আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

এইসব দিনযাপনের গল্প

আরিফ জেবতিক  

গত পরশুদিন (১১ আগস্ট) এক সামাজিক অনুষ্ঠানে গেছি। আমার স্ত্রী অফিস থেকে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে শেষ মুহুর্তে অনুষ্ঠানে ঢুকেছে। এই সময় এক ভাবি হেলতে দুলতে কাছে আসলেন, তারপর অবাক হয়ে বললেন, ‘ওমা, তোমরা না দেশে ছিলে না, ফিরলে কবে?’ তারপর জবাবের অপেক্ষায় না থেকেই উনার স্বামীর রেফারেন্স দিয়ে বউকে বললেন, ‘বুঝছ, জুবের বলেছে লিস্টে ১০ নম্বরে আরিফের নাম আছে-এবার তাকে মারবে।’



ভদ্রমহিলার চোখ আনন্দে চকচক করছে। উনার নিজের স্বামী একজন জ্ঞানী লোক, কে কখন মরবে সে ব্যাপারে আগাম ধারণা নিয়ে বসে আছেন, অন্যদিকে আমার বউয়ের স্বামী একজন অভিশপ্ত লোক, মৃত্যুর পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখন সিরিয়ালে তাঁর নাম উঠে আসবে! ভদ্রমহিলার এই আনন্দ দেখে আমি মুগ্ধ। আমার বউয়ের মুখ কালো হয়ে গেল।
-তো, এই হচ্ছে জীবনযাপন।



এই বিকৃত আনন্দলোভী মানুষের বাইরেও অসংখ্য স্বজন আছেন- যারা সত্যিকারের উদ্বেগ নিয়ে বারবার বলেন, ‘চলে যাও, সরে যাও।’ মানুষের ভালোবাসা পাই অযুত-২০১৩ সালে যখন ব্লগার গ্রেফতারের জোশ এলো, তখন অনেক দূরের মানুষও ভালোবেসে আশ্রয় দিতে চেয়েছেন।
কামরাঙিচরের এক ফেসবুক বন্ধু তাঁর একটা ঘর খালি করে রেখেছিলেন, নতুন মোবাইল সেট-সিম আর কাপড়চোপড় কিনে রেখেছিলেন সেই ঘরে-সেই ঘরে আমার কখনোই যাওয়া হয়নি, তবে ‘চলে যাও, সরে যাও’ শুনলেই সেই ঘরটার কথা মনে পড়ে-আমি কল্পনায় দেখি।



প্রতিদিনকার রুটিনে অনেক বদল আনতে হয়েছে এটা ঠিক-জগিং করতে পারি না আর-বাচ্চাকে স্কুলে নামিয়ে দেন বাচ্চার বন্ধুর পরিবার; বাসার গেটে সিসিক্যাম, দরজায় পিপহোল, নিরাপত্তা শেকল, একাধিক ভারি লোহার সিটকিনি। তবে কেউ মেরে ফেলতে চাইলে এসব কোনো সতর্কতাই আসলে কাজে আসে না, বড়জোর বিষয়টাকে খুনিদের জন্য কঠিন করে তোলা যায় মাত্র।



এই দেশে চাইলে যে কেউ যে কাউকে মেরে ফেলতে পারে-কোনো কঠিন বিষয় না এটি। সাতচক্রে না পড়লে ধরা পড়ারও কোনো ভয় নেই। সীমা লংঘনকারীকে সরকার আর আইজিপি মহোদয় ভালোবাসেন না, সীমা হচ্ছে বেঁচে থাকার সীমা, নিজ দায়িত্বে বেঁচে থাকতে পারলে ঠিক আছে, মরে গেলেই তুমি সীমা লংঘন করলে।



