আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা: একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পোস্টমর্টেম

ড. শামীম আহমেদ  

পেছনের ঘটনা
বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় ২১ আগস্টের হামলার পরিকল্পনা হয়েছিল মূলত তারেক রহমানের কার্যালয় হিসেবে পরিচিত হাওয়া ভবন থেকে। এছাড়াও আরও দুটি জায়গা ব্যবহার করা হয়েছে এর পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নের বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা ঠিক করার জন্য। এগুলো হচ্ছে, বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু’র ধানমন্ডি বাসভবন, এবং হরকত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামির মোহাম্মদপুরের আস্তানা। বিএনপি-জামায়াত ইসলামীর পক্ষ থেকে এই পরিকল্পনার মূল হোতা ছিল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, বিএনপির সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, এবং সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী আলি আহসান মুজাহিদ। পুরো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন তারেক জিয়া। একটু চিন্তা করে দেখেন, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেয়া পরিবারটিকে পুরো ধ্বংস করে দেয়ার পরও এই জামায়াতে ইসলামীকে জিয়াউর রহমান আবার বাংলাদেশের পুনর্প্রতিষ্ঠিত করেন এবং বিএনপি আলি আহসান মুজাহিদের মতো রাজাকার ও চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীকে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্ব দেয়। যেই লোক পাকিস্তান কায়েম ও বজায় রাখার জন্য ১৯৭১ এ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখে তার গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেয় বিএনপি।

মূল হোতা কারা
এই মূল হোতাদের পরিকল্পনাকে মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখে বিএনপির উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ছোট ভাই জঙ্গি তাজউদ্দিন। এই তাজউদ্দিন বিএনপি জামাতের শীর্ষ নেতা এবং হরকত-উল-জিহাদের মধ্যে মূল যোগাযোগ বজায় রাখে। বিদেশ থেকে গ্রেনেড আনার কাজটিও হয় তার প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতায়। তাজউদ্দিন যে শুধু এই নাশকতায় জড়িত ছিল তাই নয়, ৯০ দশকে পাকিস্তানে পড়তে যাওয়া এই সন্ত্রাসী দেশে ফিরে ১৯৯৮ সালে কবি শামসুর রহমানকে হত্যা চেষ্টাও ভূমিকা রাখে বলে জানা যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর বিএনপির সরকারের পতন আসন্ন জেনে তাকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেয় ডাইরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স-ডিজিএফআই’র তৎকালীন কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এটিএম আমিন, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সাইফুল ইসলাম ডিউক ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার। তদন্তের ফলাফল থেকে নতুন বার্তার রিপোর্টের মাধ্যমে জানা যায় যে ২০০৬ সালের ১০ অক্টোবর তাজউদ্দিনকে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে যান প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের তৎকালীন কর্মকর্তা মেজর মনিরুল ইসলাম ও লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মিজান। পাকিস্তানের করাচিগামী বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে তুলে দেন তাকে। বাদল পরিচয়ে অনেক আগেই তৈরি করা পাসপোর্টে পাকিস্তানে পাঠানো হয় তাকে। এর আগে তাজউদ্দিনের ভুয়া পাসপোর্ট ও বাংলাদেশ বিমানের করাচি যাওয়ার টিকিট এবং বোর্ডিং কার্ড মেজর মনিরুল ইসলামের হাতে দেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার। পরে পাকিস্তান থেকে দক্ষিণ আফ্রিকায় যায় তাজউদ্দিন।

হত্যা জড়িত যেসব বাহিনী
যেমনটা বলছিলাম, দেশের প্রধান বিরোধী দলের কার্যালয়ের সামনে তাদের জনসভায় গ্রেনেড হামলা করা হয়, যেখানে মারা যায় ২৪ জন নেতা-কর্মী এবং আহত হয় ৫০০ জন মানুষ – সেটি সাধারণ সন্ত্রাসীদের পক্ষে সম্ভব নয়। এটি তদন্তে বেরিয়ে আসে যে ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সের ডিরেক্টর জেনারেল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম, ডিজিএফআই এর ডিরেক্টর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ডিজিএফআই’র তৎকালীন কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এটিএম আমিন, এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার এই হামলার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল। এই জায়গাটা খেয়াল করুন, ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে মিল পাবেন। বিএনপি-জামাত, সামরিক বাহিনী ছাড়াও যেসব মৌলবাদী সংগঠন এই হামলায় ভূমিকা রাখে তারা হচ্ছে – হরকত-উল-জিহাদ বাংলাদেশ, বার্মা কেন্দ্রিক রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন, এবং কাশ্মির ভিত্তিক হিজব-উল-মুজাহিদিন, তেহরিক-জিহাদ-ই-ইসলাম, লস্কর-ই-তৈয়ব।

