আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আমরা যদি সকল বর্বরতার প্রতিপক্ষ হতে না পারি

ফকির ইলিয়াস  

সিলেটে রাজনকে নির্মমভাবে হত্যা করার ১৫ দিন যেতে না যেতেই ২৯ জুলাই খুলনায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে রাকিব নামক কিশোরকে। ঘটনাটি এ রকম-পিটিআই মোড়ের নূর আলম মটরসের শিশু শ্রমিক রাকিব প্রয়োজনে কবরখানা মোড়ের শরীফ মটরসের পাশের দোকানে রং আনতে যায়। এ সময় শিশু রাকিবকে জাপটে ধরে তার মটর গ্যারেজের ভিতরে নিয়ে যায় শরীফ। 



সেখানেই ছিল তার দূর সম্পর্কের চাচা মিন্টু খান ও তার মা বিউটি বেগম। শরীফ শিশু রাকিবকে তার গ্যারেজে কাজ না করার কারণে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। এ সময় মজুরি বেশি পাওয়ায় ওখানে কাজ করছে জানিয়ে তাকে ছেড়ে দিতে আকুতি জানায় শিশু শ্রমিক রাকিব। এ কথা শুনে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে রাকিবের ফুলপ্যান্ট খুলে ফেলে শরীফ। তার মা বিউটি বেগম ও মিন্টু খান শিশু রাকিবকে গ্যারেজের ফ্লোরে চেপে ধরে এবং শরীফ বাস ও ট্রাকে হাওয়া দেবার কমপ্রেসার মেশিনের পাইপ মলদ্বারে ঢুকিয়ে পেটে হাওয়া দিতে শুরু করে। এ সময় শিশু রাকিব যন্ত্রণায় ছটফট শুরু করে। পেটে ও বুকে ব্যথার কথা বলে ছেড়ে দিতে আর্তনাদ করে। একপর্যায়ে বমি শুরু করে রাকিব। এ সময় ঘাতকরা পার্শ্ববর্তী গুডহেলথ ক্লিনিকে নিয়ে যায় রাকিবকে। সেখান থেকে খুলনা জেনারেল হাসপাতাল, পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা শিশু রাকিবকে ঢাকায় নেবার পরামর্শ দেন। অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় নেবার পথে রাত সাড়ে ১১টার দিকে শিশু রাকিবের মৃত্যু হয়।



এরপরই ঘটেছে আরেকটি লোমহর্ষক ঘটনা। এবার বরগুনার তালতলীতে ১১ বছরের এক শিশু রবিউল ইসলামকে চোখ উপড়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। মাছ চুরির অভিযোগে তাকে এভাবে হত্যা করা হয়। উপজেলার ছোট আমখোলা গ্রামের এক মাছের ঘের থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সে ওই এলাকার ফরাজি বাড়ি দাখিল মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। তার বাবার নাম মো. দুলাল মৃধা। এসব কি হচ্ছে বাংলাদেশে? এ দেশের মানুষ কি বিবেক হারিয়ে পশুত্বজীবন বেছে নিতে চাইছে? কোথায় রাষ্ট্রীয় আইন? কেন এসব হায়েনাদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না?



অনেকেই বলছেন বাংলাদেশ এগোচ্ছে। কোথায় এগোচ্ছে? নৃশংসতায়? প্রজন্মের প্রতি রাষ্ট্রের দায় কি?

একটি ঘটনা দিয়ে উদাহরণ দিই। কয়েক বছর আগে আমার বড়ো মেয়ে যে ইন্টারমিডিয়েট স্কুলে পড়তো, সে স্কুলটি ঐ বছর ‘নাসা এক্সপ্লোরার স্কুল’ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক স্বীকৃতি পেয়েছিল। গোটা যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চাশটি স্কুল এ সম্মাননা অর্জন করেছিল ওই বছর। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের মাত্র চারটি স্কুল পেয়েছিল এ স্বীকৃতি। এ উপলক্ষে স্কুলে একটি বর্ণাঢ্য উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। এই স্বীকৃতির আনন্দকে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক সবার প্রাণে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আয়োজন হয়েছিল শিক্ষাবিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন-উত্তর পর্বের।



সে অনুষ্ঠানে বিশ্বের এয়ার স্পেস বিজ্ঞানের মহাশক্তিশালী সংস্থা নাসার দুজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা উপস্থিত হয়েছিলেন। তারা সানন্দে ছাত্রছাত্রী-অভিভাবকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন। ওয়াল্টার জেকব নামের একজন কর্মকর্তা নাসার বিভিন্ন পরিকল্পনা সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দিলেন। নাসা যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটি স্কুলকে বেছে নিয়েছে মেধাবৃত্তিতে। এ স্কুলগুলোকে ৩ বছর মিলিয়ন ডলার গ্রান্ট দেবে নাসা। নাসার উদ্দেশ্য হচ্ছে এই পঞ্চাশটি স্কুল থেকে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষামনস্ক মেধাবী ছাত্রছাত্রী গড়ে তোলা। মেধা বিবেচনায় নাসা প্রতি বছরই যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটি স্কুলকে গ্রান্ট দিয়ে থাকে।



জেকব বললেন, নাসা এভাবেই বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। আমরা যদি সকল বর্বরতার প্রতিপক্ষ হতে না পারি এই বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা মেধা অন্বেষণ করছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে গোটা যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতি বছর যদি ১০০ জন মেধাবী ছাত্রছাত্রীকে আমরা শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, প্রকৌশলী, মহাকাশ বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি তবেই আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হবে এবং আমরা সফলও হচ্ছি। নাসা প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে যে গ্রান্ট পায় তার সবটা কাজে লাগাতে পারে না। তাই এই গ্রান্ট ফিরিয়ে না দিয়ে তা নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য, তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই গ্রান্ট হিসেবে দেয়। কারণ নাসা মনে করে এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীর মধ্য থেকেই বেরিয়ে আসবে আগামীর শ্রেষ্ঠ মহাকাশ বিজ্ঞানী। যারা একদিন মহাকাশে স্থাপত্য নির্মাণের স্বপ্নটি বাস্তবে রূপ দেবে। যারা জয় করবে সকল কল্পনার অসাধ্য কাজ।



জেকবের বক্তব্য যখন শুনছিলাম তখন আমি নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলাম অন্য একটি চিন্তার ঘোরে। একই বিশ্ব। আর এই একই বিশ্বের একাংশের মানুষ মহাকাশ জয়ের পথে এগুচ্ছে। আর অন্য অংশের মানুষ সংগ্রাম করছে ভাঙা পাঁজরগুলো নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য। শিক্ষাখাতে একজন ছাত্রছাত্রীর জন্য অনুদান, স্কলারশিপ কিংবা গ্রান্টকে একটি বিনিয়োগ বলেই মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা বিভাগ। কেউ লেখাপড়া করতে চাইলে তাকে সর্বোচ্চ সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে ফেডারেল, স্টেট, সিটি গভর্নমেন্ট। তার কারণটি হচ্ছে, এই শিক্ষার্থী তার লেখাপড়া সম্পন্ন করে একটা ভালো চাকরি করবে। ভালো বেতন পাবে। আর সেই বেশি বেতন থেকে ফেডারেল, স্টেট গভর্নমেন্টও পাবে বেশি ট্যাক্স। সরকার একজন শিক্ষার্থীর পেছনে যে গ্রান্ট বিনিয়োগ করবে, ১৫-২০ বছর ট্যাক্স দিয়ে সেই শিক্ষার্থী ফেরত দেবে এর দ্বিগুণ অর্থ। অতএব লাভ তো সরকারেরই হচ্ছে।



ইউরোপ-আমেরিকার শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ এভাবেই বাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বে শিক্ষার আলো। মানুষ তার ন্যায্য অধিকার পাবে। নাগরিক পাবে তার যোগ্য স্বীকৃতি। এভাবেই হবে শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির অগ্রগতি। প্রতিটি দেশ নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ীই তার প্রজন্মকে সংরক্ষণ করবে। বিশ্বের মানবাধিকারের এটাই নিয়ম। কিন্তু সেই নিয়মটি কি সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে? না হচ্ছে না। আর হচ্ছে না বলেই শুধু আর্থিক দরিদ্রতা নয় বরং মানসিক দৈন্যই ম্লান করে দিচ্ছে প্রজন্মের স্বপ্ন। মানুষের অগ্রসর হওয়ার পথ।



বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আড্ডায় প্রায়ই কথা ওঠে। সেদিন একজন সমাজবিজ্ঞানী খুব জোর দিয়েই বললেন, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাটি হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের অনিচ্ছা এবং একগুঁয়েমি। কারণ ক্ষমতাসীনরা মনে করেন এই প্রজন্মও তাদের অনুগত হবে। তারা তাদের অনুগত হয়ে বড়ো হবে। এটা তো সম্ভব নয়। প্রজন্মকে তাদের মতো করে বড়ো হতে দিতে হবে। তাদের মেধার বিকাশ সাধন করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ঐ সমাজবিজ্ঞানীর কথাগুলো শুনে আমি বারবার পরখ করার চেষ্টা করছিলাম বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতার কথা। কী জঘন্য পরিকল্পিতভাবেই না আজ একটি জাতিকে আদিমতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য একটি অপশক্তির হাতে দেশকে তুলে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছিল। বিবেক বিক্রি করে জাতিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। দেশে আজও মৌলবাদী, ফতোয়াবাজ, জঙ্গিবাদীরা গোপনে সংগঠিত। এরাই বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমীনের মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলের ছবি প্রচার করে মহান মুক্তিযুদ্ধকে হেয় প্রতিপন্ন করার অপচেষ্টা করছে।



বিশ্বের দেশগুলো যখন মেধার বিনিয়োগ করছিল, বাংলাদেশে তখন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বেড়ে উঠেছিল আদিম জঙ্গিবাদ। মৌলবাদী দানবেরা যেকোনো বিজ্ঞান, প্রযুক্তিকেই স্বীকার করে না-এর প্রমাণ তো বিশ্বে কম নয়। আমরা ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তানে শিশু হত্যার দৃশ্য দেখছি প্রায় প্রতিদিন। এমন তো বাংলাদেশে হবার কথা ছিল না। খুবই পরিতাপের কথা-এ দেশের অনেক রাজনীতিবিদই চান না প্রজন্ম তাদের পুষ্ট পাঁজর নিয়ে দাঁড়াক।



বাংলাদেশে চলতি সময়ে যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা খুবই অমানবিক। এর সুরাহা দরকার। প্রতিকারে বিশেষ আইন দরকার। মনে রাখতে হবে দানবেরা যতোই শক্তিশালী হোক না কেন, মানবের কাছে তারা সবসময় পরাজিত হয়েছে এবং হবেও। প্রয়োজন শুধু গণ-ঐক্যের। আমরা যদি সকল বর্বরতার প্রতিপক্ষ হতে না পারি তবে প্রজন্মের কাছে জবাব দেবার কোনো পথ খোলা থাকবে না।

ফকির ইলিয়াস, কবি ও কলাম লেখক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