আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

সাকিবকে হত্যার হুমকি একটা শ্রেণির অসহিষ্ণু আচরণের প্রতিনিধিত্ব করে

এনামুল হক এনাম  

সাকিব আল হাসানকে হত্যার হুমকি দিয়ে ফেসবুক লাইভের ভিডিওটা খুবই মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। ভাই লম্বা চাপাতি হাতে দাঁত খিচিয়ে চিৎকার করে সাকিবের মাকে নিয়েও গালাগালি করেছেন। হুমকি দিয়েছেন সাকিব কীভাবে এয়ারপোর্টে নামে তিনি তা দেখে নেবেন। চাপাতি চালিয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে তিনি সাকিবকে জবাই করবেন।

পুরো ভিডিওটা আমায় যথেষ্ট ভাবিয়েছে। ভিডিওতে মহসিন তালুকদার ভাইয়ের হিংস্র অঙ্গভঙ্গি সম্বলিত হুমকি পাগলামি বলে হালকা ভাবে নেয়ার সুযোগ আমি দেখি না। মহসিন তালুকদারগং ইসলাম ধর্মের ইজারা নিয়েছেন, তারা একটি বড় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন। তাদের সমর্থনও ব্যাপক। তারা অনলাইনে নিউজপোর্টালের দুর্গাপূজার খবরের নিচে কমেন্ট সেকশনে গিয়ে হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আসেন। কালীপূজার নিউজে সনাতন ধর্মকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গালিগালাজ করেন। সাকিব আল হাসানের ভেরিফাইড ফেসবুক পেইজে তার স্ত্রীর ছবিতে হিজাব পড়ার জন্য মন্তব্য করে আসেন। একই মানুষগুলো সাকিবের মেয়ের ছবি নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করেন।

ধর্মের ইজারাদার এই ভাইসব সর্বত্র আছেন। অনলাইন, অফলাইন সর্বত্র তাদের কর্মযজ্ঞ। কে কোথায় কী পোস্ট দিলো, কে কী মন্তব্য করলো, আর তাতেই ধর্মের অবমাননা হয়ে যায়। সেই অভিযোগ তুলে মসজিদের মাইকে আহবান করে তারা ঘরবাড়ি আক্রমণ করে জ্বালিয়ে দেন। মানুষ পুড়িয়ে দেন। তাদের কাছে ধর্ম এতই স্পর্শকাতর যে পান থেকে চুন খসলেই তা নষ্ট হয়ে যায়!

খুব খেয়াল করলে দেখবেন আজকাল বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী ক্রিকেটাররা মুসলিম বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে শুভেচ্ছা বার্তা দেন না, এমনকি নিজের ধর্মের ক্ষেত্রেও তারা ফেসবুক শুভেচ্ছা বার্তা এড়িয়ে যান। এর পেছনেও আমাদের এই স্পর্শকাতর ধর্মীয় ভাইদের বিরাট অবদান আছে। নিয়মিত তারা সেইসব ক্রিকেটারদের ফেসবুক পেইজে গিয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার আহবান জানান। ইসলামের ছায়াতলে আসার পরামর্শ দেন। একাধিক সনাতন ধর্মাবলম্বী ক্রিকেটার তাদের শুভেচ্ছা সম্বলিত ফেসবুক স্ট্যাটাস সরিয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে অতীতে।

সাকিব আল হাসান একজন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার, আন্তর্জাতিক সুপারস্টার, পৃথিবীজুড়ে তার ফ্যান। তিনি আইপিএল এ কলকাতা নাইটরাইডারে দীর্ঘদিন খেলেছেন। কলকাতাসহ সারা ভারতে তার অগণিত গুণগ্রাহী দর্শক। তিনি এমনই একজন ক্রিকেটার যিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, দেশের ঊর্ধ্বে গিয়ে পুরো পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করেন। ন্যূনতম মগজ আছে যে কোন ব্যক্তি জানে এটা সমগ্র বাংলাদেশের জন্য সম্মানের। কালীপূজায় সাকিবকে কলকাতায় আমন্ত্রণ জানানো কত বড় সম্মানের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্রিকেটার সাকিব শুধু বাংলাদেশের সম্পদ নন, পুরো উপমহাদেশ এমনকি পুরো পৃথিবীর সম্পদ।

বাংলাদেশে বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় থেকে জাতীয় পর্যায়ে, সকল ধর্মের সকল উল্লেখযোগ্য উৎসবে সশরীরে উপস্থিত হয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। মেম্বার, চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর, মেয়র, সাংসদ, মন্ত্রী সবাই সশরীরে উপস্থিত হয়ে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডার সংস্কারে বা নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, উদ্বোধনের ফিতা কাটেন। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে এটা যেমন তাদের দায়িত্ব, ঠিক তেমনি বিশ্বের নাম্বার ওয়ান ক্রিকেটার, সুপারস্টার হিসেবে সাকিবেরও দায়িত্ব পৃথিবীর সকল ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করা। সুপারস্টার হওয়ার পরদিন থেকেই তিনি এখন সবার ভালবাসার পাত্র। ক্রিকেট তাকে এ ভালবাসা দিয়েছে, ক্রিকেটই তাকে এবং পুরো বাংলাদেশকে এই সম্মান দিয়েছে। এই পর্যায়ের ক্রিকেটার বা সুপারস্টার আমাদের ইতোপূর্বে কখনো ছিল না বলে অনেকেরই বিষয়টি অনুধাবন করার ক্ষমতা হয়তো নেই।

