আজ সোমবার, ১২ মে, ২০২৫

Advertise

স্বাস্থ্য বিভাগ কি গভীর ষড়যন্ত্রে আজও?

রণেশ মৈত্র  

বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভাগ্য, তারা তাদের স্বাস্থ্য বিভাগকে ষড়যন্ত্রমুক্ত করতে পারছেন না। মানুষ দীর্ঘদিন যাবত নানাভাবে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বহুকাল যাবত ঢালা অবাধ দুর্নীতির মহোৎসবকে। সে প্রতিবাদ উপেক্ষিত হয়ে আসছিল-বাড়ছিল মানুষের অসহায়ত্ব। অবশেষে এলো করোনা ভাইরাস। এ ভাইরাস প্রতিরোধে সারা বিশ্ব আজও সফলতা অর্জন করতে পারে নি-বাংলাদেশও না। তাই প্রতিরোধে আজতক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অক্ষমতা নিয়ে কোন অভিযোগ তেমন একটা নেই।

তারপরও, অর্থাৎ দিনে দিনে ঐ প্রাণঘাতী ভাইরাসে লক্ষ লক্ষ নাগরিক সংক্রমিত হচ্ছেন এবং হাজার হাজার মানুষ অসহায় মৃত্যুবরণ করছেন-এর বিরুদ্ধে যে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব থাকলেও আজও যে তা করা হয় নি-তাই নিয়ে স্বভাবত:ই মানুষ ক্ষুব্ধ। মানুষ ক্ষুব্ধ, আজও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোন কর্মকর্তাকে দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় নি কারও বিরুদ্ধে একটিও মামলা দায়ের বা গ্রেপ্তার করা হয় নি-এই কারণে। কতদিনে অবস্থার পরিবর্তন হবে, দুর্নীতিবাজরা চিহ্নিত হবে কতদিনে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসবে তার কোন হদিশ ও এই দীর্ঘ ছয় মাসের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে না।

হ্যাঁ, তীব্র সমালোচনার মুখে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তাকে পদত্যাগ করানো হয়েছে, আরও বেশ কিছু সংখ্যক কর্মকর্তাকে, সংবাদপত্রের ভাষায়, ‘সরিয়ে দেওয়া’ হয়েছে। কিন্তু তাদের ‘সম্মান’ রক্ষার্থে বলা হয়েছে, “না তাদেরকে দুর্নীতির অভিযোগে” সরানো হয় নি-এই রদবদল “রুটিন ওয়ার্ক” মাত্র।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তীব্র সমালোচিত ডিজি অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ “পদত্যাগ” করার পর একজন সৎ ও জনপ্রিয় চিকিৎসককে ঐ পদে নিয়োগ দানের পর সকল মহল থেকেই তাকে অকুণ্ঠ অভিনন্দন জানান হয়েছিল এই প্রত্যাশায় যে তিনি কঠোর হাতে সকল দুর্নীতির অবসান ঘটিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতি জনগণের হৃত আস্থা পুনরুদ্ধার করবেন ও দুর্নীতির সিন্ডিকেটকে কঠোরভাবে ভেঙ্গে দেবেন। তা হয় নি আজও। তবে তিনি এতই কম দিন হলো দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন-তার মধ্যে যে দুর্নীতির শক্তিশালী চক্র ভঙ্গ সম্ভব না তা সকলেই উপলব্ধি করে ধৈর্য ধারণ করে আছেন। আশা করি মানুষ তার কাছে হতাশ হবেন না।

ইতোমধ্যেই খবর বেরিয়েছে, সংক্রমণের দিক থেকে বাংলাদেশ ইতালিকে অতিক্রম করেছে। আবার মজার ব্যাপার হলো এই খবর প্রকাশের সাথে সাথেই জানানো হলো “সংক্রমণের হার বাড়লেও হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কমছে”। তাৎপর্যপূর্ণ খবর বটে। মে-জুন-জুলাই এর তুলনায় ভুয়া, তা কি আজও সরকার অসত্য বলে মনে করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী ও এম.পি’রা কি ঐ হাসপাতালগুলিতে গিয়ে সপরিবারে করোনা পরীক্ষা করাতে সম্মত হবেন? সরকার হঠাৎ করে করোনা টেস্টের বাবদে ফি নির্ধারণ করে কঠোর দারিদ্র্য পীড়িত কোটি কোটি মানুষের জন্য করোনা টেস্ট অসম্ভব করে তোলেন নি?

