প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ২৬ জুলাই, ২০২০
বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানে মিসিং পারসন বা গুম হয়ে যাওয়া একটি নির্মম বাস্তবতা। একবিংশ শতকে এ নৃশংসতা সত্যিই মেনে নেয়া কঠিন। ঢাকা-নতুন দিল্লি-করাচী প্রেসক্লাবের সামনে যখন কোন মাকে 'গোয়েন্দা সংস্থা'র তুলে নেয়া সন্তানের ছবি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি; প্রকৃতপক্ষেই মনে হয়; ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়; স্বাধীনতা শব্দটি বৃথা গেছে। মাঝে মাঝে ভ্রম হয়, উনি কী দ্রোহী মঙ্গলপান্ডের মা; যে মঙ্গলপান্ডে ১৮৫৭ সালে দিল্লির ক্ষয়িষ্ণু বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের পক্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন।
ব্রিটিশ গোয়েন্দা ও সেনারা মঙ্গলপান্ডের সঙ্গে যেমন নৃশংস হয়েছিলো; বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের গোয়েন্দা ও সেনারা যদি একই রকম নৃশংস আচরণ করে স্বাধীন দেশগুলোর নাগরিকের সঙ্গে; তাহলে স্বাধীনতা-মানবাধিকার মিথ্যা হয়ে যায়।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুনে পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তোমরা আমরা ভাই; ভাই হয়ে ভাইয়ের বুকে গুলি চালিও না।
তরুণ বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন। হিন্দু-মুসলমান ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অপশাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মানুষ হিসেবে, পাকিস্তানের শাসক-সেনার মধ্যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ভুত দেখে বিপন্ন বোধ করেছিলেন তিনি। তাই উনি বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, ভাই হয়ে ভাইয়ের ওপর গুলি চালিও না। জনগণের পয়সায় কেনা বুলেট কেন জনগণের শরীরে বিঁধবে; এই নারকীয় হননযজ্ঞের কোন যৌক্তিকতা খুঁজে পাননি তিনি।
এই 'ভাই' শব্দটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা অভিনন্দন বিমান ভেঙ্গে পাকিস্তানে গ্রেফতার হলে; ভারত-পাকিস্তানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে 'অভিনন্দন'-কে বাঁচানোর জন্য মানুষের সামষ্টিক কণ্ঠস্বর শুনে 'ভাই' শব্দটি অনুরণিত হতে থাকে। এই দক্ষিণ এশিয়া যেখানে ব্রিটিশের কলমের খোঁচায় বিখণ্ডিত আত্মীয়তায় তছনছ হয়ে গেছে কোটি কোটি মানুষের জীবন; সেখানে এ কোন আত্মবিনাশী ক্রিয়াকলাপ।
এই উপমহাদেশের অধিকাংশ মানুষের আত্মীয় স্বজন দেশগুলোর সামরিক বাহিনীতে কাজ করে। অনেকেরই তিনটি দেশের সামরিকবাহিনীতে চাচাত-ফুফাতো-খালাত-মামাত ভাই আক্ষরিক অর্থেই এখনো কাজ করে। এই তিনটি দেশের যে কারো বিরুদ্ধে আরেকদেশের যুদ্ধে রণাঙ্গনে ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাই-বন্ধুর বিরুদ্ধে বন্ধু লড়ে।
এরকম পরাবাস্তব ঘটনা দেখে বিস্মিত হই। আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণে, জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগ দিতে গিয়ে এই তিনটি দেশের সামরিক কর্মকর্তারা অবসর সময় একসঙ্গে কাটায়। সীমান্তে ফ্ল্যাগ মিটিং কিংবা সমুদ্রে বিরোধ নিষ্পত্তি মিটিং শেষে এরা উষ্ণ সময় কাটায়। সীমান্তে-সমুদ্রে দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের যন্ত্রণায় রাখাল বালক কিংবা জেলে সীমান্তের দিশা হারিয়ে গ্রেফতার হওয়ার ঘটনায় বিষণ্ণ হয় এদের অনেকেই।
