প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ০৩ আগস্ট, ২০২০
ক্রিকেটার মুশফিককে নিয়ে শিবির ও শিবসেনার টানাহ্যাঁচড়াটি খুব রসঘন একটি কেসস্টাডি।
মুশফিক অত্যন্ত ভালো ক্রিকেটার। শিক্ষিত হওয়ায় সে যখন ক্যাপ্টেন ছিলো তখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তার কথা-বার্তা ছিলো সাবলীল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই একই সঙ্গে ক্রিকেট আর লেখাপড়া চালিয়ে গেছে সে।
মুশফিকের বাবা খুব প্রাণবন্ত মানুষ। এতো প্রাণপ্রবাহ তার মাঝে; যা থেকে বোঝা যায়; মুশফিকের সাফল্যের পেছনে এই ইতিবাচক মনোভঙ্গি খুব কাজে দিয়েছে। কিন্তু ভদ্রলোকের দাড়ি-টুপি আছে। এই চিহ্নটিকে শিবসেনা চিহ্নিত করেছে "জামাত-শিবির" হিসেবে; আর শিবির "দাড়ি-টুপি"-কে তাদের দলীয় জার্সি বলে মনে। ফলে খেলার মাঠে মুশফিকের বাবার আবির্ভাবের পর থেকেই; মুশফিককে শিবসেনারা মৌলবাদী হিসেবে চিত্রিত করতে চেষ্টা করে। অন্যদিকে শিবির অনেকদিন পর তাদের মনপছন্দ আইকন ভেবে মুশফিককে আপনা মানুষ বলে মনে করে।
মুশফিক কিন্তু ব্যস্ত তার ক্রিকেট নিয়ে আর জীবনটা তার বাবার মতো আনন্দে কাটাতে। ক্রিকেটের সঙ্গে রাজনীতি মেশানোর যুগে মাশরাফি আর সাকিব যখন লীগের নয়নের মণি হয়ে ঘুরছে; মুশফিক তখনো ক্রিকেটের "ইনোসেন্সের জগত"-এ মিসফিট এক নির্দলীয় মানুষ। কারণ যে ছেলে একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট চালিয়ে যেতে পেরেছে; তার তো আর সহমত ভাই হবার দরকার নাই।
মুশফিক নির্দলীয়; নির্দলীয় মানুষের এই পাতকুয়া সমাজে সমস্যা হচ্ছে; সে সারাক্ষণ দলীয় শেয়ালদের টানাহ্যাঁচড়ার মাঝে থাকতে হয়। ফলে সহমত ভাইদের চক্ষুশূল হয়ে পড়ে সে। সহমত ভাইয়েরা সহমত ভাইদের মধ্যে যারা ক'টা সার্টিফিকেট নিয়ে আর ক্রিকেট জার্সি পরে ক্রিকেট মাঠে সেলফি খিঁচে একটু দেশপ্রেমিক ভং ধরেছে, তারা চেতনার চেকপোস্টে মুশফিককে যাচাই-বাছাই করে বলে দেয়, মুশফিক পাইক্কা পিলিয়ার গো লগে মিইশা ছাগু হইয়া গেছে গিয়া। এতে ভীষণই খুশি হয়ে, শিবসেনার প্রগতিশীল উইং-এসে ঠোঁট টিপে হেসে বলে, ওর সাহস দেখুন শচীন-কে আইকন না বানিয়ে ওয়াসিম আকরামকে আইকন বানিয়েছে।
শিবির এটা দেখে আশার আলো দেখতে পায়। কিন্তু ফেসবুকে ওয়াসিম আকরামের অস্ট্রেলীয় স্ত্রীর ছবি দেখে, চরম আঘাত পায় মনে মনে, পর্দা-পুসিদা নাই। ইসলাম গেলো গেলো বলে দীর্ঘশ্বাসে সময় গুজরান করে। তবে মুশফিক খেলার মাঠে সিজদা দেওয়াতে বুকে একটু বল পায়।
মুশফিকও কম নয়; সে শিবসেনা ও শিবিরদের লেজে খেলাতে থাকে। নিজের জার্সির বাঘের মুখ স্কচটেপ দিয়ে ঢেকে দিয়ে খেলার মাঠে নামে। শিবির আনন্দে আত্মহারা হয়। "দ্যাকো নুমাজ পড়িবার জন্য সে বাঘের ছবি ঢাকিয়াছে।"
