আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

দক্ষিণ এশীয় কেল্লাতন্ত্র

মাসকাওয়াথ আহসান  

দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি সেই মুঘল আমল কিংবা তারও আগে থেকে; কেল্লার ভেতর ও বাইরে "হ্যাভস" ও "হ্যাভস নট" এই দুটি ভাগে বিভাজিত। কেল্লার ভেতরে রাষ্ট্রক্ষমতার দখলদারিত্বের সুবিধা ভোগকারীদের বিলাসী জীবন। আর কেল্লার বাইরে রাষ্ট্রীয় শোষণের খাঁচায় বন্দি দারিদ্র্যে বিশীর্ণ জীবন।

পৃথিবীর সব দেশেই রাজনীতি বিকাশের ধারাটি মোটামুটি এরকমই। কেল্লার ভেতরের বিলাসী জীবন আর কেল্লার বাইরের মানবেতর জীবন; এই বেদনাদায়ক বিভাজন জিইয়ে রেখে শোষণ-নিপীড়নের যন্ত্রটিই হচ্ছে রাষ্ট্রযন্ত্র। সময়ের বিবর্তনে বেশ কিছু রাষ্ট্র কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে; মানব সভ্যতার ট্র্যাজেডির উপশম করে; অসভ্য রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কিছুটা সভ্য করে আনার প্রয়াস পেয়েছে। যেখানে প্রতিটি শিশুর জীবন বিকাশের মৌলিক সুযোগগুলো সৃষ্টির প্রচেষ্টা দৃশ্যমান।

কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় "পেশি-জাতীয়তাবাদ-ধর্মীয় অনুভূতি" এইসব প্রতারণামূলক রেটরিক ব্যবহার করে কতিপয়ের কেল্লা ও জেল্লাতন্ত্রকে ধরে রাখা হয়েছে। কেল্লার বাইরের মানুষকে "ফইন্নির ঘরের ফইন্নি" করে রেখে; শিশুর বিকাশের সুযোগ কেবল কেল্লা কেন্দ্রিক করে রেখে; ফইন্নির জন্য "অপরাধ আর রাজনীতি" এই দুটি পথ খোলা রাখা হয়েছে; ফইন্নি জীবনের অভিশাপমুক্ত হয়ে কেল্লার জেল্লাজীবন অর্জনের পথ হিসেবে।

সম্প্রতি অরবিন্দ আদিগা'র উপন্যাস "দ্য হোয়াইট টাইগার" অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্যে বিশীর্ণ জীবনে দুর্ভাগ্যের খাঁচায় বন্দি মুরগি জনতার জীবন বদলের যে দুটি পথ: অপরাধ ও রাজনীতি; সেটি খুব স্পষ্ট করে দেখানো হয়েছে। দৈবচয়নে অপরাধ কিংবা রাজনীতির মাঝ দিয়ে ফইন্নির ঘরের ফইন্নি থেকে একটি সাদা বাঘ বেরিয়ে আসাটাকেই সাফল্যের সূচক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। কেননা এখানে যোগ্যতা ও কঠোর পরিশ্রমের মাঝ দিয়ে দারিদ্র্যের খাঁচা থেকে বের হবার পথ তো নেই।

ক্ষমতা-কেল্লার ভেতরের জেল্লা জীবনটিকে কতিপয়ের "প্রিভিলেজড লাইফ" ও "এনটাইটেলমেন্ট" করে রাখায় দক্ষিণ এশিয়ার "বেগার'স এলিটিজম" বা "ফইন্নির আভিজাত্যের বোধ" প্রতিষ্ঠা পেয়েছে সাফল্যের সূচক হিসেবে।

ব্রিটিশ উপনিবেশে "সিভিল সার্ভিস"-এ লোক নিয়োগের মাধ্যমে কেল্লা জীবনকে আরও বিস্তৃত করা হয়। অবশ্য আগের রাজা-বাদশাহদের আমলেও তাদের নিয়োগকৃত জায়গীরদাররাও আজকের দিনের সাংসদ বা সিভিল সার্ভেন্টদের মতো "হোয়াইট টাইগার"-ই ছিলো। দৈবচয়নে যারা উঠে আসতো কেল্লাতন্ত্রের জেল্লাকাঠামোতে।

ব্রিটিশ উপনিবেশের কেল্লাতন্ত্রের অর্থনীতি কিংবা পরবর্তী সময়ে ভারত-পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নব্যকেল্লাতন্ত্রের জেল্লা যোগান দিতে কেল্লার বাইরের কৃষক ও শ্রমিকের শ্রমশোষণই একমাত্র পথ। এই কৃষক-শ্রমিককে রাষ্ট্রীয় আইনের ডাণ্ডাতন্ত্র দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়; তারা "ফইন্নির ঘরের ফইন্নি" তাদের কাজ হচ্ছে কেল্লার ভেতরের রাজন্যবর্গের আরাম আয়েশ নিশ্চিত করা। রাজন্যবর্গের সন্তানদেরই রয়েছে একটি নিশ্চিত বর্তমান ও আগামীর অধিকার। আর ফইন্নিবর্গের সন্তানদের জীবন মুরগির খাঁচার জীবন। তাদের কাজ ডিম দেয়া ও আমিষ সরবরাহ।

দক্ষিণ এশিয়ার এই যে স্বপ্নহীন জীবন; সেখানে অপরাধ ও রাজনীতির মাংসের কারবারের মাঝে গরীবের ঘরের "হোয়াইট টাইগার"-দের রাজাকার বা সহমত ভাই হয়ে কেল্লাতন্ত্রে ও বেগার'স এলিটিজমে প্রবেশের যে আকুতি; সেটিই একমাত্র সাফল্যের পথ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এইপথে ঝুঁকি আছে; একশোজন রাজাকার বা সহমত ভাইয়ের মধ্যে সাফল্যের সম্ভাবনা হয়তো দশজনের; বাকি নব্বইজন সেই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার মোরগ যার রাজপ্রাসাদে ঢোকার স্বপ্ন ছিলো; যে স্বপ্ন পূরণ হয় একমাত্র রাজপ্রাসাদের নৈশভোজের টেবিলে আমিষ হয়ে।

কেল্লার অর্থনীতিতে আমিষ যোগান দেয়া একশোটি মোরগের মধ্যে নব্বইজন মারা পড়লে; দশজন টিকে যায় নতুন এলিট হিসেবে। সেই এলিটের গল্পের ফুলঝুরি রূপকথার গল্প হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্যন্তে।

গোটা পৃথিবীর দেশে দেশে কেল্লাতন্ত্র ধসে পড়ে; কল্যাণ রাষ্ট্রতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চোখে পড়লেও; দক্ষিণ এশিয়ার কেল্লাতন্ত্র যেন আদি ও অকৃত্রিম। এ এমন এক অচলায়তন যা থেকে মুক্তির সম্ভাবনা ক্রমেই ক্ষীণতর হচ্ছে। "কেল্লার রাজাকার বা সহমত ভাই" হবার যে স্বপ্ন; তা সৎ ও পরিশ্রমী মানুষের স্বপ্নকে পরাজিত করেছে; এটা বলাই বাহুল্য। দুর্নীতির সাপলুডুর সিঁড়ি বেয়ে কেল্লার লোক হয়ে পড়া নব্য এলিটেরা যখন "দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের" গল্প নিয়ে হাজির হয়; দুর্নীতির সাপলুডু খেলতে উদ্যত নতুন হোয়াইট টাইগারেরা তখন মুচকি হাসে। কারণ সে তো জানেই, অপরাধ ও রাজনীতি ছাড়া "সফল জীবন" গড়ার আর কোন পথ নেই এই জনপদে।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