আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

দুর্নীতিচক্র

মাসকাওয়াথ আহসান  

দক্ষিণ এশীয় সমাজে ঘুষ দুর্নীতি কোন নতুন ব্যাপার নয়। একটা মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সময় পাত্রকে সাইকেল-ঘড়ি ঘুষ দিয়ে তবে সে সম্পর্ক শুরু করা হতো। বিবাহ নামের প্রতিষ্ঠানে এই ঘুষের নাম দেয়া হয়, যৌতুক। এই যৌতুক ক্রমেই কন্যাপক্ষের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়ায়। পাত্রপক্ষ ক্রমে স্বর্ণালংকার, টেকাটুকা, জমি-জিরাত ঘুষ চাইতে শুরু করে। এই ঘুষ না দিতে পারলে শ্বশুরবাড়ির সেইফ হাউজে সাদা পোশাকের শাশুড়ি ও ননদেরা পাত্রীকে প্রহার করতে শুরু করে। ঘুষ না দেয়ার অপরাধে অনেক পাত্রীকে ফেরত পাঠানো হয় বাপের বাড়িতে। ঘুষ দিতে না পেরে অনেক পাত্রী আত্মহত্যা করে।

অন্যদিকে ঠিক বিয়ের দিনে পাত্রীর ভাইদের সংগঠন শ্যালকলীগ হেলমেট ও হাতুড়ি নিয়ে বিবাহ-বাড়ির প্রবেশ পথে পাত্রের কাছে ঘুষ বা চাঁদা দাবি করে। সেই ঘুষ নিয়ে প্রবেশের পর, পাত্র জুতা খুলে বিবাহমঞ্চে বসলে, হবু শ্যালিকালীগের সদস্যারা সেই জুতা লুকিয়ে আবার চাঁদা দাবি করে। ফলে বিবাহ নামের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঘুষ ব্যাপারটা ঐতিহ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।

বিবাহোত্তর সন্তানাদির জিনপ্রবাহে ঘুষের কুলু কুলু চাওয়া ছড়িয়ে পড়ে অনায়াসে। তাই দুর্নীতি দক্ষিণ এশীয় জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ; এ বিষয়ে কোন দ্বিমত নাই।

ব্রিটিশেরা টোপর পরে পাত্র হিসেবে সরকারি অফিসে বসা মাত্র কলাটা-মুলোটা নিয়ে শ্যালক সাহেদ-শামীমেরা "ব্রিটিশ দুলা কলা খাবা" গান গাইতে গাইতে পৌঁছে যায়। এই ঘুষের বিনিময়ে সাহেদ-শামীমেরা হাটে-মাঠে-ঘাটে চাঁদা তোলার সরকারি লাইসেন্স নিতে শুরু করে।

পাকিস্তান আমলে সেই একই ধারা অব্যাহত থাকে সরকারি অফিসে। ঘুষের অংক কলা থেকে রুপিতে রূপান্তরিত হয়। এসময় এই ঘুষের টাকায় ঢাকার ধানক্ষেতগুলো কিনতে শুরু করে সরকারি কেরানিরা। ঢাকায় একটি বাংলো হয়ে গেলে; তখন তো কেরানি শব্দ থেকে 'কে' কেটে দিয়ে রানি হয়ে বসে সরকারি কর্মচারীর স্ত্রী। সন্তানাদি, রাজকন্যা ও যুবরাজ হয়ে পড়ে। ইংলিশ ভিংলিশ শিখে কেরানির ছেলেমেয়েরা ঘোষণা করে, আমরা ইংলিশ কইতে পারি; সুতরাং আমরা এলিট।

সেই থেকে ঘুষের বিনিময়ে এলিটিজম স্বপ্ন হিসেবে সমাদৃত হয়। যারা ঘুষ দিয়ে সরকারি সরবরাহের কাজ নিতে শুরু করে; তারা সরকারি ভুয়া বিল বানানোর কাজটি নীরবে-নিভৃতে করতে শুরু করে। পাঁচ টাকার বদনার দাম ৭ টাকা দেখিয়ে ১ টাকা কেরানিকে ঘুষ দিয়ে ১ টাকা লাভ নিয়ে যেতে শুরু করে ঠিকাদারেরা। ঠিকাদারের স্ত্রীরা ঠিক করে, ঠিকাদার শব্দটি সুন্দর নয়; আমরা বরং কিছু জমিজমা কিনে নিজেদের জমিদার ডাকতে শুরু করি। সেই থেকে 'জমিদার' শব্দের যত্রতত্র ব্যবহার শুরু হয়। কোন দক্ষিণ এশীয় পশ্চিমে গেলে উপযাচক হয়ে বলে, আমার দাদা জমিদার ছিলো।

ঘুষ ব্যাপারটা কলা ও টাকা থেকে এরপর পদের দিকে চলে যায়। কেরানি এলিট কিংবা ঠিকাদার জমিদারের জামাই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হইলে কিংবা রাষ্ট্রদূত হইলে মান বাড়ে। তাই ঘুষের বিনিময়ে শিক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতির বারোটা বাজানো শুরু হয়ে যায়।

এরপরেও ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে যে শিক্ষাটুকু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দেয়া হতো, তা ঘুষ-দুর্নীতির ব্যাপারে একটা রাখ-ঢাক মেনে চলতো। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দলে দলে এলিট ও জমিদার হওয়ার বাসনা লম্ফ দিয়া ওঠে। বাংলাদেশের জাতির জনক একে 'চোরের খনি' বলে অভিহিত করেন। ভারত-পাকিস্তানের জাতির জনকেরা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে লোভের খনি ও ক্ষুদ্রমনের জনপদ বলে অভিহিত করেছেন নানা উদ্ধৃতিতে।

