আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

স্বাধীন বাংলাদেশে ভাস্কর্য ছিল, ভাস্কর্য থাকবে

ড. শামীম আহমেদ  

সম্প্রতি ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের দাবি করা হয়েছে। গত ১২ বছরে পৃথিবীর সবচেয়ে সুপরিকল্পিত গণতন্ত্র হত্যা ব্যবস্থার মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াতকে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ ইসলামী উগ্রবাদীদের রাজনীতির প্রধান প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। হেফাজত আন্দোলনে সিংহাসন নড়ে উঠার পর ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সাথে ক্রমাগত আপোষের অংশ হিসেবে ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হাইকোর্টের সামনে থেকে গ্রিক দেবতার ভাস্কর্য সরানোর তাদের দাবি মেনে নেন। সেই সময় সুশীল সমাজ এর তীব্র প্রতিবাদ করলেও সরকার আপাত শান্তির লক্ষে উগ্রবাদীদের এই অন্যায় দাবি মেনে নেয়। আজকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের দাবি তারই ধারাবাহিকতা মাত্র, এবং এর সম্পূর্ণ দায়ভার বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের। এটি খুবই হতাশাব্যঞ্জক যে, উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ভাই ছাড়া আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি সুবিধাভোগীরা তো দূরে থাক, বুদ্ধিবৃত্তিক নন-বেনিফিসিয়ারি সমর্থকদেরও এর বিরুদ্ধে তেমন কিছু বলতে দেখা যাচ্ছে না।

স্বাধীন বাংলাদেশে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের অযৌক্তিক এবং ধর্মান্ধ দাবির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ যদি তীব্র প্রতিবাদ না করে এবং সরকার যদি কঠোর ব্যবস্থা না নেয়, সেটা হবে বাংলাদেশকে আফগানিস্তান কিংবা পাকিস্তান বানানোর দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার অংশবিশেষ।


ভাস্কর্য বা মূর্তির প্রতি মুসলমানদের ক্ষোভের কারণ কী? ধর্মের ভিত্তিতে বিস্তারিত বলতে পারব না, কারণ ধর্ম নিয়ে আমার পড়াশোনা সীমিত। তবে ধর্ম, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি যাই হোক, সাধারণ যুক্তি-তর্কে তার ব্যাখ্যা মেলা জরুরি বলে মনে করি। আমি যতটুকু বুঝি মূর্তিপূজা আল্লাহর একেশ্বরবাদ ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক বলে ইসলাম প্রবর্তনের সময়কালে মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ করা হয়। মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ বলে হয়ত মূর্তিও নিষিদ্ধ। এখন যেই মূর্তি আল্লাহ্‌ ব্যতিত কোন ঈশ্বরকে ইঙ্গিত করে না; সেটা হুমকিস্বরূপ নয় বলেই আমার সাধারণ জ্ঞান বলে। অন্যান্য ধর্মের যেসব মূর্তি, সেগুলোও এই নিষেধাজ্ঞা থেকে বাদ যাবার কথা, কারণ ইসলামে অন্যের ধর্ম পালনে বাধা দেয়ার কথা বলা হয় নাই। সেই হিসেবে আমি মনে করি ঈশ্বর, দেবতা, সৃষ্টিকর্তা ইত্যাদি ধারণার বাইরে যেসব ভাস্কর্য সেগুলো ইসলাম ধর্মের বাধা-নিষেধের আওতায় পড়ার কথা না।


বাংলাদেশ একটা স্বাধীন দেশ। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান এবং ভারত বিভক্ত হয়। পূর্ব-পাকিস্তানের জন্মও তাই ধর্মের ভিত্তিতেই। এমনকি এই ধারণার পক্ষে ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লেই এই বিষয়ে জানতে পারবেন। কিন্তু একটা পর্যায়ে পাকিস্তান অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অত্যাচার-নিপীড়ন শুরু করলে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়। আমাদের দেশের সরকারের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থায় ধর্মের কোন প্রভাব নেই। ইসলামী শরিয়তি আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিচালিত হয় না। সুতরাং প্রথমভাগে ইসলামে ভাস্কর্য নিয়ে আমার ধারণা ভুল হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ঠিক আছে। বাংলাদেশে ভাস্কর্য স্থাপন ও সংরক্ষণ বৈধ।


বাংলাদেশের সংবিধানের শুরু হয়েছে বিসমিল্লাহির-রাহমানির রাহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে) দিয়ে। রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে উল্লেখ আছে ইসলামের কথা। আবার এও বলা আছে -  ‘‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল– জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে৷'' একই সাথে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষতা ইঙ্গিত দেয় বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো সবসময়ই ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারও তার ব্যতিক্রম নয়, বরঞ্চ বলা চলে তারা এর নেতৃত্ব দিচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে।

যাই হোক, “বাংলাদেশের আইনের উৎস মূলত ব্রিটিশ আইন আর বাংলাদেশের ফৌজদারি এবং দেওয়ানি আইন সার্বজনীন ও সেক্যুলার৷ রাষ্ট্রীয় আইনে ধর্মের কোনো প্রভাব নেই৷ বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা মূলত দণ্ডবিধি, ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড এবং সিভিল প্রসিডিউর কোড দিয়ে পরিচালনা করা হয়৷ আদালত ব্যবস্থাও সার্বজনীন৷ এখানে ধর্মের ভিত্তিতে আদালতের কোনো বিভাজন নেই৷ রাষ্ট্রীয় আইনে ধর্মীয় বা শরিয়া আইন বা আদালত বলতে কিছু নেই৷ ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, জেলা ও দায়রা আদালত এবং সুপ্রিম কোর্ট মোটা দাগে এভাবেই আদালতের স্তর বিন্যাস৷” সুতরাং, ইসলাম ধর্মে যদি যেকোনো ভাস্কর্যের প্রতি নিষেধাজ্ঞা থাকেও, তবুও সেটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রে প্রযোজ্য হবে না, কারণ বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে শরিয়া ধর্মের কোন অস্তিত্ব নেই।


জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর শীর্ষ ১০টি মুসলিম দেশ হচ্ছে যথাক্রমে ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ (হ্যাঁ বাংলাদেশ চার নম্বরে), নাইজেরিয়া, মিশর, ইরান, তুরস্ক, আলজেরিয়া, এবং সুদান। এই সবগুলো দেশেই ভাস্কর্য আছে। মৌলবাদী, উগ্রবাদীরা সেগুলো ভাঙার চেষ্টা করেনি এমন নয়, কিন্তু তাদের হুমকি-ধমকি মোকাবেলা করে এইসব ভাস্কর্য দাঁড়িয়ে আছে। যার কিছু কিছু পৌরাণিক গুরুত্বও বহন করে।

বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের দাবি করা ইসলামী শাসনতন্ত্রের নেতাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক। এছাড়াও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের নিহত শহিদদের সংখ্যা নিয়ে যে কোন ভ্রান্ত ধারণা ছড়ানোর বিপক্ষে ‘holocaust denial act’ এর মতো কঠিন আইন করা হোক।

ড. শামীম আহমেদ, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও সামাজিক-বিজ্ঞান গবেষক।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