আজ বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

সেদিন আমিও ছিলাম শাহবাগের মোহনায়

ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ  

৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩; যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পরপরই রায়টি আমাদের কাঙ্খিত না হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে যে স্ট্যাটাসটি দিয়েছিলাম ফেসবুক মেমোরি তা মনে করিয়ে দিলো। একে একে মনে পড়ে গেলো সেদিনের খণ্ড খণ্ড কতগুলো স্মৃতিও। রায় ঘোষণার পরপরই তার প্রতিবাদ জানিয়ে দুপুর বারোটা সাড়ে বারোটার দিকে বিএসএমএমইউ'র বটতলা থেকে যতদূর মনে পড়ে আহসান হাবীব হেলাল ভাইয়ের নেতৃত্বে একটা ছোটখাটো মিছিল নিয়ে শাহবাগ চত্বর হয়ে হোটেল শেরাটন পর্যন্ত গিয়ে আবার শাহবাগ চত্বরে এসে মিছিল শেষ করেছিলাম। সেই মিছিলে আমাদের অগ্রজ আরিফুল ইসলাম জোয়ারদার টিটো ভাইও ছিলেন।

রাস্তাঘাট অন্যদিনের তুলনায় একটু ফাকাই ছিলো, সেসময় রায় ঘোষণার দিনগুলোতে এমনই হতো। জামায়াত-শিবিরের নৈরাজ্যের আতঙ্কে অনেকেই রায় ঘোষণার দিনগুলোতে ব্যক্তিগত বাহন নিয়ে বের হতো না। আমরা যখন মিছিলটা শুরু করেছিলাম তখনও শুরুটা সেইভাবে শুরু হয়নি। বিএসএমএমইউ আমাদের কর্মস্থল এবং তা একেবারেই শাহবাগের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হওয়ায় আমরা হয়ত এই বাড়তি সুবিধাটুকু পেয়েছিলাম যে আমরা সবার আগেই শাহবাগে পৌঁছুতে পেরেছিলাম। আমরা যখন শেরাটনের মোড় থেকে মিছিল নিয়ে ঘুরে শাহবাগ চত্বরে ফিরছিলাম ততক্ষণে আমাদের তৎকালীন রাজনৈতিক সতীর্থ অনুজ ইমরান এইচ সরকারের নেতৃত্বে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের সংগঠনটি অবশ্য শাহবাগে এসে পড়েছিলো। ইমরানদের হয়তো আগে থেকেই প্রস্তুতি ছিলো। যতদূর মনে পড়ে, যদি আমার স্মৃতিশক্তি আমাকে বিট্রে না করে থাকে তাহলে বলবো, ওদের হাতে কয়েকটি ব্যানারও মনে হয় তখন দেখেছিলাম। ওরা সংগঠিত ছিলো ও প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলো। আমাদের কোন প্রস্তুতি ছিলো না, কোন ব্যানার ফেস্টুনও ছিলো না। সেদিন রায় ঘোষণা হবে তাই সেটা নিয়ে আর সবার মতো আমাদের মধ্যেও চাঞ্চল্য ছিলো, এটুকুই।

কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি 'ফাঁসি' হবে আমরা এমনটাই আকাঙ্ক্ষা করেছিলাম। যখন রায় ঘোষণার সময় ঘনিয়ে আসলো আমরা অনেকেই যার যার ডিপার্টমেন্টের কাজ সেরে বিএসএমএমইউ'র বটতলায় জড়ো হতে লাগলাম। একসময় হেলাল ভাইও আমাদের মাঝে এসে উপস্থিত হলেন। ভেবেছিলাম একটা আনন্দ মিছিল করবো কিন্তু যখন রায় ঘোষিত হলো তখন একইসাথে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হলাম। আমরা যারা জুনিয়র ছিলাম তারা হেলাল ভাইকে প্রতিবাদ মিছিলের অনুরোধ জানালাম, হেলাল ভাই সম্মতি দিলেন এবং হেলাল ভাইয়ের নেতৃত্বে তৎক্ষণাৎ আমরা সেই ছোটখাটো প্রতিবাদ মিছিলটি বের করলাম। আমরা তখনো ভাবিনি ইমরানের নেতৃত্বে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের সংগঠনটি সেদিনই বিকেল থেকে এতোবড় একটি মহীরুহ গণজাগরণ গড়ে তুলবে।

যে কথাটি না বললে অপরাধ হবে সেটা হলো এই গণজাগরণের সেদিনের শুরুতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো। যদিও পরবর্তীতে অনেকেই বিভিন্নভাবে ছাত্রলীগের সেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথাটি অস্বীকার করতে একরকম মরিয়া আচরণ করেন বললেও মোটেও অত্যুক্তি হবে না।

যাইহোক, সেদিন সেই ৫ ফেব্রুয়ারির পর থেকে সব যেন জাদুমন্ত্রের মতো ঘটতে লাগলো। মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধুর অমিয় জাদুমন্ত্রতে বিমোহিত হয়ে কতিপয় নর্দমার কীট ব্যতিরেকে পুরো সাড়ে সাতকোটি বাঙালি যেমন করে এক বিন্দুতে মিলেছিলো, যেমন করে সাড়ে সাতকোটি কণ্ঠ এক হয়ে এক 'জয় বাংলা' স্লোগানে আকাশ বাতাস কাঁপিয়েছিলও তেমন করেই যেন জনস্ফুরণ ঘটতে লাগলো। আমাদের মতো অভাগা প্রজন্ম যারা মুক্তিযুদ্ধকালের সেই মহেন্দ্রক্ষণের সাক্ষী হতে পারিনি তাদের জন্যই মনে হয় এই ৫ ফেব্রুয়ারি এসেছিলো, তাদের জন্যই মনে হয় এই গণজাগরণ এসেছিলো। আমরাও সেদিন দেখেছিলাম কতিপয় নর্দমার কীট বাদে সারাদেশের সমূদয় তারুণ্য কীভাবে এক তালে এক লয়ে এক সুরে একই শাহবাগের মোহনায় মিলেছিলো আর কীভাবে একই গগনবিদারী 'জয় বাংলা' স্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করেছিলো।