এই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-সতর্কতা আমাকে ভীত করে না। আমি উপভোগ করি। আমি জানি আমার এই সম্ভ্যাব্য মৃত্যুদণ্ড শুধু একটাই অপরাধে-আমি একাত্তরের ঘাতকদের ফাঁসি চেয়েছিলাম। আমি আমার দেশকে ঘাতকমুক্ত একটি দেশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলাম। এই ‘অপরাধে’ আমার ছবি পত্রিকায় ছেপেছে মাহমুদুর রহমান, আমার ছবি নিয়ে মিছিলে করেছে হেফাজতে জামায়াত, আমাকে নিরন্তর গালিগালাজ করে চলে অনলাইনে অনেকগুলো গ্রুপ।



উচ্ছিষ্ঠলোভী মহাজোটের বিচিদলগুলোর অনলাইন সমর্থকরা তো একেবারে সংবাদ সম্মেলনও করে বসল।
আমার কোনো ব্যক্তিগত অপরাধ নেই, আমার অপরাধ আমি একটা সংগ্রামের মিছিলের পেছন পেছন হাঁটছি।
আমি খুব সাহসী লোক নই, তবে আবার ভীতও নই।



আমি নেতা হতে আসিনি, আমার চাওয়া বিক্রি করে বড়কিছু হতে আসিনি। এটা আমার ব্যক্তিগত চাওয়া, আমি আমার চাওয়ার জন্য আমি সব অপবাদ-অপমান-হুমকিকে মাথা পেতে নেই। এসব আসে, কারন আমাদের সম্মিলিত কাজ ম্যাটার করে। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘জন্মেছিস যখন, দাগ রেখে যা।’ আমার কাজে যদি কোথাও ক্ষীন কোনো দাগ পড়ে, আমি খুশি।



গতকাল (১২ আগস্ট) সিলেট থেকে কোনো এক মূর্খ বিডিনিউজে একটা হত্যার হুমকি দেয়া লিস্ট পাঠিয়েছে। সেই লিস্টে নিলাদ্রীর পরেই আমার নাম। নিলাদ্রী খুন হয়েছে, সুতরাং এবার সিরিয়ালে আমি। মাসিক কোটায় হত্যা হয়ে থাকলে আমি হয়তো আরো একমাস টিকে আছি মাত্র।



আমি মনে করি না যারা খুন করে, তারা লিস্ট দিয়ে বেড়ায়। এসব লিস্ট বানায় আলুপোড়া খানেওয়ালা মহল। কেউ কেউ হয়তো জাতে উঠতে নিজেরাই লিস্ট বানায়, সেই লিস্টে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নাম ঢুকিয়ে দেয় লিস্টের বৈধতা দেয়ার জন্য। অন্য কোনো ধান্দাও থাকতে পারে, আমার জানা নেই।



কিন্তু এই লিস্ট প্রকাশিত হওয়ার পরে উদ্বিগ্ন স্বজনরা আবারও বলা শুরু করেছেন, ‘চলে যাও দেশ ছেড়ে, প্লিজ চলে যাও।’



লিস্ট ভূয়া হতে পারে, কিন্তু অকাল মৃত্যু সম্ভাবনা কোনো ভূয়া বিষয় নয়।
এই সম্ভাবনার হুলিয়া মাথায় নিয়েই আমাকে চলতে হয়।
তবু-
হে প্রিয় স্বজনেরা, আমি দেশ ছাড়ছি না।
না, কোনো ছাগলের শিং নাড়ানোকে ভয় পেয়ে আমি আমার দেশ ছেড়ে যাচ্ছি না।



যতক্ষণ আমাদের সমবেত কাজ ম্যাটার করতে থাকবে, আমি আমার কলমের গুটিগুটি শব্দে সেই কাজে রসদ জোগাতে থাকবই।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখুন-
আপনাদের মিছিলের একেবারে শেষ সারিতে চুপচাপ হেঁটে যাওয়া মানুষটা আমি।
কারো জন্য নয়, আমার নিজের জন্য, আমার নিজের দেশ আর সন্তানের জন্য সেই মিছিলে আমি হাঁটি, মরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি ওভাবেই হেঁটে যাব।

আরিফ জেবতিক, ব্লগার ও সাংবাদিক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