প্রগতিশীলেরা এসময় ফেসবুকে নামে, প্রথম প্রজন্মের সেকুলার বিদ্যা নিয়ে। বাপ-মা পূজো-আর্চা করে বাড়িটাকে মন্দির বানিয়ে ফেলেছে; তাতে কী সে তো বড্ড সেকুলার রূপালী আপ্পি হয়েছে। রূপালী আপা মুশফিকের এই বাঘের মুখ স্কচটেপ দিয়ে ঢেকে দেয়ার মধ্যে রীতিমত মিনি পাকিস্তান দেখে ফেলেন।
শীর্ষ খেলোয়াড়দের রাজনীতি করে বেড়ানোর দক্ষযজ্ঞে ক্রিকেট টিমের পারফরমেন্স যখন বেড়ালের মতো; তখন অমন বাঘের ফটো নিয়ে মাঠে নামাটা কতোটা হাস্যকর; এ সমাজ বেড়াল-সমাজ, অনেক দিন ধরে বাঘের মুখোশ পরে ঘুরছে। মুশফিক যে কারণেই তার জার্সিতে বাঘের মুখ ঢেকে দিক না কেন! এটা একটি প্রতীকী কাজ হয়েছে। করোনাভাইরাস এসে এই বাঘ সেজে বসে থাকা বেড়ালপুরটিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
মুশফিক নিও-সেক্যুলারদের সমালোচনার মুখে সিদ্ধান্ত নেয়, ঝুঁকি দেখিয়ে পাকিস্তানে ক্রিকেট খেলতে না গেলে বুঝি; শিবসেনা প্রগতিশীল দাদারা তাকে আবার আদর করে কোলে তুলে নেবে। মুশফিকের পাকিস্তান সফরে না যাওয়ায় রূপালী আপা, ফেসবুকে নেবে এসে বলে, ওটা তো জঙ্গিবাদ আর বোমা হামলার জায়গা; ঐখানে কেডায় যাইবো! হালার পাইক্কারা আর মানুষ হইলো না।
মুশফিক পাকিস্তানে না যাওয়ায়; শিবিরের লোকেরা কেন্দে জারে জার হয়; পাকিস্তানে কেউ পুছে না; কিন্তু শিবির আগবাড়িয়ে পাকিস্তানের গলা জড়িয়ে ধরতে চায়। এক অর্থে অনাথ এরা; যে পাকিস্তানের জন্য কেন্দে মরে; সেইখানে কেউ পাত্তা দেয় না শিবিরদের। জামায়াতের দেউটি নিভে গেছে পাকিস্তানে; 'অনুভূতিপুরে'র শিবির তা জানে না; সে তো শিবসেনার মুখে জ্বলন্ত জঙ্গিল্যান্ড পাকিস্তান সম্পর্কে শুনে জেহাদি জোশে পাকিস্তান পাকিস্তান বলে জপ করছে। শিবসেনাই এখন "জঙ্গি পাকিস্তানকে বাঁচিয়ে রেখেছে দুই নয়নের জলে"।
উল্লেখ্য যে এই "অনুভূতিপুরের শিবসেনারাও" অনাথ; ভারতে গিয়ে কারো পাত্তা পায়না। এতো বড় দেশ; সেইখানে এমনিতেই শিবসেনার সংখ্যা এখন ভরপুর" অন্য দেশ থেকে শংকর শিবসেনা এলে বোঝার ওপর শাকের আঁটি হবার দশা হয়। আর কলকাতার উদারপন্থী মানুষেরা এতো ঋজু যে, কারো মুখে সাম্প্রদায়িকতার বচন" পেলেই তার কাছ থেকে শতহাত দূরে থাকেন তারা।
মুশফিক খেলার মাঠে নাগিন ডান্স নিয়ে এলে; ঐ একবারই শিবির-শিবসেনার মনে একসঙ্গে দোলা দিয়েছিলো। এরা "বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না" ছবির দর্শক; ফলে মুশফিকের নাগিন ডান্সটিই সবচেয়ে সফল সমাজ গবেষণা। এটা সর্প-রুচির সামষ্টিক সমাজকে ভীষণ দোলা দেয়।