ধন্যবাদ জানাতে হয় আমাদের জনগণকে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশ-র্যাব প্রমুখকে। জনগণের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ-র্যাব বেশ কয়েকটি হাসপাতালে অভিযান চালালেন। আমরা দেখলাম, বেশীর ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের কোন রেজিস্ট্রেশন নাই, জানলাম বেশ কিছু হাসপাতাল থেকে বিপুল অংকের টাকার বিনিময়ে করোনা টেস্ট করে ভুল বা ভুয়া সার্টিফিকেট দিচ্ছে। ফলে কয়েকজন ধরাও পড়লেন র্যাব-পুলিশের হাতে। অপরাপর বহু হাসপাতালের বহু দুর্নীতির অভিযোগ গোপনে আসতে লাগলো র্যাবের কাছে। অভিযান পরিচালনা করলো বাহিনীদ্বয় অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হলো। বেশ কয়েকজন হাসপাতালের কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হলেন। তারা পুলিশের কাছে বহু রাঘব বোয়ালের নাম প্রকাশ করে জানালেন যে তাদের যোগসাজশে, বা আশ্রয়-প্রশ্রয়েই তারা এমন দুর্নীতি করছেন। ঐ রাঘব-বোয়ালরা কোথায়? তারা একজনও ধরা পড়ছেন না কেন? কোন শক্তিশালী চক্র ঐ রাঘব বোয়ালদেরকে রক্ষা করছে।

অভিযান বন্ধ-নতুন নির্দেশনা
লক্ষণীয় যে অনেকগুলি হাসপাতালে র‍্যাব-পুলিশ কর্তৃক পরিচালিত বেশ কিছু সফল হওয়ায় জনমনে স্বস্তির ভাব সৃষ্টি হয়েছিল যদি কোন ক্ষেত্রেই, সম্ভবত: উপরের হাতছানিতে ধরা পড়া অভিযুক্তরা রাঘব-বোয়ালদের নাম পুলিশের কাছে প্রকাশ করলেও তাদের কোন তালিকা আজও প্রকাশ করা হয় নি বা ঐ রাঘব-বোয়ালদের টিকিটিও আজতক কেউ ছোঁয়ার সাহস পায় নি। সম্ভবত: ভেতরে ভেতরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা কোন শক্তিশালী মহল কলকাঠি নাড়ার ফলেই এমন গোপনীয়তা ও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়েছেন র‍্যাব-পুলিশ কর্মকর্তারা। কিন্তু অভিযান বন্ধ হলো কেন? আর কি করোনার জাল সার্টিফিকেট ইস্যু হচ্ছে না? দেশের যে সকল বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক দিব্যি বিনা লাইসেন্সে কাজ চালাচ্ছিল তারা কি ইতোমধ্যে তাদের লাইসেন্স সংগ্রহ করে নিয়েছে?

