয়ে চাঁদা তুলে বেড়ায়। পানের দোকানি এসে "একটা মুখ তো" সহমত দাদুটির কাছে তার ছেলের চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে, সে যাত্রার বিবেকের মতো বলেছে, "ও মানুষ মানুষ তোমার দুইডো চোখ শুধু দেখে যাবা; দুইডো কান শুধু শুনে যাবা; আর একটা মুখ তো কথা কম কবা।"
সে তারপর থেকে আর কথা বলে না, জাতির জনক খুন হলেও না; ত্বকী খুন হলেও না; চাপাতিতে ব্লগার খুন হলেও না; সাগর-রুনি খুন হলেও না; করোনায় গার্মেন্টস শ্রমিক মালিকের লোভের ভাইরাসের বলি হলেও না; পাট কল-বস্ত্র কল থেকে
নির্মম শ্রমিক ছাঁটাই হলেও না; মানুষকে তার মাতৃভূমি থেকে উচ্ছেদ করে দিলেও না। একটা মুখ তো কী করবে বেচারা! আবার "নিজেরটুকু বুঝে নেবার ব্যাপারও আছে"।
লুণ্ঠক ঠগির ইমেজ রক্ষায় ৫৭ ধারা কিংবা ডিজিটাল আইনে প্রতিবাদকারীদের ধরে নিয়ে গেলে, দাদাটি বারান্দা থেকে কেঁদে কেঁদে বলে, "ও মানুষ মানুষ।" এই ফকিন্নি মার্কা কণ্ঠস্বর হচ্ছে দাসত্বের; দাসখত লিখে দেবার দাস-দর্শন। জমিদারী রক্ষার পোষা পাখি এইসব গায়ক পাখিরা; ফেসবুকে লতা-পাতা-ফুল দাদারা আর "উনিই পারেন; উনিই পারবেন" সহমত ভাইয়েরা। বাংলাভাষী মানুষের পরাজয়ের ইতিহাস এই প্রতিকারহীন- প্রতিবাদহীন শক্তের অপরাধে; বিচারের বাণী আজ নীরবে নিভৃতে কাঁদে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য