এইসময়টাতে দেশের পাওয়ার প্ল্যান্টে নাগ-নাগিনীর খেলা চলছিলো। দেশের টাকা লুট করে বিদেশে পাচার ও সেকেন্ড হোম বানানোর সাপেরা কিলবিল করে ক্ষমতার রঙ্গভবনে। ফলে মুশফিকের নাগিন ডান্স সেই বাস্তবতার প্রতীকী রূপায়ণ; এমন অনুসিদ্ধান্ত টানা ভুল হবে না।
সম্প্রতি মুশফিক কোরবানির ঈদে কোরবানির তলোয়ার নিয়ে একটি ছবি দিয়ে "ঈদুল শিবসেনা"-র সূত্রপাত করে। রূপালী দিদি এমন ছ্যা ছ্যা করে ওঠেন; যেন এই খুন-ধর্ষণ-নৃশংসতার সমাজে মুশফিক একেবারে মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেছে। মডার্ন আপারা নতুন নতুন আধুনিকতার জ্ঞান পায় ভারী আপার মুখ থেকে কিংবা "ফেসবুকে জুমচাষ ফলনে "আধুনিক হইবার ১০১টি সহি উপায় ভালোচনাগুলোতে।" যে "সাতে পাঁচে থাকিনা দাদা, ৫৭ ধারা ও সাইবার আইনে অন্যায় গ্রেপ্তার, গুম, ক্রসফায়ারের সময় বারান্দা থেকে নামে না; সে-ও বারান্দা থেকে নেমে এসে বলে, মুশফিক একটি জঙ্গি।
পাকিস্তান সফরে না গিয়ে মুশফিক যতটা অজঙ্গি হয়ে উঠেছিলো নয়া প্রগতিশীল দাদা-দিদিদের কাছে; ততটাই জঙ্গি হয়ে উঠলো একটা "কুরবানি"-র দিনের তলোয়ার হাতে ছবি দিয়ে। আধুনিক নইয়ার ফিল্মে ঠিক যতটুকু রক্ত একটা ছোরার মধ্যে থাকে; যা সহনীয় দর্শকের কাছে; খেয়াল করে দেখুন, ঠিক ঐটুকু মুশফিকের ছবিটিতে আছে।
নইয়ার ছবির ভায়োলেন্স দেখে কোনদিন কেউ এসে বলেনা যে, হিরোর ছোরায় রক্তটুকু লেগে কেন! মুশফিকের ছবিটি নিয়ে বলতে হবে, কারণ শিবসেনারা কুরবানি ব্যাপারটা সহ্য করতে পারে না। এটা আসলে সাম্প্রদায়িকতাই কিন্তু সামাজিক রুচির কু-যুক্তি দিয়ে খুব একটা রুচি-সেনসিটিভিটির গল্প পেড়েছে; সাম্প্রদায়িক শিবসেনা।
ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি হিন্দুদের পশু বলিই হোক কিংবা মুসলমানের কোরবানিই হোক; আরব বিশ্বের মতো তা লোকচক্ষুর আড়ালে হোক। মানুষের শরীরে প্রোটিন চাহিদা রয়েছে; আর এই জীব চক্রটি ওভাবেই তৈরি; ফলে দুনিয়ার সবাইকে মডার্ন হবার জন্য কোরবানি না দিয়ে; ফেসবুকে আধুনিক সাজতে হবে; এর কোন যৌক্তিকতা আছে বলে মনে হয় না।
আর মুশফিকের আশা শিবির ও শিবসেনাদের ত্যাগ করা উচিত। সে সফল ক্রিকেটার; শিক্ষিত মানুষ; প্রাণবন্ত তরুণ; তাকে শিবসেনা দুটি গালি দিলে বা শিবির তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলে তাতে মুশফিকের কিছু এসে যায় না। এই শিবির আর শিবসেনারা হচ্ছে ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্বের ইউটোপিয়ায় ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ; একবিংশে অচল কতগুলো ঊনমানুষ।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য