না, এগুলির কোনটিই হয়নি হলেও অতি সামান্য সংখ্যক হাসপাতাল-ক্লিনিক তাদের লাইসেন্স হয়তো নবায়ন করে নিয়েছে। সরকার বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কি করনীয় নয় কখন বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক তাদের লাইসেন্স নবায়ন করে নিচ্ছেন বা কোন কোন হাসপাতাল-ক্লিনিক আজও তা করে নি? যারা নবায়ন করে নি-তাদের নামের তালিকা দ্রুত প্রকাশ করা জরুরি কারণ সে সব জেনে বুঝে তবেই তো মানুষ হাসপাতালে রোগী ভর্তি করাবেন। শুধু তাই না, সকল হাসপাতালে আসন সংখ্যা অনুযায়ী ডাক্তার (বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সহ), নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আছে কি না-বা তারা রোগীর কাছ থেকে অত্যধিক টাকা আদায় করছে কি না তা-ও দেখা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তব্য।

যা হোক, অভিযান বন্ধ হওয়ার কারণ এখন অনুমান করা যায়। কথিত ও রাঘব বোয়ালদের সিন্ডিকেটের স্বার্থে(?) যখন তখন হাসপাতালগুলিতে অভিযান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নির্দেশনা জারী করেছেন। ঐ নির্দেশনায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে কোন হাসপাতালে অভিযান চালানো যাবে না।

প্রশ্ন করি, কেন এই নির্দেশনা? আগের অভিযানগুলি পরিচালনা কালে র্যাব বা পুলিশের কোন কর্মকর্তা বা তাদের কেউ কি বে-আইনি কিছু করেছেন? যদি তা করে থাকেন, তিনি সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবেই অপরাধী। তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি বিধান করা হোক-অব্যাহত রাখা হোক হাসপাতালগুলির মালিক-কর্মকর্তাদের অন্যায়, অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অভিযান। অভিযানকে আরও জোরদার করা হোক এবং ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সর্বত্র তা প্রসারিত করা হোক।

একই সাথে, দেশের সকল এলাকার মানুষকে যতটা করোনামুক্ত রাখার জন্য অবিলম্বে করোনা টেস্টিং ফি প্রত্যাহার, দেশের সকল জেলায়, এবং সম্ভব হলে উপজেলাগুলিতেও করোনা টেস্ট কিটস যথেষ্ট পরিমাণে সরবরাহ করে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষকে পরীক্ষা করে যাদের ক্ষেত্রে শনাক্ত হবে-তাদের সকলের অবিলম্বে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। প্রতিটি জেলাতেই কমপক্ষে ৮টি করে করোনা পরীক্ষার ল্যাব স্থাপন এখন অপরিহার্য। এ ব্যাপারে অতীতেরও লিখেছি কিন্তু তার কোন ফল না হওয়ায় পুনরায় বিষয়টি উল্লেখ করতে হলো।

কিন্তু অভিযান পরিচালনার পথ আইন করেন রোধ করা, দুর্নীতিবাজ ও তাদের গডফাদারেরা আজও ধরা-ছোঁয়ার ঊর্ধ্বে থেকে নিরাপদে ঘুরে বেড়ানো প্রভৃতি দেখে মনে হয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক গভীর ষড়যন্ত্রে শিকার। এ আশংকা সত্য হলে তা থেকে উদ্ধারে অত্যধিক তৎপর হওয়া প্রয়োজন।

উদ্বেগের খবর হলো, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ আসন্ন। তা থেকে পরিত্রাণের প্রচেষ্টা দ্রুত সুরু করা প্রয়োজন। যেমন করোনা পরীক্ষার কিটস দেশের সর্বত্র যথেষ্ট পরিমাণে সরবরাহ প্রতি জেলায় কমপক্ষে আটটি করে করোনা পরীক্ষার ল্যাব স্থাপন, প্রতিটি হাসপাতালে উপযুক্ত সংখ্যক আই.সি.ইউ, ভেন্টিলেটর, গ্যাস সরবরাহ, উপযুক্ত সংখ্যক ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও প্রয়োজনীয় উপকরণাদির সরবরাহ অতি শীঘ্র করা প্রয়োজন। প্রয়োজন করোনা চিকিৎসার হাসপাতাল ওয়ার্ড ও বেড সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তা অতি সত্বরেই শুরু করা।

রণেশ মৈত্র, লেখক, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক; মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ইমেইল : raneshmaitra@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৫ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৮ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১১০ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪৫ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৪ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২৫ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন