আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

কোথায় মুক্তি?

সঙ্গীতা ইয়াসমিন  

সকাল থেকেই দেখছি ফেসবুকে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যার বিষয় হল- মা ও মেয়েকে চোর অপবাদে ইউপি চেয়ারম্যান কর্তৃক বেদম প্রহার এবং কোমরে রশি বেঁধে সারাগ্রাম প্রদক্ষিণ করানো হয়েছে।

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে এখনও ফেসবুকে চোখ রাখতে পারছি না। এ জাতীয় ঘটনায় ঠিক কী ধরনের প্রতিবাদ করা উচিত, কতোটা ক্ষোভ প্রকাশ করলে তা যথেষ্ট হয়, ঠিক কোন ভাষায়, কী ধরনের শব্দচয়নে এ বিষয়ে কথা বলা উচিত তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। ঠিক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যাচ্ছি!

এ জাতীয় ঘটনা নতুন নয়; আর নতুন নয় বলেই কি আমাদের চোখে সয়ে গেছে সব? আমরা একে স্বাভাবিকতার পর্যায়ে জ্ঞান করছি? কেন দিনকে দিন একের পর এক এ জাতীয় ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে? কেন এর কোনো প্রতিকার নেই? কে জবাব দেবে এসব প্রশ্নের? দুর্ভাগ্য তো এই যে, আসলেই এসব প্রশ্ন করব এমন কেউই নেই! উত্তর তো দুরস্ত!

পিটিয়ে হত্যা, কুপিয়ে হত্যা, কান কেটে দেওয়া, চোখ তুলে দেওয়া, হাত কেটে দেওয়া, চুল কামিয়ে দেওয়া, এ জাতীয় ঘটনার সাথে যেমন ঘটনাকারীর মানসিক দুর্ধর্ষতার সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি সামগ্রিক সাংস্কৃতিক রাজনীতিরও একটা গভীর যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে হয়। মানসিক দুর্ধর্ষতা ব্যক্তির ব্যক্তিগত বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, পারিবারিক মূল্যবোধ, নীতিশিক্ষা, এবং চারপাশের আনুষঙ্গিক বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট।

সাংস্কৃতিক রাজনীতি হল একটি সমাজের সমাজ মানস, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্য-প্রীতি-সমানুভূতি-সহানুভূতি, এবং সামাজিক আচার-প্রথা-মূল্যবোধের ভিত্তি এবং এর চর্চার সাথে সমাজ কাঠামোর যোগাযোগ এবং সামষ্টিক বন্ধনকেই বোঝানো হয়েছে। এই বিষয়গুলো একদিনে যেমন গড়ে ওঠে না, তেমনি সামাজিক কাঠামো, এবং সামষ্টিক যোগাযোগের ফলে সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার প্রেক্ষাপটেরও পরিবর্তন হয় সময়ে। যেটা নিশ্চিতভাবেই আমাদের সমাজে ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়। বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাঁটলে একদিন আমাদের অশিক্ষা, দরিদ্রতা, কর্মহীনতাসহ নানাবিধ সামাজিক সমস্যা ছিল প্রকট। তখনও সামাজিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, শোষণ-বঞ্চনার এমন ক্রূর চিত্র খুব সহজেই চোখে পড়ত না বলেই জানা যায়। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ঔদাসীন্য এবং সাংস্কৃতিক চর্চার ফসলই আজকের সমাজের নিষ্ঠুরতার জন্য দায়ী বলে আমার বিশ্বাস। কেননা, নদীবিধৌত পলল দ্বীপের এই বঙ্গদেশের মানুষ আদতেই এতোটা নিষ্ঠুর, এতোটা ক্ষমাহীন হবার কথা ছিল না আরব বেদুইনদের মতো, আজ যখন ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গঠন করেছি তখন এ দৃশ্য অবান্তরই নয়, অতীব বেদনাদায়ক!

মানুষের সহজাত স্বভাবে মানুষ হিংস্র প্রাণি নয়! তবে, তাঁর জীবনযাত্রা, জীবনাচরণ, সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি, অর্থের দম্ভ এবং ক্ষমতার প্রশ্রয়ে তাঁর মনুষ্যত্ব বিলুপ্ত হয়! যুগে যুগে এইই প্রমাণিত হয়েছে অন্তত আমাদের দেশের হাল হকিক্বত দেখে এ কথাই বলা যায়। অথচ, হবার কথা ছিল এর বিপরীত।

মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে প্রকাশ্য দিবালোকে, জনসমক্ষে গর্দান কর্তনের আইন রয়েছে। সেটি সেই সমাজের জন্য স্বাভাবিক, আইনসিদ্ধ।আমাদের সমাজেও অপরাধের ধরন অনুযায়ী পেনাল কোড এবং ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির বিধান রয়েছে। একজন ইউপি চেয়ারম্যানকে আমরা আইন প্রণেতা, আইনের রক্ষকই বলতে পারি স্থানীয় সরকারের ক্ষুদ্রতম ইউনিটের। সেখানে তিনি, কিংবা তাঁরাই আইনের ভক্ষক হবেন এমনটা ভাবাই অস্বাভাবিক। কিন্তু এই অস্বাভাবিকতাই আজকের বাংলাদেশের স্বাভাবিক চিত্র হয়ে উঠেছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে কেন? সমস্যা কোথায়? সমস্যা তো আছেই। ভূত সরিষায়। একটা সহজ কথাকে পেঁচিয়ে জটিল করে কী লাভ? শ্রেণির দ্বন্দ্ব সমাজে চিরন্তন। সেখানে দুর্বল মার খাবে চিরকাল, পিষ্ট হবে সবলের পায়ের তলায়, এইতো নিয়ম। সে দুর্বল নানাবিধ ক্রস-কাটিং ইস্যুতে বারে বারে দুর্বলতা নিয়ে সমাজের অতি নিম্নস্তরেই অবস্থান করবে। যদি সে দরিদ্র হয়, সে যদি নারী-শিশু-বয়স্ক-প্রতিবন্ধী হয়, কিংবা ধর্ম-জাতিগত ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হয়। সর্বোপরি ক্ষমতার প্রচ্ছায়ায় যদি তাঁদের কিঞ্চিৎ স্পর্শও না থাকে; সেই সব তুচ্ছাতিতুচ্ছ মানুষেরা চিরকালই সমাজের জঞ্জাল।সুতরাং জঞ্জাল সাফ-সুতরো করে ধুয়ে মুছে ফেলাই আইন প্রণেতাদের কাজ!

ইউপি চেয়ারম্যান তাইই করেছেন। গরু চোর সন্দেহে পিটিয়েছেন! লক্ষ্য করবেন, কথাটি সন্দেহে, এরপর তিনি তাঁদেরকে সারা গ্রামে কোমরে দড়ি বেঁধে ঘুরিয়েছেন। সাবধান করে দিতে চেয়েছেন গ্রামের অন্য সকল চোরদেরকেও। একারণে তিনি সাধুবাদ পেতেই পারেন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এরপরে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা হয়েছে।

এবার কি আপনি প্রশ্ন করবেন যে পুলিশ আর কী করবে? পুলিশেরও অনেক কিছু করার আছে। কথায় বলে না পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা! সুতরাং ঘাবড়াবেন না। পুলিশ নিশ্চয়ই মোটরসাইকেলের তেলের পয়সাটা ওঁদের কাছ থেকেই আদায় করবেন, থানায় নিয়ে রিমান্ডেও নিতে পারেন অনায়াসে, আলাপ-আলোচনায় দফারফা না হলে কোর্টে চালান করেও দিতে পারেন (প্রক্রিয়াগত ত্রুটি গুরুত্বপূর্ণ নয়)। আর এসবের সাথে সাথে হাজতে থাকাকালীন মা-মেয়ে পুলিশের হাতে ধর্ষিত হলেও খুব কি অবাক হবেন আপনারা? আমি অন্তত বিস্মিত হব না।

এই করোনা পরিস্থিতিতেও আমাদের ত্রাণ চুরি বন্ধ হয়নি, বন্ধ হয়নি শিশু-নারী ধর্ষণ, হত্যা খুন। মৃত্যু দরোজায় করাঘাত করলেও যে জাতির বোধোদয় হয় না, তাঁদের জন্য পৃথিবীর কোনো নিন্দার ভাষাই যথেষ্ট নয় তাঁরা ঘৃণারও অযোগ্য। একটা আইনের শাসনহীন সমাজে নীতিকথা কেবল অরণ্যেই রোদন।

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছি আরও কয়েক বছর আগেই। সারাবিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দায় ভয়াবহ পরিস্থিতির মোকাবেলা করছে সেখানে গত ছয় মাসে বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিবেদনের সকল সূচকই উর্ধমুখি। বিশ্ববাজারের সাথে পাল্লা দিয়ে আমরাও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে, নয়া প্রযুক্তিতে, নয়া কলা-কৌশলের একবিংশ শতাব্দীর সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। পত্রিকার পাতায় এসব সংবাদ পড়ে সত্যিই বুকের চাতাল আনন্দে থই থই করে। কিন্তু যখন সেই একই পত্রিকা চুরি সন্দেহে এহেন মধ্যযুগীয় বর্বর, অসভ্য কর্মকাণ্ডের প্রতিবেদন প্রকাশ করে তখন সেই দায় কার? এ প্রশ্ন কাঁটা হয়ে বিঁধে বুকের গহীনে।

অন্যান্য স্বল্পোন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশের মতো বাজার নির্ভর অর্থনীতিরই দেশ আমাদের! এই মুক্ত বাজার আর আকাশ সংস্কৃতির মুক্ত বিচরণের ফলে আমাদের জীবন যাপনের অনেক কিছুতেই এসেছে দৃশ্যমান পরিবর্তন।যার অনেককিছুই বাঙালির নিজের নয়; পশ্চিমা ধাঁচের। সুতরাং এই পশ্চিমা স্টাইলের মানবতা কিংবা মানবাধিকার বিষয়ক একটা সূচক এই মুক্তবাজার ব্যবস্থায় নবতর সংযোজন করা যায় কিনা সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে জোর দাবি পেশ করছি।

পরিশেষে জনতার উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলি, আইন প্রণেতারা নয়, জনতাই সমাজের বড় শক্তি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনতার ঐক্যবদ্ধ স্বতঃস্ফূর্ত সুতীব্র উচ্চারণের সময় এখনই।আসুন, প্রতিবাদ করুন, একসাথে।সকল দুরাচার- অনাচারের বিরুদ্ধে। মুখ বুজে থাকার দিন শেষ, গর্জে উঠুন এখনই। সময় বদলাবেই। আলো আসবেই।

সঙ্গীতা ইয়াসমিন, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