প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মোছাদ্দিক উজ্জ্বল | ১৭ আগস্ট, ২০১৫
বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন চোখে দেখিনি। ভিডিও ফুটেজ আর স্টিল ছবির আর্কাইভে স্পষ্ট করেই দেখেছি, সেখানে বলা হয়েছিলো স্লোগানে স্লোগানে, “ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়”। আজ ২০১৫ তে এসে দেখলাম আইসিটি নামের ৫৭-এর ধারা!
যে ধারাটি আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবেই মূলত বানানো হয়েছিলো অথচ সেই ধারাটি আজ আমাদেরই জান কবচ করতে মরিয়া! মাথার উপরে হুলিয়া হয়ে ঘুর ঘুর করছে আইসিটি’র কালাকানুন। আজ আমাদের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাইছে এই আইসিটি’র অপপ্রয়োগের ভয়। ’৫২-তে মুখের ভাষাই কেড়ে নিতে চাইছিলো আর ২০১৫-তে মুখের ভাষা নয়, যৌক্তিক সমালোচনা করার অধিকারটুকু আমরা হারিয়ে ফেলছি, পার্থক্য কেবল এইটুকু!
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের বাক্সে যেই ৩০ শতাংশ ভোট অতিরিক্ত পড়েছিলো, সেই ভোটগুলো কাদের ছিলো? উত্তরটা সোজা। এই ভোটগুলো ছিলো নতুন প্রজন্মের; যারা স্বপ্ন দেখেছিলো বা যাদের স্বপ্ন দেখানো হয়েছিলো এই বলে, একদিন রাজাকার আল বদরদের বিচার করা হবে। হ্যা, বিচার হচ্ছে আজ। বিচার শুরু হওয়ার পরে কোন গোষ্ঠী অনলাইনে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালিয়েছিলো?
কারা এই বিচার প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক বলে বিশ্ব জনমত গঠন করতে চেয়েছিলো? এই উত্তরটাও ভীষণ সহজ। সেই উগ্রপন্থী স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। সেই স্বাধীনতা বিরোধী চক্রদের চক্রান্ত অনলাইনে কারা ধসিয়ে দিয়েছিলো? কারা রাজপথে থেকে মিথ্যার জবাব কলমে, কি-বোর্ডে আর স্লোগানের মাধ্যমে দিয়ে বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো; জামায়াত শিবির স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্তকারীরা এই বিচার প্রক্রিয়া থামিয়ে দিতে চাইছে। উত্তরটা আরও সহজ হয়ে গেলো এইবার। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বলে পরিচিত ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টরা।
এই দেশের স্বাধীনতা পক্ষের শক্তির ব্লগার ও অনলাইনে এক্টিভিস্টরা দুই হাত ভরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দিয়েছে অথচ তারাই এই দলটির কাছ থেকে উপহারস্বরূপ পেয়েছে প্রিয় কিছু সহযোদ্ধার লাশ আর স্বজনের চোখের জল। ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টরা স্মরণকালের সব থেকে বাজে একটি সময় পার করছেন আজ। এক অদৃশ্য ভীতি তাদের সবাইকে গ্রাস করতে বসেছে, অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিলোনা।
আইসিটি আইনটি করা হয়েছিলো কাদের জন্য আর কারা আইসিটির বলির পাঠা হয়ে কল্লা চলে যাবার বেদনা ভোগ করছেন? সেই বাঁশের কেল্লা, রেডিও মুন্না, শিবির গ্রুপের কোনো এক্টিভিস্টদের কি আইসিটি আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে? জাতির পিতা শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা, স্বাধীনতা নিয়ে ভয়ানক অশ্লীল কমেন্ট, ট্রল এবং জঘন্য সব অশ্লীল ফটোশপের ন্যুড ইমেজ যারা ছড়িয়ে দিচ্ছে অনলাইনে, আজ তারাই সব থেকে বেশী নিরাপদ।
অন্যদিকে দীর্ঘ সময় ধরে অনলাইনে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং আওয়ামীলীগের জন্য কাজ করে যাওয়া মানুষগুলো আজ কারাগারে বসে দিন কাটাচ্ছেন। পকেটের পয়সা দিয়ে নেট বিল খরচ করে, দিন শেষের হিসাব নিকাশে তাদের প্রাপ্তি হচ্ছে, গ্রেফতারের আতঙ্ক এবং অদৃশ্য চাপাতির কোপ সইবার জন্য সহ্য ক্ষমতা অর্জন করা।
এখন পর্যন্ত এই আইসিটি নামক যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়াদের দলে যাদের নামের তালিকা দেখতে পাই তারা সবাই এই অনলাইনে স্বাধীনতাস্বপক্ষের শক্তি হিসেবে কাজ করে গেছেন, যাচ্ছেন। অরূপ রতন আর শাহ্ আলম সজীবদের কোন অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছিলো? অনলাইনে গালাগালির জনক বলে খ্যাত একজনের প্রাণনাশের হুমকি মামলায় আটক অরূপ আজও জামিনে মুক্ত হননি। অরূপ রতন আসলে কী অপরাধ করেছিলেন? আইসিটি প্রতিমন্ত্রী পলক সাহেবের সমালোচনা করার কারণে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক শাহ্ আলম সজীবকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো আইসিটির ৫৭-এর ধারায়। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে অনলাইনে সজীব ক্ষমতাসীনদের জন্য কাজ করে গেছেন। লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। লড়ে গেছেন ধর্মান্ধ উগ্রগোষ্ঠী, জামায়াত শিবিরের বিরুদ্ধে। সেই অরূপ রতন কে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়েছে জেলের ভাত!
