আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

৫০ বছরে বাংলাদেশ

মাসকাওয়াথ আহসান  

একজন ব্যক্তিমানুষের বয়স ৫০ হওয়া মানে; জগতের আলো হাওয়ায় ৫০ বছর কাটিয়েছে সে। ক্রিকেটের মাঠে একজন ব্যাটসম্যানকে যেমন প্রতিপক্ষের বোলারের আর ফিল্ডারদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অর্ধশতক পূর্ণ করতে হয়; জীবনের মাঠে ব্যক্তিমানুষও ঠিক তাই-ই করে। ক্রিকেটের প্রতিপক্ষ যেমন ছলে-বলে-কৌশলে উইকেট নিতে চেষ্টা করে; জীবনের প্রতিপক্ষ ঠিক তেমনি ছলে-বলে-কৌশলে মানুষের জীবন ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করে।

কাজেই ব্যক্তির জীবনের অর্ধশতক নিঃসন্দেহে অর্জনের উপলক্ষ। এই ব্যক্তিজীবনের ৫০ বছরের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান থাকতে পারে। তার স্বপ্নভঙ্গের বেদনার অনুভব থাকতে পারে; সেসব তো বিমূর্ত বিষয়। কিন্তু কার্যত সে জীবনের ৫০ বছর উদযাপন করেছে; এর রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে।

বাংলাদেশ তার ৫০ বছর পূর্ণ করার প্রাক্বালে; স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ৫০ টি বছর টিকে থাকার গৌরব; উদযাপনের উপলক্ষ নিঃসন্দেহে। বাংলাদেশ "সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব; কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়" এমন এক সরল সাহজিক অঙ্গীকারে পথ চলেছে। সে বহুত্ববাদি সমাজ রচনার স্বপ্ন নিয়ে পথ হাঁটতে শুরু করেছিলো। ধর্ম-রাজনীতির বিভাজনের প্রতিপক্ষ বাংলাদেশের সেই মানুষের সমাজ রচনার স্বপ্ন কেড়ে নিতে ক্রিকেটের প্রতিপক্ষের মতোই সক্রিয় থেকেছে।

বাংলাদেশ তার স্বকীয়তাকে ধরে রেখে বৈশ্বিক ধারায় মিলিত হতে চেয়েছে। মানুষ যেমন তার পরিবারের আর পরিপার্শ্বের শেকড়ের টানটুকুকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে; রাষ্ট্রও তেমনি তার মাটি-জল-হাওয়ার মৌলিকত্ব ধরে রাখতে চায়। একেই আমরা হয়তো জাতীয়তাবাদ হিসেবে বুঝি।

বাংলাদেশ কল্যাণরাষ্ট্র হয়ে ওঠার স্বপ্ন বুকে ধারণ করেছে। এর প্রতিটি নাগরিকের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-শিক্ষার মৌলিক অধিকার পূর্ণ করাই রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। সেটাকে সমাজতন্ত্র বা সামাজিক গণতন্ত্র বলে বুঝি আমরা।

আর বাংলাদেশের বুকে ছিলো গণতন্ত্রের স্বপ্ন। প্রতিটি নাগরিকের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা; তার চিন্তার স্বাধীনতা বিকশিত হওয়া; রাষ্ট্র পরিচালনায় সব নাগরিকের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া; রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনমতকে বিবেচনা করার অঙ্গীকার বাংলাদেশের মনে ছিলো।

বাংলাদেশ তার ৫০ বছর পূর্ণ করার কালে এই সব স্বপ্ন এখনো পূরণ না হওয়ার বেদনায় ভারাক্রান্ত হবে। কিন্তু তাকিয়ে দেখবে; তার কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ কর্মজীবী মানুষ যখন ৫০টি বছর নিরন্তর কাজ করেছে; আত্মকেন্দ্রিক নাগরিকেরা তখন নিজের জীবনের ৫০ বছরকে অর্থে-সম্পদে-বিলাসিতায়-প্রাচুর্যে অর্থপূর্ণ করে তুলতে ঠগি ও প্রতারক হিসেবে সমাজ দাপিয়েছে।

সাধারণ ছোট-খাট মানুষের ছোট ছোট স্বপ্ন কেড়ে নিতে বিরাটকায় অতিলোকেদের নানারকম ক্ষমতা কুঠার নিয়ে হেঁটে বেড়ানোর ইতিহাসই দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস। সেইখানে বাংলাদেশ একা কী করে তার সামাজিক সুবিচারের স্বপ্ন পূরণ করবে!

বিশ্বের যে দেশগুলো থেকে অন্য দেশে অভিবাসী হবার প্রবণতা বেশি; বাংলাদেশ তার অন্যতম। ৫০ বছর পূর্তির কালে এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অনুতাপের জায়গা। কেবল প্রাণটুকু বাঁচাতে কিছু মানুষ অভিবাসী হয়। দেশকে শুষে সবটুকু রস নিয়ে; দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করতে গিয়ে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা-জাতীয়তাবাদ-সমাজতন্ত্র-গণতন্ত্র; এই সব অঙ্গীকারকে জীবন্মৃত করে; তারপর উন্নত কল্যাণরাষ্ট্রের অভিবাসী হয় আরেকদল মানুষ।

