প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এখলাসুর রহমান | ১৬ নভেম্বর, ২০২০
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমাড়িতে শহীদুন্নবী জুয়েলকে ধর্মীয় গুজব ছড়িয়ে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর হ্যাক হয়ে যাওয়া ফেসবুক আইডির কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বহিস্কারের ঘটনা ঘটলো। আরও আগে কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর ও ভোলায় অনুরূপ ঘটনা ঘটিয়ে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে প্রচুর জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সাধন করলো। ধর্মের নামে এই সাম্প্রদায়িক জুজু আমাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের চরম হুমকি হয়ে উঠেছে। ব্রাহ্মনবাড়িয়ার হতদরিদ্র রসরাজকে নিয়ে কি তুলকালাম কাণ্ডই না ঘটলো! বিঘ্ন ঘটলো সামাজিক নিরাপত্তার। বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু যুবক রসরাজ দাসের বিরুদ্ধে যে আপত্তিকর ফেসবুক পোস্টের অভিযোগ তুলে সাম্প্রদায়িক হামলার ক্ষেত্র তৈরি করা হলো, সেই ফেসবুক পোস্টটিও যে রসরাজের ছিলোনা তা পরে প্রমাণিত হয়েছে।
ইংরেজি Communalism হচ্ছে এক ধরনের সম্প্রদায়বিদ্বেষী মনোভাব। কোন ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক বলে আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে তার নিজ সম্প্রদায় ভিত্তিতে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি সহিংস বিরোধিতামূলক ক্ষতিসাধনে প্রস্তুত থাকে। আর সেটা কোন ব্যক্তিবিশেষের ক্ষতিসাধন করার মানসিক প্রস্তুতি নিতে কোন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ পরিচয় অথবা বিরুদ্ধতা থেকে সৃষ্ট নয়। ব্যক্তিবিশেষ এ ক্ষেত্রে গৌণ, মুখ্য হলো সম্প্রদায়। ধর্মনিষ্ঠার সাথে সম্পর্ক আছে ধর্মীয় তত্ত্ব এবং আচারের। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার যুক্ততা কেবলই সম্প্রদায়ের সাথে। ধর্মনিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যক্তির ধর্মীয় আচরণ এবং ধর্মবিশ্বাসের গুরুত্বই মূল। সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে তা কেবলই নিজ ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্যের নামে অন্য ধর্ম সম্প্রদায় বিদ্বেষী হিংসাত্মক মনোবৃত্তির বহিঃপ্রকাশটাই মূল। সত্যিকারের ধর্মনিষ্ঠার সুফল প্রাপ্তির প্রত্যাশা হয় পরকালমুখী। আর সাম্প্রদায়িকতার সুফল তারা নেয় ইহলোকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম'-এর ২০১৭ সালের রিপোর্টে ৭১টি দেশের তালিকা উঠে এসেছে যেখানে ব্লাসফেমি আইন রয়েছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশেও হেফাজতে ইসলাম তাদের ১৩ দফার ১ দফায় ব্লাসফেমি আইনের দাবি তুলেছিল। তাদের দাবিটা ছিলো কেবল ইসলাম ধর্ম অবমাননার বিরুদ্ধে। এক্ষেত্রে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অবমাননার ইস্যু এতে ছিলোনা। সুতরাং হেফাজতে ইসলামের এই দাবিকে ধর্মীয় না বলে সাম্প্রদায়িক বললে কি তা অযৌক্তিক বলা হবে? কিন্তু বাংলাদেশের আইনে ধর্ম অবমাননার বিষয়ে কী রয়েছে? ধর্ম অবমাননা এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। কোন ধর্মীয় স্থানের ক্ষতি সাধন, অসম্মান করা, লিখিত বা মৌখিকভাবে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা তৈরি, অসম্মান করার উদ্দেশ্যে ধর্মীয় স্থানে অনধিকার প্রবেশ বা ধর্মীয় বাক্য বা শব্দের বিকৃতি ধর্মীয় অবমাননা বলে গণ্য হবে।