গণতন্ত্রের মাধ্যমে ৩০০ জমিদার তৈরির পাশাপাশি ঘুষ দুর্নীতির ক্যাসিনো চালু হয়। চাঁদা তোলার ম্যান্ডেট যেন এক একটি ক্ষমতাকাল। জনগণ সামান্য ঘুষ খেয়ে এমন লোককে ভোট দেয়, যে নির্বাচিত হয়েই বলে, মোরে আরও ঘুষ দাও আরও। ঘুষ শব্দটিকে কমিশন শব্দের মাস্ক পরিয়ে দেয়া হয় শ্রুতি মাধুর্যের কারণে। এতে করে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে শুরু করে নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন; সবই কমিশন খাওয়ার ক্যান্টিনে পরিণত হয়।

ফলে বেছে বেছে দুর্বল ছাত্রদের দলীয় সবল ক্যাডার হিসেবে পদায়িত করার মড়ক লেগে যায়। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে ওঠে অর্ধ-মূর্খের স্বর্গ।

অবস্থা এমন দাঁড়ায়, সরকারি সরবরাহ ও ক্রয়ের ভুয়া বিল বানানোর ক্ষমতা লোপ পায় কেরানি ও ঠিকাদারদের মাঝে। বালিশ,পর্দা ইত্যাদির এমন ভুয়া বিল বানায় তারা যে লোকে হাসাহাসি শুরু করে। ভাবখানা এমন যে চারশো টাকা দামের বটির মূল্য দশহাজার টাকা দেখিয়ে, কেরানি ও ঠিকাদার সমস্বরে গান গায়, তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার বটি চাই।

এর পাশাপাশি রাখ-ঢাক করে, লুকিয়ে চুরিয়ে জাল ভোট দিয়ে প্রার্থী জেতানোর গণতন্ত্রে রিটার্নিং অফিসাররা কৌশলে ভোটের ফলাফলের ফর্ম পূরণেও অক্ষম হয়ে পড়ে। এমন সব ফলাফল রচনা করে, যা দেখলে কোলের শিশুও খিল খিল করে হেসে উঠবে। দেখা গেলো একটি কেন্দ্রে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যায়, নুকা পেয়েছে ৩ হাজার ভোট; আর হিসাবের সুবিধার জন্য দানের শিস আর পাংক্ষা পেয়েছে ০ ভোট। কেন্দ্রের নাম অক্সফোর্ড স্কুল। ভোটের পর থেকে লোকে একে বলে ফক্সফোর্ড। অতীতে নুকা দেড় হাজার, দানের শিস এক হাজার, পাংখা পাঁচশো; এরকম বিশ্বাসযোগ্য ভুয়া ফলাফল পত্র বানানোর ব্যুৎপত্তি জনপ্রশাসনে ও জলপাই নিবাসে ছিলো।

কৌশলে চুরি করার ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি বুদ্ধি বাংলাদেশকালে লোপ পায়। শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্রমাগত অবহেলা করায় দুর্নীতির গুণগত মান লোপ পায়। ঠিক কত টাকা হলে জীবনটা চলে যায়; এই ধারণা করার মতো কমনসেন্স না থাকায় কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বশ্রেষ্ঠ হয়ে পড়ে। অবশ্য একবিংশ শতকে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে লাগাতার চার বার শ্রেষ্ঠ দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্রের ট্রফি নিয়ে।

অন্ধ সেকেন্ড হোমারেরাও বিদেশে টাকা চুরি করে নিয়ে গিয়ে পড়ালেখায় দুর্বলতার কারণে পশ্চিমা সমাজে হাসি ও খাসি হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ইতিহাসঘন গল্পে, পূর্ববঙ্গের জমিদারকে কলকাতা ভ্রমণে সরলতা বশত আনন্দগৃহে গিয়ে সরলা দেবীর চরণে অনেক টেকাটুকা অর্ঘ্য দিয়েও; সরলা খুশিজলের গ্লাসে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়ে; কীসের ইন্দ্রিয় সুখ; নাক ডেকে ঘুমিয়ে পড়ে জমিদার বাবু। সরলাদেবীর চ্যালারা তাকে গঙ্গাধারে ফেলে দিয়ে এলে ভোরের হাওয়ায় জমিদার বাবুর ধুতি উড়ে অহম উন্মুক্ত হয়ে যায়।

এই একই কাণ্ড হলো সেকেন্ড হোমারদের নিয়ে; এরা ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, দুবাই, ইউরোপ, ক্যানাডায়; ইস্ট ইউরোপ আর চীনা সরলাভস্কি ও সরলা ইয়াং-এর করকমলে ডলার নিবেদন করলে; ইন্দ্রিয় সুখ তো দূরের কথা সরলা কেইজের ল্যাপড্যান্সের উদ্দামতায় আর খুশিজল পেলেই উটের মতো পান করে কুজে জমিয়ে রাখার অভ্যাসে; ভোর বেলা নিজেকে আবিষ্কার করে হ্যান্ডকাফ বাঁধা অবস্থায়।

শিক্ষা-ব্যবস্থায় অবহেলার কারণে দুর্নীতি, ভোট চুরি, টাকা পাচার করে ভোগ; এর কোনটাই সুচারুরূপে সম্পাদন সম্ভব হচ্ছে না। ইউনিভার্সিটি অফ করাপশন এন্ড কমনসেন্স প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাই; সেন্সিবল দুর্নীতি স্নাতক গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