রবিবারের (১৬ আগস্ট) নির্মম ঘটনায় আমি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলতে বসেছি। আওয়ামী লীগের চরম দুর্দিনে এই দলটির পাশে ছিলো একটিমাত্র পত্রিকা যার নাম দৈনিক জনকণ্ঠ। সেই জনকণ্ঠে রাজাকার, আল-বদরদের বিরুদ্ধে সিরিজ লেখা হতো। যারা সেই সময়ে পত্রিকাটি পড়তেন তারাই কেবল জানেন। সেই জনকণ্ঠে লিখতেন স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৪ স্বজন হারানো সাংবাদিক প্রবীর সিকদার।
আজীবন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালনকারী, ধারণকারী প্রবীর দা’ নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন কেননা নূলা মূসা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে এর আগে তার একটি পা’ই চলে গেছে! ফরিদপুরের কুখ্যাত রাজাকারদের সম্পর্কে তার ক্ষুরধার লেখনী আমাদের অনেক কিছুই জানতে সাহায্য করেছে। তার লেখনী আমাদের অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সেই প্রবীর সিকদারকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর দাঁয়ের করা আইসিটি মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে! কী অপরাধ প্রবীর সিকদারের? ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফের দুর্নীতি কিংবা রাজাকার নূলা মুসা সম্পর্কে লেখাই ছিলো কী তার একমাত্র অপরাধ?
দিনে দিনে মিত্র হারাতে বসেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি তাদের দুর্দিনের করুণ ইতিহাসের কথা মনে রাখেনি। ভিনদেশী রাষ্ট্র নয়, আগে নিজের দেশের, নিজের গোত্রের লোকদের মূল্যায়ন করতে হয় অথচ এই নীতি থেকে সরে এসেছে দলটি। সরকারের ন্যাকেড পলিসি বারবার কেড়ে নিচ্ছে আমাদের বলার অধিকার। আইসিটি আইনের অপপ্রয়োগে বিপর্যস্ত আমাদের এই অনলাইন পরিবার; তাই ক্রমশ হারাতে বসেছে অনলাইনে লেখালেখির আগ্রহ! সর্বশেষ প্রবীর সিকদারের ঘটনা কী ইঙ্গিত করে? আওয়ামী সরকারের সকল অর্জনগুলো ধুলোয় মিশিয়ে যেতে এই সব কারণ যথেষ্ঠ।
আজ আমি লিখবনা, কাল আপনি, পরশু অন্য কেউ। এইভাবে একদিন এই ভার্চুয়াল জগত ছাড়া হয়ে যাবো আমরা সবাই। ঘুরে ফিরে সেই নিজামি মুজাহিদের প্রেতাত্মারা রাজত্ব করবে অনলাইনে। ১৯৯৭ থেকে রাজপথে এবং ২০০৯ থেকে অনলাইনে যেই কাজগুলো করে আসছি আজ সবই মিছে মনে হয়! মাথার উপর হুলিয়া হয়ে ঘোরে আইসিটি ৫৭।
আওয়ামী লীগ আসলে কী চায় স্বাধীনতাপক্ষের অনলাইন এক্টিভিস্ট ও ব্লগারদের কাছে? উত্তর আমার জানা নেই। কাদের জন্য লড়ছি? হাজার হাজার টাকার নেটের বিল পকেট থেকে দিয়ে আমি কাদের পক্ষে সাফাই গাইছি? নিজের মিডিয়া ব্যবসা রেখে, মিডিয়া বন্ধুদের অনুরোধ অগ্রাহ্য করে কেন এইসব করছি? সত্য সমালোচনার প্রতিদান যদি হয় আইসিটি ৫৭ তাহলে থাকুক সব পড়ে। তবুও এই আমি আবারো বলি, " শুয়োরের সাথে সহবাসের ফতোয়া অস্বীকার করছি"।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য