কিন্তু এই আইন কি কেবলই নির্দিষ্ট একটি ধর্মাবলম্বীদের জন্য? সকল ধর্মাবলম্বীদের জন্য নয়? আইন অনুযায়ী সব ধর্মের অনুসারীরাই তাদের ধর্মানুভূতি আহত হলে তার দ্বারস্থ হতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে কি তা ঘটছে? আর কেউ কি আইন মেনে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে? এমনটি হলে কি কেউ রসরাজের বাড়িঘরে হামলা চালাতো, জুয়েলকে পুড়িয়ে মারতো? এই গুজব সৃষ্টিকারীরা কি ধর্ম অবমাননার দায়ে আইন অবমাননার দায়ে দায়ী নয়? কি অপরাধ করেছিলো শহীদুন্নবী জুয়েল? আইন কি শাস্তি দেবে যারা তাকে পুড়িয়ে মারলো তাকে? সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে উঠছে। তারা সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্য অপসারণের দাবি তুলে সফল হয়ে এবার বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের দাবি তুলছে। এগুলো কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও তার অসাম্প্রদায়িক আদর্শের প্রতি মারাত্মক হুমকি নয়?
বিএনপি জামায়াতের সাম্প্রদায়িক জোট সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে ১৪ দলীয় জোট সক্রিয় ছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িক অপশক্তির চলমান ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে তারা সরকারে কেন সক্রিয় নয়? কেন তারা ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের পক্ষে সুদৃঢ় অবস্থানে যেতে পারলো না? হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা কি কোন দেশের পক্ষে পালন করা সম্ভব? যে হেফাজতকে শাপলা চত্বরে দমন করা হল পরবর্তীতে সেই হেফাজতের সাথে কেন সমঝোতা করা হলো? তবে কি সেটা হুমকি ভীতি যুক্ত নতজানু সমঝোতার কৌশল? আর এই কৌশলটা কি ক্রমশ বেপরোয়া আত্মঘাতী হয়ে উঠছেনা? সুপ্রিম কোর্টে নারী ভাস্কর্য সরানো হল এদের দাবির প্রেক্ষিতে। আর এখন তারা দাবি তুলছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সরিয়ে দিতে। কথা উঠছে জামাত শিবির চক্র হেফাজতের পিঠে চড়ে তার নেতৃত্বের দখল নিতে নানামুখী চক্রান্ত করে যাচ্ছে। এমন অভিযোগ হেফাজতের নেতারাই করছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজত ইসলামের একাংশ এমন কথা বললেন। আসলে কী ঘটছে ধর্মের নামে? কে কার বিরুদ্ধে মিথ্যে বলছে? সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করাটা কি স্রেফ উদ্দেশ্যবাজী নয়?
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার হুমকির বিরুদ্ধে কেন রুখছে না সরকার দল আওয়ামী লীগ? কেন সক্রিয় হচ্ছেনা ১৪ দল? কোথায় অসাম্প্রদায়িক মতাদর্শচালিত ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো? বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য সরানোর হুমকি প্রদর্শনের মতো এত সাহস তারা পায় কি করে? ভাস্কর্য হচ্ছে সৃজনশীল শিল্প, যাতে কৃতি ব্যক্তির কৃতকর্মের স্মৃতি ও সৌন্দর্যকে ধারণ করে। একটা দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে। ভাস্কর্য আর মূর্তি কি এক? পাকিস্তান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরাক, ইরান, মিশর , আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, সৌদি আরব, আরব আমিরাতে কি ভাস্কর্য নেই? ধর্মের নামে এসব উদ্দেশবাজী এখনই রুখতে হবে। এদের আর বাড়তে দেয়া যায়না। এদের প্রতি যতবেশি নতজানু হবে ওরা ততবেশি বাড়তে থাকবে। এ বিষয়টা সময় না নিয়ে দ্রুত ভাবা দরকার ও জাগা দরকার।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য