ধর্ম নিয়ে প্রায়শই আমরা দ্বিমুখী চরিত্রে অভিনয় করি। কোন সনাতন ধর্মাবলম্বী বা বিধর্মী ব্যক্তি যখন ইসলাম ধর্মের জন্য কিছু করে, মুসলিমদের জন্য কিছু করে, ঈদে শুভেচ্ছা বার্তা দেয় তখন তা আমরা সাদরে গ্রহণ করি, কিন্তু একই ধরণের কাজ কোন মুসলিম ভিন্ন ধর্মের জন্য করলে আমরা প্রচণ্ড হীনমন্যতার পরিচয় দেই, অশালীন মন্তব্য করি।

আমি শুরুতেই বলেছি, হুমকি প্রদান করা ভিডিওটা আমাকে অনেক ভাবিয়েছে। আপনারাও একবার ভেবে দেখুন, যদি কলকাতার পূজায় আমন্ত্রিত হয়ে যাওয়ায় কোন পাপ হয়ে থাকে তবে তা সাকিব আল হাসানের একারই হবার কথা। সাকিবের পাপের জন্য মহসিন তালুকদার গংদের জবাবদিহি করার কথা না, না ইহকালে, না পরকালে। প্রত্যেকটা কর্মের জন্য ব্যক্তি জবাবদিহি করবে, এমনকি পিতার কর্মে পুত্র বা পুত্রের কর্মে পিতা শাস্তি পাবার কোন সুযোগ নেই। এরপরও মহসিন ভাই ঈমানী জোসে চাপাতি হাতে নিয়েছেন। সাকিবকে হত্যা করার জন্য সিলেট থেকে হেঁটে ঢাকায় চলে যাওয়ার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেছেন।

লক্ষ্য করুন, এই ভিডিওটি বাংলাদেশের একটি বড় জনগোষ্ঠীর অসহিষ্ণু আচরণের প্রতিনিধিত্ব করে। মহসিন তালুকদার সাকিব আল হাসানকে কাঁচামরিচের কারবারি বলে আখ্যায়িত করেছেন। সত্য কথা হল, বাংলাদেশের কাঁচামরিচের আড়তদার থেকে বিশাল ব্যবসায়ী, অশিক্ষিত চায়ের দোকানদার থেকে শিক্ষিত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারের মত মানুষও মহসিন তালুকদারের মত চিন্তা করে। ধর্মের সাথে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ না থাকলেও তাদের অনুভূতি নিয়মিত আঘাতপ্রাপ্ত হয় যে কোন ছোটবড় ঘটনায়, এমনকি ফটোশপ করা ফেসবুক স্ট্যাটাস বা ফেইক আইডি থেকে স্ট্যাটাস। ব্যাপারটা সত্য এবং ভীতিকর। এবং যে কোন ব্যক্তিকে বর্তমান সময়ে হামলা করা এমনকি হত্যা করেও সহজেই জাস্টিফাই করা যায় ধর্ম অবমাননার ধোঁয়া তুলে। আর এজন্য একটি ফেইক আইডিই যথেষ্ট। কাল আপনার বা আমার নামে ফেইক আইডি খুলে ধর্মের নামে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করে, অনুভূতিতে আঘাতের নামে রাজপথে কুপিয়ে মারলেও কেউ কোন প্রতিবাদ করবে না। ধর্মের নামে এদেশে আজকাল সবকিছুই জাস্টিফাই হয়।

শুরুতেই বলেছিলাম আমি চিন্তিত, আমার মনে হয় আপনারও চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন আছে। মহসিন তালুকদার হয়তো নিজের ক্ষোভ নিবৃত্ত করতে না পেরে ফেসবুক লাইভ করে হুমকি দিয়েছেন, এমন লক্ষ জনতা আছে মহসিন ভাইয়ের মতাদর্শী, যারা অন্তরে ক্ষোভ পোষে সুযোগ খুঁজে চাপাতি চালানোর।

এই লেখাটি যখন লিখছিলাম তখন সাকিব আল হাসানের একটি বক্তব্য শুনলাম, তিনি বলেছেন, ‘অনেকেই বলছে, আমি পূজা উদ্বোধন করেছি। যেটি আমি কখনোই করিনি। সচেতন মুসলমান হিসেবে আমি এটা করবো না। তারপরও হয়তো ওখানে যাওয়াটাই আমার ঠিক হয়নি। সেটি যদি আপনারা মনে করে থাকেন তার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ক্ষমা প্রার্থী। আমি আশা করবো, আপনারা এটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। এরকম কোনও ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেটিও আমরা চেষ্টা করবো।’ পুরো বিষয়টি নিয়ে যাতে আর বিতর্ক না হয়, পক্ষে বিপক্ষে অসহিঞ্চুতার আগুন না লাগে, তাই তিনি পানি ঢেলে দিয়েছেন। (ইতঃপূর্বে নিজের মেয়ের ক্ষেত্রেও সাকিবের স্ত্রী তা করেছিলেন। তবে সাকিব আল হাসানের মনে রাখা উচিত, মহসিনগংদের আদর্শ পাকিস্তানি ক্রিকেটার, সাকিব আল হাসান না।

প্রকৃতির কারণে কিংবা ভৌগোলিক, ধর্ম, বা জাতিগত কারণে আমরা বাংলাদেশিরা চরম অসহিষ্ণু হয়ে গেছি কিংবা যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। যাদের ন্যূনতম চিন্তাশক্তি আছে, তারা ভাবুন। নগরে আগুন লেগেছে, দেবালয় রক্ষা পাবে না। সর্বশেষে বলি, একবার ভাবুন, এই ভিডিওটি দিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে আমরা কী বার্তা দিলাম!

এনামুল হক এনাম, কলামিস্ট, সাহিত্যিক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