শেখ হাসিনা বিহীন উগ্র বাংলাদেশ কায়েমের চেষ্টা
এই হামলার মূল উদ্দেশ্য যে ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এবং ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট শেখ পরিবারকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ফেলা শক্তিই যে বেঁচে যাওয়া দুই কন্যার অন্যতম শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে এই হামলা করে তা বোঝা যায় মুফতি হান্নানের জবানবন্দি থেকে। মুফতি হান্নান জানায় যে হামলার অল্প কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী মেজর নূর হাওয়া ভবনে উপস্থিত থেকে এই হামলার পরিকল্পনায় অংশ নেয়। বিএনপি সরকারের এই হামলায় অংশগ্রহণের ভূমিকা আরও পরিষ্কার হয় যখন হামলার পর পর পুলিশ লাঠিপেটা করে প্রথমে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এলাকা থেকে বের করে দেয়, আহতদের উদ্ধারে বাঁধা দেয় এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে পুরো এলাকায় ধোঁয়ায় ভরিয়ে দিয়ে আক্রমণকারীদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করে। শুধু তাই নয়, পুলিশ পরবর্তীতে ওই এলাকা থেকে হামলার কোন ফরেনসিক প্রমাণ তো সংগ্রহ করেই নি, বরঞ্চ পুরো এলাকা না ঘিরে রেখে প্রমাণাদি নষ্ট হতে সাহায্য করে, এবং পানি এবং ডিজারজেন্ট দিয়ে পুরো এলাকা ধুয়ে ফেলে অন্যদের প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টাও ভেস্তে দেয়। বিএনপি জামাত লোক দেখানো একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে, যার রিপোর্ট কখনই আলোর মুখ দেখেনি। কমিশন শুধুমাত্র ঘোষণা করে যে এই হামলা স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক শত্রুদের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে। সেই বিচারক মাত্র দুই বছরে মধ্যে এপিলেট ডিভিশনে পদোন্নতি পান। বিএনপি জামাত সরকার তাদের সংশ্লিষ্টতা ঢাকার জন্য জোর করে মিথ্যা সাক্ষ্য সংগ্রহ করে, যার অন্যতম শিকার নিরীহ জজ মিয়া।

এই হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী। ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র ও বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ হানিফ মাথায় বিঁধে থাকা স্প্লিন্টারের জীবনযন্ত্রণা ভোগ করেই শেষ পর্যন্ত মৃত্যু বরণ করেন। এমনকি ভয়াল সেই হামলায় মৃত্যুজাল ছিন্ন করে প্রাণে বেঁচে গেলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হারিয়েছেন তাঁর দু’কানের স্বাভাবিক শ্রবণশক্তি। মুফতি হান্নান তদন্তে জানায় তারেক জিয়া মূলত আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করার জন্যই শেখ হাসিনাকে মেরে ফেলার এই পরিকল্পনা করেন। মুফতি হান্নান মৌলবাদী সংগঠনগুলোর সম্পৃক্তা বিষয়ে বলে তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে ইসলাম বিরোধী বলে মনে করে। এটি খুব হাস্যকর যে শেখ হাসিনা যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, সকল ধর্মীয় আচার মানেন, সেখানে তাকেই ইসলামের শত্রু বলে তারা, এবং তাদের হত্যার পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেয় যারা, তাদের কেউই ‘প্র্যাক্টিসিং মুসলিম’ নয়। তাই এইসব যুক্তি যে কুযুক্তি এবং মূলত বাংলাদেশের উন্নতিকে বাধাগ্রস্ত করার ঐতিহাসিক প্রচেষ্টার অংশ যারা শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ও চারনেতাকে হত্যার মাধ্যমে, তাতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।

হামলার শুরু
হামলা চালানোর আগের দিন অর্থাৎ ২০ আগস্ট, হরকত-উল-জিহাদের কাজল এবং আবু জানদাল বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে যায় রেকি করতে। তারা এই অপারেশনের নাম দেয় “শেখ হাসিনাকে নাস্তা করানো”। হামলার দিন তারা বাড্ডার একটি বাড়িতে মিলিত হয়। কাজল এবং আবু জিন্দালের নেতৃত্বে ১২ জনের হামলাকারী দল একসাথে নামাজ পড়ে এবং দুপুরের খাবার খায়। তারপর মাওলানা সাইয়িদ জিহাদের গুরুত্বের উপর বক্তৃতা দেন, অর্থাৎ এই হামলাকে তারা ধর্মীয় লেবাস পড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে। এরপর মুফতি হান্নান এই ১২ জনের হাতে ১৫টি গ্রেনেড তুলে দেয়।

আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা আছরের নামাজের পর গোলাপ শাহ মাজারে মিলিত হয়। তারপর তারা আওয়ামী লীগের নেতারা যে ট্রাকগুলো থেকে বক্তৃতা দেবে তার আশেপাশে এমনভাবে অবস্থান নেয় যাতে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারতে সুবিধা হয়। শেখ হাসিনা বক্তৃতা দেবার পর প্রথম গ্রেনেডটি ছুঁড়ে মারে আবু জিন্দাল। তারপর অন্য হামলাকারীরা একের পর এক গ্রেনেড ছুঁড়ে মেরে আগের থেকে করা পরিকল্পনা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দা বাহিনীর সহযোগিতায় দিনে-দুপুরে হামলার স্থান ত্যাগ করে। আওয়ামী লীগের জনসভার আগে সাধারণত ছাত্রলীগ এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা কর্মীরা আশেপাশের ভবনের ছাদে অবস্থান নেয়। কিন্তু ২১ আগস্ট ২০০৪ সালে যেহেতু শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে সরকার, তাই আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ছাদে উঠতে দেয়া হয়নি। এমনকি মুফতি হান্নান হত্যাকাণ্ডের স্বীকারোক্তি দিলেও বিএনপি জামাত সরকার হরকত-উল-জিহাদের প্রধান এই মুফতি হান্নান এবং তার সহযোগী বিপুলকে গ্রেপ্তার দেখায়নি। পরে বিএনপি-জামাত সরকারের পতন হলে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

খালেদা জিয়ার ভূমিকা কী ছিল
এই হামলায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরাসরি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তবে তিনি এই হত্যার বিচারে আগ্রহী ছিলেন বলেও মনে হয়নি। ডিজিএফআই প্রধান রুমি খালেদা জিয়ার কাছে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করার জন্য দুইবার অনুমতি চান, কিন্তু খালেদা জিয়া দুইবারই তা নাকচ করে দেন। এছাড়াও খালেদা জিয়া সংসদে একাধিকবার আপত্তিকর মন্তব্য করেন, যেমন: “তাকে (শেখ হাসিনা) কে হত্যা করতে চাইবে?” কিংবা “সে (শেখ হাসিনা) তো নিজেই ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিল”। ধারণা করা হয় খালেদা জিয়া নিজে সংশ্লিষ্ট না হলেও হয়ত তারেক রহমানের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি জানতেন, এবং তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।

রায়
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়। রায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, খালেদার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এছাড়া ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো - লুৎফুজ্জামান বাবর, আব্দুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টির আহ্বায়ক মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, কাশ্মীরি জঙ্গি আব্দুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন, মো. রফিকুল ইসলাম, মো. উজ্জল, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম, হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ। পরিকল্পনা ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করার অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করে আদালত।

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলো - তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ, মাওলানা সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম মাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো. খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল ওরফে ইকবাল হোসেন, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু। তাদের দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহিদুল হক, বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, ডিএমপির সাবেক উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, আরেক সাবেক উপ-কমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মো. রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেয় আদালত।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে উচ্চ আদালতের অনুমোদন লাগে। নানা কাগজপত্র প্রস্তুত করে উচ্চ আদালতে পৌঁছুতে হয়। রায়ের প্রায় দুই বছরের মাথায় মাত্র মাত্র গত রবিবার “পেপারবুক” সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছেছে। এখন দোষী সাব্যস্তরা উচ্চ আদালতে আপিল করতে পারবে। তারপর নিয়মানুযায়ী বিচার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।

