আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

প্রসঙ্গ নেত্রকোনা: কেন আমলাকেন্দ্রিক সামাজিক বিভক্তি?

এখলাসুর রহমান  

জামালপুর, দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের পর এবার নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলো নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক মঈনুল ইসলামের বিরুদ্ধে৷ অভিযোগটি করলো তারই সহকর্মী নেত্রকোনার সাবেক এডিসি (শিক্ষা) শাকিলা দিল। অভিযোগে তিনি বলেন, মঈনুল ইসলাম বিভিন্নভাবে নিজের ভালোলাগা-ভালোবাসার কথা প্রকাশ করতে গিয়ে একপর্যায়ে তার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলেছেন। এতে করে তার সংসার পর্যন্ত ভেঙে গেছে৷ পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদার কথা চিন্তা করে দীর্ঘদিন বিষয়টি চেপে রাখলেও সবশেষে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন এই ভুক্তভোগী নারী ৷

ডিসির বিরুদ্ধে গত ৪ মার্চ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে লেখা আবেদনপত্রের এক স্থানে উপসচিব পদমর্যাদার ওই নারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ‘...বিভিন্ন সময়ে প্রেম নিবেদন করেন এবং নিজের কষ্টকর দাম্পত্যজীবনের জন্য সহানুভূতি প্রার্থনা করেন তিনি। অনলাইনে, প্রকাশ্যে, জনসম্মুখে একাধিকবার আমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেন। ওনাকে সতর্ক করা সত্ত্বেও উনি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে ব্যক্তিগত শালীনতাবোধ অতিক্রম করেন। দায়িত্বশীল আচরণ করতে বললে উনি ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক নিম্নস্বাক্ষরকারীকে অন্যায় এবং মিথ্যা শোকজ করেন এবং হুমকি-ধমকি দেয়ায় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি পারিবারিক সহিংসতার শিকার হই।

ভুক্তভোগী নারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগও করেন ডিসি মঈনুল ইসলাম৷ সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘অভিযোগকারী কর্মকর্তা এডিসি (শিক্ষা) থাকাকালীন এসএমএস ও মেসেঞ্জার ব্যবহার করে ডিসিকে ছোটলোক, কীট, মিথ্যাবাদী, চরিত্রহীন ও লম্পটসহ অন্যান্য ঘৃণ্য ও মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। ডিসির বক্তব্যে এডিসির পাল্টা বক্তব্য হলো, জুনিয়র অফিসার কেন, কোনো কর্মকর্তাই কখনও এ ধরনের শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন না। কিন্তু সে ক্ষেত্রে আমি তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা এডিসি হয়েও যদি তাকে (ডিসি) গালিগালাজ করে থাকি, তাহলে প্রশ্ন হল- কোন পর্যায়ে গেলে ডিসিকে তার এডিসি এ ধরনের কথা বলতে পারেন(?)-সেটি আগে বিবেচনায় নিতে হবে।’

ডিসি , এডিসির এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগে কি প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সম্মানহানি হচ্ছেনা? প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছেনা ডিসি ও এডিসি পদটি? জামালপুর,দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের পর এবার নেত্রকোনা জেলা প্রশাসকের নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ দেশজুড়ে আলোচিত হতে চলল৷ প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ডিসি কর্তৃক এডিসিকে মিথ্যা শোকজ করা কি সরকারি চাকরিজীবীর আচরণবিধির লঙ্ঘন নয়? আর বিনা কারণে একজন এডিসি কেনইবা ডিসিকে ছোটলোক,কীট,মিথ্যাবাদী,চরিত্রহীন ও লম্পট বলবে? আর ডিসি তখন কেন এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন না? আর এতদিন পরে কেন তা বলছেন? এডিসি কর্তৃক এমন অভিযোগই কি তার মাত্রাতিরিক্ত উত্যক্তের প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয়? আর এডিসির বক্তব্য মিথ্যা হলে তাও কি চাকুরির আচরণবিধিসম্মত হয়? ডিসিরা, এডিসিরা ইভটিজারদের শাস্তি প্রদান করে এখন তাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই যদি ইভটিজিংয়ের অভিযোগ ওঠে মানুষ আর নির্ভর করবে কাকে? ইভটিজিং হলেও তা অপরাধ এ অভিযোগ মিথ্যে হলেও তা অপরাধ৷ এর প্রকৃত সত্য বের হবে এটাই প্রত্যাশা৷ হাটে বাজারে ও পথে ঘাটে অনেক মেয়েকেই বখাটে ইভটিজারদের গালি দিতে দেখা যায়৷ এডিসি কর্তৃক ডিসিকে গালি প্রদান সেরকমই নয় কি? ইভটিজাররা নিজের বাড়ির কাউকে ইভটিজিং করেনা৷ ডিসি কিন্তু তাই করলেন৷ শুধু কি তাই? নেত্রকোনার ডিসি তথ্য অধিকার আইনও মানেন না৷ এর সাক্ষী আমি নিজে৷ একজন ভাষা সৈনিকের কবরসহ জায়গা দখলের অভিযোগ ওঠে একটি বেসরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে৷ এর সত্যতা অসত্যতা জানতে বাংলাদেশ গেজেটের ফরমে আবেদন করেছিলাম বেসরকারি সংস্থা স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতির নির্বাহী পরিচালক বেগম রোকেয়া বরাবরে৷