তবুও সাধারণ ছোট খাট মানুষেরা আনন্দ বেদনায় বেঁচেছে; মুহূর্তের সুখের উদ্ভাসে বেঁচেছে। যাদের চাহিদা কম তাদের কর্মক্লান্ত দিনের শেষে ঘুমিয়ে পড়াই সুখ। বছরের প্রথম দিনে স্কুলে বিনামূল্যের বই পেয়ে শিশুর উল্লাস; উপবৃত্তি পেয়ে কিশোরীর স্কুল চালিয়ে যাওয়ার স্বপ্নপূরণ; চায়ের স্টলের এরিস্টটলের পাঠশালায় আড্ডা; কৃষকের চোখে এইবার ধানের ফলন ভালো হয়েছে; এমন আনন্দের ঝিলিক, সেলাই কর্মীর বাচ্চার জন্য প্লাস্টিকের খেলনা কিনে ঘরে ফেরার সুখ; প্রবাসী শ্রমিকের সমস্ত দিনের শেষে দেশে স্বজনের কাছে একটু বেশি টাকা পাঠানোর সুখ; এইসবই জীবনের রূপ-রস-গন্ধের চিহ্ন।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধির অনুকম্পায় দুঃস্থ ভাতা পেয়ে সুখি বৃদ্ধ মানুষ; কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বাদটুকু ভাতের থালায় উদযাপন করে। সে বাংলাদেশের ৫০ বছরের জন্মদিন উদযাপন করে; এর কল্যাণ প্রার্থনা করে। ঘুষ দিয়ে পেনশনের টাকা পেয়ে সৃষ্টিকর্তার শোকরিয়া আদায় করেন বয়েসি নাগরিকেরা। অনেকে ভোগান্তি শেষে দৈবক্রমে অনেক দেরিতে সে পেনশনের টাকা উদ্ধার হলে; জায়নামাজে বসে নফল নামাজ আদায় করে কিংবা পূজার ফুল দিয়ে আসে মন্দিরে। রাষ্ট্রীয় প্রাধিকারটুকু; যা নাগরিকের অবশ্য প্রাপ্য; সেইটুকু নিতে যাবার আগে নাগরিক সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রার্থনা করে; যেন সরকারি অফিসের দয়া হয়। সরকারি কর্মকর্তা বা পুলিশের মধ্যে ফেরেশতা বা দেবতা দেখার আকাঙ্ক্ষা নাগরিককে খোদাভীরু করে তোলে। আর রাজনৈতিক নেতা ও ধর্মীয় নেতাদের মন যুগিয়ে চলা বেঁচে থাকার একমাত্র আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়। হরিণ যেমন বাঘের থাবায় পড়তে চায়না; সাধারণ নাগরিক ঠিক তেমনি প্রভাবশালীর চোখের সামনে পড়তে চায়না।

রাষ্ট্র নাগরিকেরই; কিন্তু সমাজের ক্ষমতাবানেরাই রাষ্ট্রের মালিকানা দাবি করে বসে থাকে। ক্ষমতাবানের শেকল থেকে নাগরিককে মুক্তি দেয়াই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শত বছরের মুক্তি আন্দোলন থেকে ভূখণ্ডের স্বাধীনতা অর্জনের পর গত অর্ধশতকের একমাত্র প্রচেষ্টার জায়গা।

বাংলাদেশের মানুষের গড় ক্রয়-ক্ষমতা বেড়েছে; জীবন প্রত্যাশা বা আয়ু বেড়েছে। অনেক পরিশ্রমী মানুষের টুকরো টুকরো সাফল্য জোড়া দিয়ে তা বাংলাদেশের মানচিত্র হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশের নিরন্তর অন্বেষণ শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে ছোট-খাট মানুষকে নিপীড়নের ভয় থেকে মুক্তি দেয়া। শুভ বোধকে বিলয়ের হাত থেকে রক্ষা করার সম্ভব সব চেষ্টাই জারি রয়েছে। অসুরের হাত থেকে সুরকে বাঁচানোর; অবোধের হাত থেকে বোধকে বাঁচানোর সংগ্রামশীলতাই বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাস।

বাংলাদেশের শিশু-কিশোরেরা স্বপ্ন দেখে; তরুণেরা জীবন উদযাপন করে; মিডিয়ার ব্রেকিং নিউজের বাইরের যে ছোট-খাট জীবন; সেইখানে একটি আনন্দের মুহূর্তের জন্য বাঁচে বাংলাদেশ। দুঃসংবাদের ঘনঘটার মধ্যে একটি সুসংবাদের জন্য উন্মুখ থাকে বাংলাদেশ।

করোনা মহামারীতে ভাইরাস আক্রান্ত ফুসফুসের শ্বাসকষ্ট; ভালুক জ্বর; স্বাদহীনতা; মৃত্যুভয়; এইসব পার করে বেঁচে থাকার যে অপার আনন্দ; ঐ প্রাপ্তিটুকুই জীবন। বাংলাদেশেরও তেমন দুর্নীতির ভাইরাসে শ্বাসকষ্ট, ক্ষমতা জ্বরের প্রকোপ, মৌলিক অধিকারের স্বাদহীনতা, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্রের; এই চারটি অঙ্গীকারের মৃত্যুভয় এইসব পার করে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার যে অমল আনন্দ; ঐ প্রাপ্তিটুকুই অর্জন।

একটি কর্মচঞ্চল দিনের শেষে এই সুন্দর সবুজ দ্বীপে প্রাণস্পন্দন নিয়ে বেঁচে আছি এই ভাবনা নিয়ে নিরাপদ তন্দ্রায় যাবার জনপদটিই বাংলাদেশ। কম-চাহিদার মানুষের জন্য সাহজিক স্বর্গ এই দেশ। অতি-চাহিদার নির্ঘুম দানবের জন্য নরক এই দেশ। এই রহস্যময়তা এই জনপদকে সুখি করেছে। ছোট-খাট মানুষের হৃদয়ের গভীর আকাঙ্ক্ষাটির নাম স্বাধীনতা। ৫০ বছর এই আকাঙ্ক্ষাটি বেঁচে থাকাই বিজয়ের চিহ্ন।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