শেষের কথা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সাথে এই হামলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টাকে পৃথকভাবে দেখার সুযোগ আছে বলে মনে করছি না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে যেমন সেনাবাহিনীর ভেতর ভারত বিরোধিতা, এবং প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু, সবার জন্য সমান অধিকার, ধর্ম নিরপেক্ষতা, মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় উগ্রবাদী রাষ্ট্রগুলোর কাছে মাথা নত না করাসহ নানা ধরণের অভিযোগ ছিল, শেখ হাসিনাকে হামলার পেছনেও মূলত অমন কিছু যুক্তিই তুলে ধরেছে হত্যাকারীরা প্রায় ৩০ বছর পরের এই হামলার তদন্তে। এখানে দেখার বিষয় দুটি হামলাতেই সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতা ছিল। দুটিতেই উগ্র ইসলামপন্থীদের সরব উপস্থিতি দেখা যায়। ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডে যেমন জিয়াউর রহমান সরাসরি অংশগ্রহণ না করে সকল ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল, তেমনই ২০০৪ এর হামলায় তারই সন্তান, তারেক রহমানের নেতৃত্বদানের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ১৯৭৫ সালে হামলার মূল উদ্দেশ্য ছিল শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করা, যাতে স্বাধীনতার পরেও একটি পাকিস্তানপন্থী মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রিক তাবেদার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ঠিক একইভাবে ২০০৪ সালের হামলার উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭৫ সালে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যাকে হত্যা করে তাদের সেই অপূর্ণ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা। কেননা, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে হত্যাকারীরা পরবর্তী ২১ বছরে তাদের এজেন্ডা অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে এসে আবার বাংলাদেশ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন, দেশকে দ্রুত স্বনির্ভর করে ফেলতে থাকেন, এবং উগ্র মৌলবাদ ও ধর্মীয় অন্ধত্বের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন। জিয়াউর রহমান এবং তার সহযোগীরা যেমন শেখ মুজিবুর রহমানকে তাদের ক্ষমতা দখলের পথে অন্তরায় হিসেবে দেখছিল, তাদেরই কেউ কেউ শেখ হাসিনাকে একইভাবে তাদের বাংলাদেশকে অন্যান্য দেশের তাবেদারি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে বাঁধা হিসেবে দেখছিল। উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধুর খুনি মেজর নূর ২০০৪ সালে শেখ হাসিনাকে হামলার পরিকল্পনায় হাওয়া ভবনে বসে তারেক রহমানের সাথে অংশ নেয়া কোন কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে না।

ইতিহাস যত পুরনো হয়, তত পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার অনেক গোপন তথ্যাদি যেমন এখনও বেরিয়ে আসছে, আমার ধারণা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার অনেক তথ্যও সামনের দিনগুলিতে বেরিয়ে আসতে থাকবে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী নূর শুধু নয়, ডালিমসহ অন্যান্যদের এই ২১ আগস্টের হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে আমি মনে করি। বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র আনা এবং সেগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিবহন করা একটি অনেক বড় ষড়যন্ত্রের অংশ ছাড়া হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময়ও তার খুনি সেনাবাহিনীর এসব বহিষ্কৃত কর্মকর্তারা বাইরে থেকে সহযোগিতা পেয়েছিল। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান তাদেরকে পুনর্বাসিত করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নানা দেশে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করে। ওই সময়ে তাদের তাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গঠন করে যা পরবর্তীতে নানা সময় কাজে লাগিয়েছে এমন তথ্য প্রমাণাদি পাওয়া যায়। ২০০৮ সালের ২১ আগস্টের সময়ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী খুনিরা তাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে আভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসীদের সহযোগিতা করেছে এমন তথ্য হয়ত সামনের দিনগুলিতে উদঘাটন হবে। ১৯৭৫ সালের পর ২০০৪ সাল এই ২৯ বছর সময় নিয়ে বাংলাদেশ বিরোধীরা স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই জন মানুষ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় সমর্থ হলেও শেখ হাসিনাকে হত্যায় ব্যর্থ হয় বিধায় আমরা হয়ত ২০০৪ সালের ২১ আগস্টকে অনেক বড় হামলা হিসেবে দেখি না, কিন্তু ওইদিন যদি শেখ হাসিনার কিছু হয়ে যেত, তাহলে সেটি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ট্রাজেডির চাইতে কোন অংশে কম বিপর্যয় হতো না বাংলাদেশের জন্য।

২০০৪ সালের হামলারও প্রায় ১৬ বছর হয়ে গেল। এখনও সেইসব খুনিদের বিচারের চূড়ান্ত শাস্তি হয়নি। ষড়যন্ত্রকারী এবং দেশদ্রোহীরা চুপ করে গেছে এমনটা ভাবলে আমরা ভুল করব। সরকার ও বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের সর্বদা সজাগ থাকা প্রয়োজন যাতে এই বাংলার মাটিতে কোনভাবেই আরেকটি ১৫ আগস্ট কিংবা ২১ আগস্টের পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

ড. শামীম আহমেদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক-বিজ্ঞান গবেষক।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