১২/১২/২০১৯ তারিখে স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতির নির্বাহী পরিচালক বরাবরে আমি নিজে বাংলাদেশ গেজেটের ফরমে আপিল আবেদন করি৷ তারা তথ্য প্রদান না করলে ২০/২/২০২০ ইং তারিখে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক বরাবরে আপিল আবেদন করি৷ অদ্যাবধি এই আপিল আবেদনের কোন জবাব দেননি জেলা প্রশাসক৷ একজন সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃক রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ সম্পর্কে সরকারের কী ব্যাখ্যা হতে পারে? নেত্রকোনায় ডিসি মঈনুল বিভিন্ন মহলের সাথে সখ্যতা গড়ে স্থানীয় প্রভাবকে পোক্ত করে রেখেছেন৷ স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতি, প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী সংগঠনের সাথে তিনি সখ্যতা গড়ে নিজে এমন প্রভাবশালী হয়ে উঠেন৷ অনেকটা কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভিনের মতো৷

নেত্রকোনা জেলা প্রেসক্লাব জেলার সর্বোচ্চ সাংবাদিকদের সংগঠন৷ অথচ এরও সভাপতি ডিসি মঈনুল ইসলাম৷ যার প্রেক্ষিতে অনেক সাংবাদিকও তার বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করতে বিব্রত হন৷ প্রেসক্লাবের সদস্য হয়ে প্রেসক্লাবের সভাপতির বিরুদ্ধে কিভাবে নিউজ করেন তারা? নইলে এতবড় নারী কেলেঙ্কারির পর তাকে সরকার প্রত্যাহার করলো কিন্তু জেলা প্রেসক্লাব কেন বহিষ্কার করতে পারলো না? অন্তত নৈতিক প্রতিবাদের প্রশ্নে তা করা কি উচিত ছিলোনা? এমন প্রশ্নও তুলছেন অনেকেই৷ কিন্তু উল্টো তার বদলির বিরুদ্ধে মানববন্ধন করছে স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতি,প্রেসক্লাব,নাগরিক সমাজ,সিপিবি ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতৃবৃন্দ৷ তারা বদলি প্রত্যাহারের আন্দোলনও করছে আবার বিদায় সংবর্ধনাও দিচ্ছে৷ কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভিন সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিলেন সাংবাদিক নির্যাতন করে ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের তার পক্ষে কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে৷ আর নেত্রকোনার ডিসি শিরোনাম হলেন নারী কেলেঙ্কারি ও সামাজিক সংগঠনের তার বদলি প্রত্যাহারের দাবিতে কর্মসূচি ও বিদায় সংবর্ধনার মাধ্যমে৷

কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানা পারভীনের বদলির আদেশে প্রতিবাদ করে জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাব, কুড়িগ্রাম মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটসহ বিভিন্ন নাগরিক সমাজ৷ রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব দেওয়ান মাহবুবুর রহমান স্বাক্ষরিত বদলি বাতিলের নির্দেশটি পেলে স্বস্তি ফিরে আসে কুড়িগ্রামের এসব প্রতিবাদকারীর মধ্যে। তখন কুড়িগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিক ও জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি একেএম সামিউল হক নান্টু বলেছিলেন, অভিনন্দন জেলা প্রশাসক মহোদয়কে তাকে স্বপদে বহাল রাখার জন্য। কুড়িগ্রামের উন্নয়নে তিনি অবশ্যই তার স্বপ্নকুঁড়ি’র মধ্যদিয়ে কুড়িগ্রামকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। পরে সাংবাদিক নির্যাতনের অভিযোগ উঠলে ডিসিকে ঘিরে বিভক্ত হয়ে ওঠে এলাকার সাংবাদিক সমাজ৷ এভাবেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে কতিপয় ডিসি বিভিন্ন জেলায় এমন প্রভাবশালী হয়ে উঠেন৷ নেত্রকোনাতেও ঘটলো কুড়িগ্রামের পুনরাবৃত্তি৷ ৬ আগস্ট যারা বদলি বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন করলো তারাই আবার ৭ আগস্ট তাকে বিদায় সংবর্ধনা দিলো!

নেত্রকোনার দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতির নির্বাহী পরিচালক বেগম রোকেয়া৷ তিনি ডিসির সমর্থনপুষ্ট ছিলেন তাই এই পদ পেয়েছিলেন৷ আর তাই তার বদলি ঠেকানোর মিছিলে স্বাবলম্বী৷ আবার তার বিদায় সংবর্ধনাতেও স্বাবলম্বী৷ ডিসি মঈনুল ইসলামকে ঘিরে বিভক্ত হয়ে উঠেছে জেলার সামাজিক,সাংস্কৃতিক,রাজনৈতিক ও সাংবাদিক মহল৷ কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন যারা বদলির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে তারাই আবার বিদায় সংবর্ধনাও দিচ্ছে! তা কী করে সম্ভব? এ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে পাল্টাপাল্টি লেখালেখি৷ জেলা প্রশাসকদের এমন কৌশলের আড়ালে বিভক্ত হয়ে উঠছে সামাজিক,রাজনৈতিক,সাংস্কৃতিক ও সাংবাদিক মহল৷ নেত্রকোনার ডিসি মঈনুল তার আরও একটি নজির হলো৷ ডিসি মঈনুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়েছে৷ নতুন ডিসি আসছেন৷ চলছে বদলি প্রত্যাহারের আন্দোলন৷ চলছে বিদায় সংবর্ধন৷ তাকে ঘিরে বিভক্ত হয়ে উঠেছে জেলাবাসী৷ এডিসি চলে গেছেন, ডিসি হয়তো চলে যাবেন অথবা থেকে যাবেন কিন্তু এই বিভক্তি কি কাটবে?

এখলাসুর রহমান, লেখক ও কলামিস্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