এক ভারতীয় অগ্রজপ্রতিম সাংবাদিক বলেছিলেন, পাকিস্তানিদের যে ভারতীয়রা পাকি বলে গালি দেয়; লন্ডনে ট্রামে আমাকে একবার হোয়াইট সুপ্রিমিস্টরা পাকি বলে গালি দিয়েছিলো। ঠিকই আছে; আমার চেহারায় তো লেখা নেই যে আমি ভারতীয়।
সামরিক বাহিনী অত্যন্ত সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান। মেধা-শিষ্টাচার পরীক্ষা করে তবে তরুণদের এই বাহিনীতে নেয়া হয়। দলীয় প্রভাবমুক্ত এই নিয়োগ থেকে আরও ভালো ফলাফল প্রত্যাশিত ছিলো।
দশজন সামরিক কর্মকর্তার গ্রুপে একজন উচ্ছৃঙ্খল ও উচ্চাভিলাষী কর্মকর্তা থাকে। ঐটাই ইয়াহিয়া হয় কিংবা টিক্কা খান হয়। ফলে বাকিরা কত ভালো মানুষ ছিলেন; কতটা সৎ ছিলেন; এ আর খুঁজে দেখে না মানুষ।
সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনমানুষের সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। এখন এমেরিকান ও ব্রিটিশ সামরিক কর্মকর্তারা নাগরিক সমাজে অনায়াসে মেলামেশা করে। ইতালির সেনা কর্মকর্তারা পর্যটক শিশুর হাতে খেলনা তুলে দেয়। সামরিক বাহিনীতে শুধু অস্ত্রের মানুষ নেই; কবিতার মানুষও রয়েছে। সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সৃজনশীল কর্মকাণ্ডকে সামনে নিয়ে আসতে হবে। কেন একজন চিত্রকর সেনা কর্মকর্তা বলেই তার চিত্রকলা প্রদর্শনী হবে না। তিনটি দেশেরই সেনা অতিথি ভবনে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আঁকা একটি দুটি পেইন্টিং ঝুলতে দেখা যায়।
আমার মনে পড়ে, রাজশাহী কলেজে যে অগ্রজ প্রতিম হকি মাঠের কাঠের গ্যালারিতে বসে গিটার বাজিয়ে গান করতেন; তিনিই পরে গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা হয়েছিলেন। কিংবা বিষণ্ণতার শহর লেখার কালে একদিন ভোর বেলা এক অগ্রজ প্রতিমের ফোন পেয়েছিলাম সেনা সদর দপ্তর থেকে, ফোন করে বললেন, আমি ক্যাডেট কলেজে তোমার সিনিয়ার ভাই ছিলাম, আমি তোমার বিষণ্ণতার শহরের ভক্ত হয়ে গেছি। কিংবা সেনাবাহিনীর অনুজপ্রতিম কোন খোলা ছাদে বসে যখন সুনীলের 'কেউ কথা রাখেনি'-র বরিশাল ভার্সান শুনিয়েছিলো; কিংবা বিদেশ বিভূঁই-এ প্রশিক্ষণে এসে ' বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে ' আমার একটা দু'মিনিটের বক্তৃতা শুনে যখন অশ্রুসিক্ত হয় কোন সামরিক বাহিনীর অনুজপ্রতিম; তখন আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে; স্বপ্নের মতো মনে হয়।
বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়; কখনো কোন খলনায়কের নির্দেশে এই অনুজপ্রতিম আমাকে মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে গিয়ে গুম করে দেবে। জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে ইলেকট্রিক শক দিয়ে জিজ্ঞেস করবে, কেন সরকারের সমালোচনা করিস; তুই কী আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি, ভারত নাকি পাকিস্তান!
ভাইয়ের হাতে মৃত্যুতে আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ থাকবে না; দুঃখ হবে খুনির জন্য; যাকে প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ববাদী আচরণ একজন শিল্পী থেকে হিটলারে পরিণত করেছে; মানুষ থেকে খুনি বানিয়েছে।
এটা একটা ভুল চিন্তা যে পুলিশ কিংবা সামরিক বাহিনীতে গেলে খুনি হতে হয়। একবিংশ শতকে 'যুদ্ধের চেয়ে যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া অধিক সামরিক দক্ষতা', 'খুন না করে জীবন বাঁচানোতে' পুলিশ কিংবা সেনা জীবনের সার্থকতা। জাতিসংঘের শান্তি মিশনে কাজ করেছেন যারা; তারা খুব সম্ভব 'ইউনিফর্ম পরা জীবন'-এর সাফল্যের সঠিক সংজ্ঞাটি জেনেছেন।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য