একেকটা দিন যাচ্ছিলো আর শাহবাগের মোহনায় জনসমাগম যেন গুণোত্তর হারে বাড়ছিলো। সেসময় ঢাকার বিভিন্ন দূরবর্তী অঞ্চল থেকে যেমন ঝাঁকে ঝাঁকে মিছিলের বন্যা আসতে দেখেছি তেমনি ঢাকার বাইরে থেকেও মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসে এই শাহবাগের মোহনায় মিলতে দেখেছি। মিছিলে স্লোগানে উদ্বেলিত হতে দেখেছি। গগনবিদারী চিৎকারে বাতাসে বজ্রমুঠি হানতে দেখেছি। শুধু কি শাহবাগ? মোটেও না! সেই প্রোজ্জল মিছিল, সেই হৃদয়মথিত আবেগ, সেই তারুণ্য আর প্রাণমাখানো আগুনের ঝলকা সেদিন শাহবাগ ছাড়িয়ে ছাপিয়ে গিয়েছিলো দেশের প্রতিটি শহরে শহরে, প্রতিটি নগরে নগরে, প্রতিটি গঞ্জে গঞ্জে, প্রতিটি গ্রামে গ্রামে, প্রতিটি কোণে কোণে!

অন্য সবার মতো আমরা চিকিৎসকরাও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) পক্ষ থেকে প্রতিটি দিন, প্রতিটি বিকেল, প্রতিটি সন্ধ্যায় মিছিল নিয়ে হাজির হয়েছি শাহবাগের সেই মোহনায়; কখনো ব্যানার হাতে, কখনো পতাকা মেলে কিংবা কখনো মোমবাতি জ্বালিয়ে। সেসময় আমাদের প্রতিটি মিছিলে, প্রতিটি স্লোগানে শাহবাগের মোহনায় আমাদের চিকিৎসকদের অগ্রভাগে নিজে সশরীরে উপস্থিত থেকে আমাদেরকে সতত উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন স্বাচিপ'র তৎকালীন মহাসচিব এবং বর্তমানের সভাপতি ইকবাল আর্সলাম স্যার।

সেসময় শাহবাগ চত্বরের কেন্দ্রীয় স্লোগানের পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং দূরবর্তী বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বিভিন্ন সহযোদ্ধারা গুচ্ছে গুচ্ছে ভাগ হয়েও স্লোগান ধরতেন। আমাদের স্বাচিপ'র গুচ্ছেও তেমনি অনেকে স্লোগান ধরতেন। ছোটভাই ফোয়াদের স্লোগান উপস্থিত সকলকেই ছুঁয়ে যেতো, শেখ মামুন ভাই তো ওর নামই দিয়ে দিলো 'স্লোগান মাস্টার'। মাঝে মাঝে মিছিল স্লোগানের ফাঁকে ফাঁকে দেশাত্মবোধক জাগরণের গানও চলতো। সেইসব গান যেন আরও জ্বালানি হিসেবে কাজ করতো, রক্তে আগুন জ্বালিয়ে দিতো, শিরায় শিরায় নাচন তুলে দিতো। বন্ধু রিয়াদ সিদ্দিকী প্রাণ, সঞ্জয়, মামুন ও আরও অনেকেই গানের এই আসরে প্রাণ যোগাতো।

শাহবাগ চত্বরেই স্বাচিপ'র তত্ত্বাবধানে একটা প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রও খোলা হয়েছিলো যেখান থেকে খাবার পানি, খাবার স্যালাইন, এ্যন্টি আলসারেন্ট, মাথা ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল বা এরকম আরও কিছু প্রাথমিক ওষুধ সরবরাহ করা হতো। খুব সম্ভবততৌহিদ ভাই, মীর মোবারক হোসাইন দিগন্ত ভাই আর মিজানুর রহমান মিজান ভাইয়ের পরিকল্পনায় এটা করা হয়েছিলো আর এটার সার্বিক দায়িত্বে ছিলো বন্ধু নাজমুল, হোসাইন ইমাম ইমু, সঞ্জয় আর ছোটভাই সাগর।

কোথায় হারিয়ে গেলো সেই দিনগুলো! আহ! আবারও যদি ফিরে আসতো। আবারও যদি সবাই প্রাণের বন্ধনে একইভাবে মিলতে পারতাম। আবার যদি কখনো ডাক আসে, আবার যদি ৭১'র পরাজিত হায়েনারা আমার পতাকা খামছে ধরতে চায় নিশ্চয় আমরা আবারও একইভাবে মিলিত হবো। আবারও বাতাসে বজ্রমুঠি হেনে গগনবিদারী 'জয় বাংলা' স্লোগানে শাহবাগ কাঁপাবো।

তবে জীবদ্দশায় যদি আবার ডাক না আসে তাহলে অন্তত এই সুখস্মৃতিই আমাদের জাগিয়ে রাখবে যতদিন বেঁচে থাকবো। কারণ এই স্মৃতির মাঝেই গর্ব আছে, এই স্মৃতির মাঝেই তৃপ্তি আছে, এই স্মৃতির মাঝেই সুখ আছে। এই স্মৃতি আগলেই আমার অনাগত প্রজন্মের কাছে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবো আমিও সেদিন ছিলাম, আমরাও সেদিন ছিলাম। ছিলাম শাহবাগের মোহনায়।

ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ, সাবেক সহ তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